ছেলেদের স্বাধীনভাবে ঘুরতে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেলেন মুরাদ সাহেব। বিখ্যাত গোয়েন্দা তিনি। দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে বাস করেন আমেরিকার পূর্ব তীরে আটলান্টিকপারের ছোট্ট শহর বেপোর্টে।
ঘুরতে ঘুরতে অদ্ভুত দোকানটা নেড ব্রাউনের চোখে পড়ল। দোকানের সামনে বড় একটা জানালা। কালো রং করা চৌকাঠ। ডিসপ্লেতে একটা নরকঙ্কাল দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। যদিও কঙ্কালটা আসল নয়, প্লাস্টিকের। তবে দেখতে একেবারে আসলের মতোই লাগে। পাঁচ ফুটের বেশি লম্বা।
‘চলো, ঢুকে দেখি,’ কৌতূহল দমন করতে না পেরে বলল সুজা মুরাদ।
আঙুল তুলে দেখাল সুজার বড় ভাই রেজা মুরাদ, ‘দেখো, সাইনবোর্ডে কী লেখা: এখানে হাত দেখা হয়।’
মুচকি হাসল রেজা-সুজার বন্ধু নেড। ‘এই জ্যোতিষী বলবে, আমাদের মাথায় শিং গজাবে। আরেকবার এক জ্যোতিষী বলেছিল না, পেছনে লেজ গজাবে।’
মুচকি হাসল সুজা। ‘গজাক, তবু না দেখে আমি যাব না।’
ঘড়ি দেখল রেজা। ‘ওরিব্বাবা, চারটে বাজে! বাবার সঙ্গে সাড়ে ছয়টায় ডিনার। মনে আছে?’
মাথা দোলাল সুজা। ‘আছে। সে জন্যই তাড়াতাড়ি করা দরকার। এসো, ঢুকি।’
আমেরিকার একটা দর্শনীয় স্থান ছোট্ট শহর আটলান্টায় বেড়াতে এসেছে ওরা। নেডের দেখানো অদ্ভুত দোকানটায় ঢুকল। আর ঢুকেই একটা ধাক্কা খেল। ডাইনির গুহার আদলে সাজানো হয়েছে ঘরটা। মৃদু আলো ধীরে ধীরে রং বদলাচ্ছে, আশপাশের সবকিছু ভুতুড়ে লাগছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে রোমাঞ্চকর মিউজিক। ঘরের দেয়ালে অদ্ভুত সব জিনিস সাজানো। কতগুলো বাক্স দেখা গেল। সেগুলোতে নানা ধরনের লেবেল সাঁটানো, ‘ঘৃণার আরক’, ‘কর্মজীবনে উন্নতির আরক’, ‘পরীক্ষায় পাসের আরক’, ইত্যাদি। বড় বড় খোলা পাত্র আছে কতগুলো। ওগুলোতে আছে কুকুরের চুল, গোসাপের চোখ, ময়ূরের যকৃত, সাপের খোলস, ম্যানড্রেকগাছের শিকড় এবং আরও নানা রকম অদ্ভুত জিনিস।
‘শুকনো মাথাগুলো দেখো,’ একটা কাচের বাক্সে আঙুল দিয়ে দেখাল নেড। ‘ভয়ংকর লাগছে না?’
‘সাবধান না হলে আমাদের দশাও ওগুলোর মতোই হতে পারে,’ ঠাট্টা করল রেজা।
নেড বলল, ‘জায়গাটা জানি কেমন লাগছে আমার। ঠিক বোঝাতে পারব না...’
‘হুঁ, তা ঠিক,’ মাথা দোলাল সুজা। এই ভুতুড়ে আবহর মধ্যে গা ছমছম করছে ওরও। ভয়ের কিছু নেই, এখানকার সবকিছুই সাজানো, নিজেকে মনে করিয়ে দিল ও।
‘মনে হচ্ছে যেন অ্যাজটেকের মন্দির। বলি দেওয়ার ঘর,’ মন্তব্য করল রেজা। কাউকে চোখে পড়ল না। গলা চড়িয়ে ডাকল, ‘কেউ নেই নাকি এখানে?’
