অসাধারণদের অসাধারণ গুণ

মার্কিন বিজ্ঞানী কার্ল সাগান বলেছিলেন, ‘অসাধারণ দাবির পক্ষে অসাধারণ প্রমাণ থাকতে হয়।’ কথাটাকে একেকজন একেকভাবে ভিন্ন অর্থে দারুণভাবে ব্যবহার করেছেন। আমরাও কথাটিকে একটু ঘুরিয়ে বলতে পারি, ‘অসাধারণ মানুষ হতে হলে অসাধারণ গুণের অধিকারী হতে হয়।’ তবে অসাধারণ গুণের তো আর অভাব নেই। কিন্তু সব গুণের গুরুত্বও আবার সমান নয়। তবে অসাধারণ মানুষের মধ্যে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ গুণগুলোই বেশি থাকে। গুরুত্বহীন গুণের পেছনে সময় কাটালে অসাধারণের বদলে আমরা হয়ে যাব অতিসাধারণ।

আজ আমরা কয়েকটি অসাধারণ গুণের কথা বলব। এগুলো অর্জন করতে পারলে অবশ্যই অসাধারণ হয়ে ওঠার পথে এগিয়ে যেতে পারবে অনেকটা পথ।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

১. আবেগগত বুদ্ধিমত্তা (EQ) 

ইন্টেলিজেন্স কোশেন্ট বা আইকিউর সঙ্গে তোমরা নিশ্চয়ই পরিচিত। এমনই আরেক পরিভাষা ইমোশনাল কোশেন্ট (ইকিউ)। এটা দিয়ে বোঝানো হয়, আমরা আচরণের মাধ্যমে কতটুকু ইতিবাচক ফলাফল বের করতে পারি। অন্য অর্থে বললে, নিজের ও অন্যের আবেগ উপলব্ধি করে পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষা করার যোগ্যতা। নেতৃত্বের গুণ অর্জন করতে দরকার ইকিউ। ভালো ক্যারিয়ার গড়তেও চাই এই গুণ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সফলদের মধ্যে ৯০ শতাংশ মানুষের ইকিউ খুব বেশি। আবার উল্টোভাবে ব্যর্থদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশের ইকিউ ওপরের দিকে। বেশি ইকিউধারীরা পয়সাও বেশি কামান। একই গবেষণায় দেখা গেছে, ইকিউ ১ পয়েন্ট বেশি হলে বার্ষিক আয় গড়ে ১ হাজার ৩০০ ডলার বা প্রায় ১ লাখ টাকা বেশি হয়৷ ইকিউয়ের সর্বোচ্চ মান ১৬০। তবে গড় ইকিউ ৯০-১০০।

ইকিউয়ের প্রধান অংশ তিনটি

  • নিজের ও অন্যের আবেগ বুঝতে পারা

  • আবেগকে বাস্তবায়ন করতে পারা

  • নিজের ও অন্যের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারা

২. সময় ব্যবস্থাপনা

আমাদের মাথায় গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুত্বহীন হাজারটি কাজের ভাবনা জমে থাকে। এ ক্ষেত্রে বড় একটি সমস্যা দাঁড়ায় অগ্রাধিকার ঠিক করা। কোন কাজ আগে করা উচিত, এখনই কোন কাজটি করা উচিত, কোনটি করাই উচিত নয়, এটা বুঝতে পারা খুব জরুরি। এক বা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজে একনিষ্ঠভাবে লেগে থাকা খুবই জরুরি। মনোযোগ সরিয়ে ফেলার উপাদানের অভাব নেই। অতএব সাবধান হতেই হবে।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

৩. শোনা

আমরা যখন কথা বলি, সে সময়টা ছাড়া আর প্রায় সব সময়ই আমরা কিছু না কিছু শুনি, তা–ই না? আসলে কিন্তু তা নয়। আমরা আসলে মনে করি আমরা শুনছি। কিন্তু হয়তো মন পড়ে আছে অন্য কোথাও। হয়তোবা ভাবছি একটু পর কী বলতে হবে। সত্যিকারের শোনা বলতে কিন্তু বোঝায় বক্তা কী বলছে, শুধু তাতেই মনোযোগ দেওয়া। আরেকজনকে ভুল প্রমাণ করার বদলে বোঝার মানসিকতা থাকা দরকার।

