আশাওয়ালা

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

২০২০ সালের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাস। একটা কুকুর বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে যাচ্ছিল। আমি আর আমার বোন জানালার ধারে বসে বৃষ্টি দেখছিলাম। ঠিক তখন দেখলাম, একটি কুকুর দৌড়ে যাচ্ছে। এমন সময় আমি মজা করে বললাম, ‘এই যে কুকুর, এদিকে আয়!’ সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটি আমাদের জানালার নিচে দৌড়ে এল। আমরা ভাবলাম, হয়তো বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য সে এখানে এসেছে। সেদিনের পর থেকে যখনই কোনো কুকুরকে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখতাম, তখনই কিছু না কিছু বলে ডাকার চেষ্টা করতাম তাদের। ভাবতাম, তারাও হয়তো ওই কুকুরের মতো জানালার নিচে দৌড়ে আসবে। কিন্তু না! তারা ঘুরেও এদিকে তাকাত না। একদিন একটা কুকুর রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। কুকুর চোখে পড়া মাত্রই আমি ডাক দিলাম, ‘এই যে কুকুর এদিকে, এদিকে তাকা।’ তারপর সে দাঁড়িয়ে গেল। তখন আমি বুঝলাম, এটাই সেই কুকুর যে আমার ডাকে সাড়া দিয়েছিল। তারপর আমি ভাবলাম, আহ্! কী সুন্দর করে তাকিয়ে আছে, যাই কিছু খাবার নিয়ে আসি। তারপর বিস্কুট আনতে গিয়ে দেখলাম বাসায় একটা বিস্কুটও নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। ফ্রিজেও দেখলাম দেওয়ার মতো কোনো খাবার নেই। তারপর খালি হাতে জানালায় গিয়ে দেখি সেই কুকুরটি তখনো দাঁড়িয়েই আছে।

সে বুঝেছে যে আমি তার জন্য খাবার আনতে গেছি। পরে যখন সে দেখল আমি তার জন্য কিছু আনিনি, তখন সে নিরাশ হয়ে চলে গেল। খুবই আশা নিয়ে এসেছিল সে। আহা রে, বেচারা কতই না আশা নিয়ে এসেছিল একটু খাবার পাবে বলে। তাই আমরা কুকুরটির নাম রাখি ‘আশাওয়ালা’। এরপর থেকে যখনই আমাদের বাসায় মুরগির মাংস রান্না হতো, তখনই আশাওয়ালার জন্য আমরা মুরগির হাড় রেখে দিতাম। তারপর যখন ওকে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখতাম, তখনই ওকে আশাওয়ালা বলে ডাক দিতাম। আর ও দৌড়ে চলে আসত। বুঝলাম নামটাও ওর বেশ পছন্দই হয়েছে। যাহোক, তারপর আশাওয়ালাকে ওপর থেকে (আমাদের বাসা দোতলায়) খাবার দিতাম এবং ও খেয়ে চলে যেত। মাঝে মাঝে নিচে গিয়েও ওকে খাবার দিতাম। এভাবে দুই মাস কেটে গেল। একদিন আশাওয়ালার পেটে বাচ্চা এল এবং অবশেষে তার চারটা বাচ্চা হলো। আমাদের বাসার পেছনের গ্যারেজে (গাড়ি রাখার জন্য তৈরি একটি টিনের ঘর) সে এবং তার বোন মিলে মোট আটটা বাচ্চার জন্ম দিয়েছিল। তারপর সেই গ্যারেজে গিয়ে আমরা আশাওয়ালাকে খাবার দিয়ে আসতাম এবং তার বাচ্চাদের দেখে আসতাম। কিন্তু একদিন কিছু দুষ্টু লোক আশাওয়ালা এবং তার বোনের বাচ্চাদের একটি বস্তায় ভরে ড্রেনে ফেলে দিয়ে এসেছিল। সেদিন আশাওয়ালা এবং তার বোন সারা দিন কান্নাকাটি করছিল এবং তাদের বাচ্চাদের খুঁজছিল। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ইস্! কী যে খারাপ লেগেছিল আমাদের। তারপর দিন যায়, দিন আসে। আশাওয়ালাও যায়, আসে। আবার এপ্রিল মাসে আশাওয়ালা প্রতি দিন বিকেলে আমাদের বিল্ডিংয়ের সামনে এসে বসে থাকত। তাও আবার প্রতিদিন একই সময়ে। এরপরও যদি কোনো খাবার থাকত, তখন আমরা নিচে গিয়ে তাকে খাবার দিয়ে আসতাম। তার কিছুদিন পরই আশাওয়ালা আমাদের কাছে আসা বন্ধ করে দিল। অপেক্ষা করতে লাগলাম তার জন্য। এভাবে মাসের পর মাস চলে গেল। কিন্তু তবু সেই খয়েরি রঙের আশাওয়ালা এল না। জানি না তুই কোথায় আছিস। তবে যেখানেই আছিস, তুই যেন সেখানে ভালো থাকিস। পারলে আমার কাছে ফিরে আয়।

লেখক: ৭ম শ্রেণি, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উচ্চবিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর