আত্মসমর্পণের চিঠি হাতে দুই কিশোর

কামালপুর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ মুহূর্তের দুই নায়ক বশির আহমেদ (বাঁয়ে) ও আনিসুল হক আকন্দ
ছবি: হারুন হাবীব

মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। নানা দিক থেকে ওরা অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সফল হলো না। বকশীগঞ্জ-কামালপুরের মধ্যে প্রতিটি সড়কে অ্যাম্বুশ বসানো হয়েছিল। পাকিস্তানিদের বহু যানবাহন ধ্বংস হলো। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অনেক পাকিস্তানি সেনা হয় মারা গেল, না হয় ধরা পড়ল। ভয়ংকর এক হতাশার মধ্যে পড়ল কামালপুর রণক্ষেত্রের হানাদার বাহিনী।

তোমাদের বরং কামালপুর এলাকাটি সম্পর্কে একটু বলে নিই। বর্তমান জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী একটি এলাকা এটি। মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর কাছেই ছিল গুরুত্বপূর্ণ রণক্ষেত্র। কারণটা ছিল, কামালপুর দখলে নিতে পারলেই বকশীগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকার দিকে সহজেই অগ্রসর হতে পারতেন মুক্তিযোদ্ধারা। ওদিকে নিজেদের অবস্থান অটুট রাখতে পাকিস্তানি বাহিনীও ছিল অনড়। তাই ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকে অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে কামালপুরে। অনেকেই হয়তো জানো, মুক্তিযুদ্ধের সময় পা হারিয়েছিলেন কর্নেল আবু তাহের। সেই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছিল এখানেই এক গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে। তবু তিনি বেঁচে ফিরেছিলেন, কিন্তু প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁর অনেক সহযোদ্ধা। এখনো কামালপুরের যুদ্ধ সম্পর্কে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পাঠ্যসূচিতে পড়ানো হয়। বুঝতেই পারছ, কতটা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল এই রণাঙ্গন।

দিনে দিনে গুরুত্বপূর্ণ রণক্ষেত্রটির অবস্থান হারাতে বসেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তখন নভেম্বর মাসের শেষ দিক। কিন্তু নিশ্চিত পরাজয় জেনেও হারটা স্বীকার করছিল না হানাদার বাহিনী। বরং বাংকার থেকে আচমকা গুলি ছুড়ছিল মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে। এভাবেই চলল ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ৩ ডিসেম্বর গঠিত হলো বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সামরিক কমান্ড। নাটকীয় পরিবর্তন ঘটল যুদ্ধের। শত শত ভারতীয় সামরিক যান আসতে শুরু করল সীমান্তে। ভারতীয় ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লের নিজে এসে উপস্থিত হলেন। কোনোরকম লোক ক্ষয় না করে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিল, কামালপুরের পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ করাতে হবে। ৪ ডিসেম্বর সকাল। উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে প্রস্তাব রাখা হলো: কে যাবে আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পে?

সীমান্তঘেঁষা ভারতীয় গ্রাম ব্রাহ্মণপাড়ায় তখন যৌথ বাহিনীর হাজারো সদস্য উপস্থিত, যাঁরা মৃত্যুকে হাতে নিয়েই যুদ্ধের ময়দানে। কয়েক ঘণ্টা আগেও সম্মুখসমরে বীরত্ব দেখিয়েছেন তাঁরা। তবু এই প্রশ্নে তাঁদের মুখাবয়বে অনিশ্চয়তা। হাসিমুখে এমন নিশ্চিত মৃত্যুকে বরণ করতে কে চায়?

ব্রিগেডিয়ার ক্লের যখন প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার করলেন, ঠিক তখনই মুক্তিবাহিনীর এক কিশোর যোদ্ধা বলে উঠলেন, ‘আমি যাব।’

সেই কিশোর যোদ্ধার নাম বশির আহমেদ।

কামালপুরের আত্মসমর্পণ মুহূর্ত, ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
তাঁর হাতে সাদা পতাকা। পতাকা নাড়ালেন। কিন্তু শত্রুপক্ষের ক্যাম্পের ভেতর থেকে কোনো সাড়া পেলেন না। তখন নিশ্চয়ই ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় পড়ে গেলেন! কী করবেন তিনি, এভাবে কতক্ষণ থাকবে? ঠিক সে সময় ক্যাম্পের ভেতরে তাঁকে ডাকল পাকিস্তানি বাহিনী

বশির গেলেন চিঠি হাতে

হাতে সাদা পতাকা, পকেটে আত্মসমর্পণের চিঠি। যৌথ বাহিনীর স্থানীয় কমান্ডার পাকিস্তানি বাহিনীর উদ্দেশে চিঠিতে লিখেছেন: নির্ধারিত সময়ে আত্মসমর্পণ না করলে একযোগে আক্রমণ চলবে, এমনকি বিমান থেকে আঘাত করা হবে।

অবধারিত মৃত্যু উপেক্ষা করে বশির আহমেদ যাত্রা শুরু করলেন কামালপুরের পথে। সেই দৃশ্য তাকিয়ে দেখলেন উদ্বিগ্ন সহযোদ্ধারা। ব্রাহ্মণপাড়া থেকে কয়েক শ মিটার দূরেই কামালপুর বিওপি (বর্ডার আউট পোস্ট)। বিওপিটিই ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প। বশির আহমেদ ক্যাম্পের সামনের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে সাদা পতাকা। পতাকা নাড়ালেন। কিন্তু শত্রুপক্ষের ক্যাম্পের ভেতর থেকে কোনো সাড়া পেলেন না।

তখন নিশ্চয়ই ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় পড়ে গেলেন! কী করবেন তিনি, এভাবে কতক্ষণ থাকবে? ঠিক সে সময় ক্যাম্পের ভেতরে তাঁকে ডাকল পাকিস্তানি বাহিনী। বশির আহমেদ দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে গেলেন ক্যাম্পের ভেতরে। আসতে আসতে সম্ভাব্য বিপদের কথা যা ভেবেছিলেন, ঠিক তার বিপরীত আচরণ পেলেন কোণঠাসা পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে। তাঁকে বসতে দেওয়া হলো। রুটি-ডাল দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো। চিঠি পৌঁছে দিলেন বিওপির কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের হাতে।

চিঠির বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেও সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না পাকিস্তানি বাহিনী। অনেক সময় গড়াল। এরই মধ্যে মিত্রবাহিনীর চারটি যুদ্ধবিমান হামলা শুরু করল। বশির আহমেদকে বাংকারে ঢোকানো হলো। কয়েকজন সৈনিক হতাহত হলো। পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল আরও ভেঙে গেল।

এবার গেলেন আনিসুল

সময় পেরিয়ে গেলেও বশির আহমেদ ফিরলেন না। উদ্বিগ্ন সহযোদ্ধারা ভেবে নিলেন বশিরের জীবনে ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে। কিন্তু আত্মসমর্পণের কী হবে? এবার চিঠি হাতে নিলেন আরেক দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা। তিনি আনিসুল হক আকন্দ। পরিচিতদের কাছে যিনি সঞ্জু নামেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর সাহসিকতায় মিত্রবাহিনীর কর্মকর্তারা রীতিমতো বিস্ময়ে হতবাক হলেন। সেই একই পথে, একই কায়দায় চিঠি হাতে এগিয়ে গেলেন সঞ্জু। কমান্ডারের হাতে তুলে দিলেন চিঠি।

দ্বিতীয় চিঠি পেয়েও কালক্ষেপণ করছিল পাকিস্তানি বাহিনী। ভড়কে দেওয়ার জন্য আবারও বিমান হামলা করে যৌথ বাহিনী। অবস্থা বেগতিক বুঝতে পারে পাকিস্তানি সেনারা। আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আহসান মালিক। তবে শর্ত জুড়ে দিলেন তিনি, আত্মসমর্পণের আগে কথা বলতে চান। মালিকের এই বার্তা নিয়েই বশির আহমেদ ছুটে এলেন ব্রাহ্মণপাড়ায়। তাঁকে পেয়ে ক্যাপ্টেন আদর করে তাঁর ঘাড়ে তুলে নিলেন। আত্মসমর্পণের আলোচনার প্রস্তাবে রাজি হয়ে পাঠানো চিঠিটা ব্রিগেডিয়ারের হাতে তুলে দিলেন বশির। ওদিকে সঞ্জু তখনো ক্যাম্পেই রয়ে গেলেন।

কামালপুরে উড়ল লাল-সবুজ পতাকা

এরপর আত্মসমর্পণ–প্রক্রিয়া নিয়ে ঘণ্টাখানেক আলাপ চলল দুই পক্ষের। সন্ধ্যার পর যুদ্ধরীতি মেনে শুরু হলো আত্মসমর্পণ পর্ব। আহসান মালিকসহ ১৫০ জনের বেশি নিয়মিত বাহিনীর সদস্য, ৩০ জনের ওপর রেঞ্জার, মিলিশিয়াসহ বেশ কিছু স্থানীয় রাজাকার আত্মসমর্পণ করল যৌথ বাহিনীর কাছে। শত্রুমুক্ত হলো কামালপুর। পতাকা উঠল স্বাধীন বাংলাদেশের।

সেই সঙ্গে নায়ক বনে গেলেন আনিসুল হক আকন্দ সঞ্জু আর বশির আহমেদ। তাঁদের বীরত্বগাথা তখন সহযোদ্ধাদের মুখে মুখে। দুজনই তখন স্কুলপড়ুয়া। সঞ্জু প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ম্যাট্রিক পরীক্ষার (বর্তমান এসএসসি), বশির আহমেদ পড়তেন দশম শ্রেণিতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দুজনই যুক্ত হয়েছিলেন ১১ নম্বর সেক্টরে। প্রশিক্ষণ শেষে অংশ নিয়েছিলেন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে।

এমন বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য দুই কিশোর যোদ্ধা পেয়েছেন ‘বীর প্রতীক’ সম্মান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পেয়েছেন অমরতা।

তথ্যসূত্র: জামালপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, রজব বকশী (গতিধারা) এবং কামালপুর ১৯৭১, মুহাম্মদ লুৎফুল হক (প্রথমা প্রকাশন)