আমরা প্রায় সবাই মনে করি, একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে আমি ভালো শুনি। রাইট স্টেট ইউনিভার্সিটির এক জরিপে প্রায় সবাই বলেছেন, তাঁরা অন্যদের চেয়ে ভালো শোনেন। বুঝতেই পারছ, অনেকেই ভুল মনে করেছেন। 

৪. না বলতে পারা

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার এক গবেষণায় দেখা গেছে, না বলতে তোমার যত বেশি কষ্ট হবে, তত সহজে তুমি হতাশা ও বিষণ্নতায় আক্রান্ত হবে। তবে না বলা আসলেই কঠিন। যখন কারও কোনো প্রস্তাব বা অনুরোধ তোমার পক্ষে রাখা সম্ভব হবে না, তখন ‘আমার মনে হয় না’ বা ‘আমি নিশ্চিত না’ এমন কথার বদলে ‘না’ বলে দেওয়াই উচিত। নতুন কোনো কাজের প্রতি ‘না’ বলার মাধ্যমে বর্তমানে করা কাজটির প্রতি আরও বেশি যত্নবান হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। কাজটিকে সফলভাবে শেষ করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ‘না’ বলার মাধ্যমে নিজেকে অপ্রয়োজনীয় চাপ ও বোঝা থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয়।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

৫. সাহায্য চাওয়া

এটাকে অনেকের কাছেই কোনো দক্ষতা বলে মনে হবেই না। তবে প্রয়োজনের সময় সহায়তা চাইতে প্রচুর পরিমাণ আত্মবিশ্বাস ও বিনয় দরকার হয়। অনেক সময় নিজের আত্মমর্যাদা (পড়ো অহংকার) বিসর্জন দিতে হয়। ভুল পথে চলে বিব্রত হওয়ার চেয়ে নিজের অহংবোধ ত্যাগ করা বেশি ভালো। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা মানে কিন্তু বিষয়টা নিজের না জানাকে প্রকাশ করে ফেলা। অতএব, কাজটি আসলেই কঠিন। এ কারণেই এটিও অসাধারণ এক দক্ষতা।

৬. ভালো ঘুম

এবার নিশ্চয়ই না হেসে পারোনি। ঘুমও তাহলে অসাধারণ গুণ! ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টারের এক সাম্প্রতিক গবেষণা কিন্তু তা–ই বলছে। এতে দেখা গেছে, ঘুমের সময় মস্তিষ্ক থেকে বিষাক্ত প্রোটিন বেরিয়ে যায়। এই বিষাক্ত উপাদান তৈরি হয় জেগে থাকার সময় মস্তিষ্কের ব্যবহারের ফলে নিউরনের উপজাত হিসেবে। ঘুম পূর্ণ না হলে বিষাক্ত সব উপাদান মস্তিষ্ক থেকে দূর হবে না। ব্যাহত হবে চিন্তাশক্তি। যেটা ক্যাফেইন দিয়েও ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

৭. পদক্ষেপ নিতে পারা

ভালো পরিকল্পনা করা খুব বেশি কঠিন নয়। তবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা আসলেই কঠিন। বাস্তবায়ন করতে গেলে পরিকল্পনাকে ঢেলে সাজাতেও হয়। কী করতে হবে, তা জানা এবং আসলেই কাজটি করার মধ্যে অনেক তফাত। অনেক সময় পদক্ষেপ নিতে গেলে অনেক ঝুঁকির মুখেও পড়তে হবে। এ ছাড়া প্রচলিত স্রোতে গা ভাসিয়ে বসে থাকার চেয়ে নতুন কিছু ভাবা ও করার মধ্যেই রয়েছে নিজের ও দেশের কল্যাণ। 

৮. ইতিবাচক থাকা

আমরা সবাই নানান সময় বিভিন্ন সমস্যায় পড়ি। কোনো কোনোটি অনেক বড় সমস্যা। তবে আমরা প্রায় সবাই ভাবি, ‘মানলাম, সমস্যায় সবাই-ই পড়ে। তবে আমার সমস্যাটিই সবচেয়ে বড়।’ এটা ভেবে আমরা অনেকেই হতাশ হয়ে পড়ি। আমাদের মস্তিষ্কের একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি সব সময় হুমকি বা বিপদের খোঁজ করে। আর হুমকির দিকে আমাদের মনোযোগী করে রাখে। এটা আমাদের প্রতিকূল পরিবেশে হয়তো সহায়তা করে। তবে একে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে হতাশা আমাদের কাজে গতি কমিয়ে দেবে।

তথ্যসূত্র: ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স ২.০ /ট্র্যাভিস ব্র্যাডবেরি