খসখসে একটা কণ্ঠ ভেসে এল ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে। ‘কী চাই?’
পাক খেয়ে ঘুরে গেল তিনজনে।
দেখল ছায়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে এক মহিলা। পরনে গোড়ালি ঢাকা কালো আলখাল্লা, লম্বা কালো চুল ঢেকে রেখেছে মুখের একটা পাশ। মহিলার কালো চোখের তির্যক দৃষ্টি, সবুজ আইশ্যাডো আর ঠোঁটের লাল টকটকে লিপস্টিকে তাকে ভ্যাম্পায়ারের মতো লাগছে।
‘হাত দেখাতে চাই,’ ভয়ে ভয়ে বলল নেড। ‘কত লাগবে?’
‘দশ ডলার,’ জবাব দিল মহিলা।
‘আমার কাছে চার ডলার আছে,’ বলল নেড। ‘চলবে এতে?’
ইঙ্গিতে রেজা আর সুজাকে দেখিয়ে মহিলা বলল, ‘তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে নিতে পারো না?’
‘তিনজনে মিলিয়ে তিরিশ তো?’ মাথা নাড়ল রেজা। ‘আমাদের কাছেও অত টাকা নেই। চলো, নেড, আজ আর হাত দেখানো হলো না।’
হাত তুলল মহিলা। তাড়াতাড়ি বলল, ‘দাঁড়াও দাঁড়াও। তোমাদের আমার ভালো লেগেছে। যা আছে, তাতেই দেখে দেব। কে আগে দেখাবে?’ ভুরু কুঁচকে রেজার দিকে তাকাল মহিলা। ‘তুমি?’
মাথা কাত করল রেজা। ‘আমার আপত্তি নেই।’
‘এসো আমার সঙ্গে।’
দরজার পর্দা সরিয়ে ওদের নিয়ে পেছনের ঘরে ঢুকল মহিলা।
‘খাইছে!’ চমকে গেল নেড।
এ ঘরটা আগেরটার চেয়েও ভুতুড়ে। পুরো ঘর কালো মখমলে মোড়া। একটা বেগুনি রঙের বাতি জ্বলছে। সেই আলোয় সবার দাঁত আর চোখের মণিও বেগুনি দেখাল। ভয়ংকর লাগল তাতে।
হঠাত্ করেই মনে হতে লাগল তিনজনের, এখান থেকে আর বেরোতে পারবে না কোনো দিন। সময় থাকতে পালাবে কি না চিন্তা করতে লাগল নেড। কিন্তু মহিলা ততক্ষণে নিচু একটা টেবিলে বসে পড়েছে। রেজাকে ইশারা করল তার পাশে বসতে। টেবিলটা কালো মখমলে মোড়া। ওপরে একটা কাচের বড় বল।
রেজার হাতের তালু মেলে ধরল মহিলা। চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। টেবিলের সামনে দুটো কুশনে বসেছে সুজা আর নেড। গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছে মহিলার কাজকর্ম।
‘তোমার বয়স আঠারো,’ রেজার হাত দেখে অবশেষে বলতে শুরু করল মহিলা। ‘তুমি সাগরের ধারের কোনো শহরে, বড় একটা বাড়িতে বাস করো। সাংঘাতিক বুুদ্ধিমান তুমি, ছাত্র হিসেবে ভালো, ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র আর কম্পিউটারে আগ্রহ। আরও একটা কাজে তুমি খুব দক্ষ, কারও ওপর নজর...অর্থাৎ সতর্ক দৃষ্টি রাখা...’
একটু টুকরো কাগজ আর পেনসিল নিল সে। ‘তোমার জন্মতারিখ কবে বলো।’
বলল রেজা। মহিলা তারিখটা লিখে কাগজের ওপর কতগুলো লাইন টানল। লাইনগুলো কাটাকুটি করে তারপর আঁকল একটা বৃত্ত।
‘ক্রিস্টাল বলের দিকে তাকাও!’ হঠাৎবলে উঠল সে।
তাকাল রেজা। তবে ভেতরে ভেতরে সতর্ক। জানে ক্রিস্টাল বল দিয়ে জ্যোতিষীরা সম্মোহন করে ফেলে।
কিন্তু মহিলা সম্মোহন করল না রেজাকে। সে-ও চেয়ে রইল ক্রিস্টাল বলের দিকে। ঝাড়া এক মিনিট ওদিকে তাকিয়ে থাকার পরে উত্তেজিত হয়ে উঠল সে।
‘তুমি গোয়েন্দা!’ রেগে গেছে মহিলা। ‘তোমরা এখানে কেন এসেছ? আমার লাইসেন্স আছে। আমি অন্যায় কিছু করছি না। পুলিশ আমার কিছু করতে পারবে না।’
‘আমি পুলিশের লোক নই, ম্যাম,’ আশ্বস্ত করল রেজা। ‘আমরা আসলে শখের গোয়েন্দা। আপনার কাছে এসেছি শুধুই হাত দেখাতে। অন্য মতলব নেই আমাদের।’
‘অ!’ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল মহিলা। ‘তাহলে আর কোনো সমস্যা নেই। আমার কাছে অনেক প্রাইভেট ডিটেকটিভ আসে। আমি তাদের নানা সাহায্য করি। দরকার হলে তোমরাও আমাকে ভাড়া করতে পারো। তোমাদের রহস্য উদ্ঘাটনে অনেক সাহায্য করতে পারব।’
‘মনে হচ্ছে আপনার সেই ক্ষমতা আছে,’ সন্দিহান সুরে বলল রেজা। ‘আপনি আমাকে আগে কখনো দেখেননি। অথচ আমার সম্পর্কে সব বলে দিলেন।’
‘আসলে পত্রিকায় আমাদের ছবি দেখেছে,’ সুজা বলল। ‘পত্রিকায় আমাদের কেসের কথা তো মাঝে মাঝেই ছাপা হচ্ছে।’
কড়া চোখে সুজার দিকে তাকাল মহিলা। চেঁচিয়ে উঠল, ‘তোমাদের নামও কোনো দিন শুনিনি আমি। যা বলেছি, আমার জাদুর ক্ষমতার জোরেই বলেছি। আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না, না? ঠিক আছে। হাত দেখা শেষ করি আগে। তারপর ঠিকই বিশ্বাস করবে।’
আবার ক্রিস্টাল বলের দিকে তাকাল মহিলা। ‘আমি মোটরসাইকেল দেখতে পাচ্ছি। দুটো মোটরসাইকেল। তোমাদের মধ্যে একজনকে পেছনে বসিয়ে আনা হয়েছে।’ আবার উত্তেজিত শোনাল তার কণ্ঠ। ‘গোয়েন্দাগিরি তোমরা আগেও বহুবার করেছ। তবে এবার তোমাদের সামনে বিপদ দেখতে পাচ্ছি আমি। ভয়ানক বিপদ!’
‘অ্যাক্সিডেন্ট?’ জিজ্ঞেস করল রেজা।
‘না। নতুন কোনো কেসে জড়িয়ে পড়বে তোমরা। দেখতে পাচ্ছি—দেখতে পাচ্ছি এক চোখো একটা লোককে। নীল চোখ। সাদা গাড়িতে চড়ে সে। খুবই বিপজ্জনক লোক। তার ধারেকাছেও যেয়ো না। লোকটার কাছ থেকে সব সময় দূরে থাকবে।’
মহিলার কণ্ঠ ভীষণ জোরালো হয়ে উঠল, চেহারা দেখে মনে হলো সমাধিস্থ হয়ে পড়েছে সে। চোখ বোজা। যেন জানে না কোথায় আছে।
‘সিলভার স্টার থেকে সাবধান!’ ফিসফিস করল সে। ‘ওখানে যেয়ো না।’
‘সিলভার স্টার কী?’ প্রশ্ন করল সুজা।
জবাব দিল না মহিলা। খামচে ধরল রেজার হাত। ব্যথা পেল রেজা।
‘এক চোখো লোকটার কাছ থেকে সাবধান!’ ভারী নিশ্বাস পড়ছে মহিলার। ‘সিলভার স্টার থেকে সাবধান! আমি...আমি সোনা দেখতে পাচ্ছি! অনেক সোনা। কিন্তু ওই সোনা অশুভ। ধরতে যেয়ো না। ধরলে...ধরলে... মৃত্যু হবে! ওই সোনাকে ঘিরে আছে মৃত্যু আর...’
হঠাৎ চোখ খুলল মহিলা। বস্ফািরিত চাহনি। রেজার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চেঁচিয়ে উঠল, ‘সিম্বু! সিম্বু আছে ওখানে! ওর কাছে যেয়ো না!’ তারপরই চোখ উল্টে দিয়ে, অজ্ঞান হয়ে কালো মখমলে ঢাকা মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে।
‘সর্বনাশ!’ চেঁচিয়ে উঠল রেজা। ‘নেড, সুজা—দেখো তো এখানে পানিটানির ব্যবস্থা আছে কি না। পানি নিয়ে এসো।’
জ্যোতিষীর জ্ঞান ফেরাতে চেষ্টা করতে লাগল রেজা। সিঙ্ক থেকে তোয়ালে ভিজিয়ে নিয়ে এল সুজা। ভেজা তোয়ালে দিয়ে তার মুখ মুছে দিতে লাগল রেজা।
‘প্রথমে ভেবেছিলাম ভঙ্গি ধরেছে,’ রেজা বলল। ‘এখন তো দেখি সত্যি সত্যি বেহুঁশ।’
‘কিন্তু মহিলা কী যেন বলছিল!’ সুজার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘হুঁশ ফিরলে জিজ্ঞেস করব,’ বলল রেজা।
কিছুক্ষণ পরে চোখ মেলে তাকাল মহিলা।
‘আপনি ঠিক আছেন তো?’ উৎকণ্ঠিত গলায় জানতে চাইল রেজা।
ধীরে ধীরে মাথা দোলাল জ্যোতিষী। ‘ভীষণ শক্তিশালী কম্পন অনুভব করছি আমি!...যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আটলান্টা ছেড়ে চলে যাও তোমরা। তোমাদের অনুরোধ করছি আমি।’
‘সিম্বুটা কে?’ রেজার প্রশ্ন।
‘কে, জানতে চাও?’ আস্তে উঠে দাঁড়াল মহিলা। ‘এসো আমার সঙ্গে।’
রেজাদের তিনজনকে নিয়ে বাইরের ঘরে এল সে।
শেলফ থেকে রেজাকে একটা বই বের করে দিল মহিলা। ‘এটা পড়ো। সিম্বু কী জানতে পারবে। না, দাম দিতে হবে না। বইটা তোমাদের এমনিই দিলাম। এখন যাও। আর কোনো দিন এদিকে এসো না। আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি, তোমাদের ভাগ্য খারাপ!’
জবাবে কিছু বলতে যাচ্ছিল রেজা, মহিলার চেহারা দেখে চুপ হয়ে গেল। ভয় ফুটে আছে মহিলার মুখে। তাতে কোনো ভণিতা নেই।
‘চলো,’ দুই সহকারীকে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল রেজা। দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। হাত নেড়ে মহিলাকে বলল, ‘গুডবাই। অ্যান্ড থ্যাংক ইউ।’
‘উফ্, বাঁচলাম!’ অদ্ভুত দোকানটা থেকে বেরিয়ে এসে যেন হাঁফ ছাড়ল নেড। ‘অভিজ্ঞতা একটা হলো বটে!’
সুজা বলল, ‘তুমিই তো ঢুকতে চাইলে।’
চিন্তিত ভঙ্গিতে ঠোঁট কামড়াল রেজা। ‘কী যেন রয়েছে ওই মহিলা আর তার দোকানের মধ্যে। আরেকটু হলেই বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম তার কথা।’
ভুরু কুঁচকাল নেড। অবাক। ‘তার মানে করোনি?’
*
হোটেলে ফিরে রেজা গেল বাথরুমে। নেড বিছানায় চিত। আর সুজা শুয়ে শুয়ে মহিলার দেওয়া বইটা পড়তে শুরু করল।
বইটা ভুডু চর্চার ওপরে লেখা।
ভুডু-তত্ত্বের জন্ম আফ্রিকায় হলেও হাইতি দ্বীপে এই রহস্যময় ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে চর্চা হয় বেশি। জাদুমন্ত্র, ঝাড়ফুঁক, নরবলি এসবের সাহায্যে কীভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করা হয়, তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে বইটাতে।
গোসল সেরে বেরিয়ে এল রেজা।
সুজা বলল, ‘জাদু করে তোমাদের যে কারও হাত এখন ভেঙে দিতে পারি আমি। এ জন্য শুধু একটা পুতুল দরকার হবে আমার। পুতুলের হাতে সুচ ঢুকিয়ে দিলে মনে হবে তোমাদের হাতেও সুচ ঢুকে গেছে। বাবারে-মারে বলে চেঁচানো শুরু করবে।’
লাফ দিয়ে উঠে বসল নেড। ‘না না, প্লিজ, এখন ওকাজটিও কোরো না ভাই! ফিরোজ আঙ্কেলের সঙ্গে ডিনারের দাওয়াতটা আগে সেরে নিই। হাতে ব্যথা থাকলে খাওয়াটা আর জমবে না।’
হেসে ফেলল রেজা আর সুজা।
‘তবে, এ বিদ্যেটাতে যদি বিশ্বাস না থাকে তোমার,’ বলল সুজা, ‘তাহলে আর কোনো ভয় নেই। তোমার ক্ষতি হবে না।’
‘অ!’ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল নেড। ‘তাহলে এটা কী আর এমন ক্ষমতা হলো। পচা জাদু।’
‘সিম্বু কী জিনিস জানতে পেরেছ?’ আলমারি থেকে পরিষ্কার একটা শার্ট বের করল রেজা।
‘ছোট, মোটাসোটা একটা পুতুলের নাম সিম্বু,’ সুজা বলল। ‘ভয়ংকর চোখজোড়া কোটর ঠেলে বেরিয়ে আছে বাইরে। এই যে ছবিও আছে।’
তার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল রেজা। সিম্বু দুই হাত শূন্যে তুলে রেখেছে। প্রতিটি হাতে দশটা করে আঙুল। পাজোড়া ফাঁক করা। পায়েও দশটা করে মোট বিশটা আঙুল। কোমরে চওড়া বেল্ট।
‘বাপরে, চেহারা বটে!’ মন্তব্য করল রেজা। ‘তা এই সিম্বুটা আসলে কে?’
‘দুর্লভ একটা চরিত্র,’ ব্যাখ্যা করল সুজা। ‘সিম্বু তার মনিবের ধনসম্পদ পাহারা দেয়। এ ধরনের পুতুল এখন পাওয়া যায় না বললেই চলে। সংগ্রাহকদের কাছে খুবই মূল্যবান বস্তু। ইদানীং সিম্বুর আদলে বেশ কিছু মূর্তি তৈরি করা হয়েছে। তবে কোনোটাই আসল সিম্বুর ধারেকাছে যেতে পারেনি।’ বইটা রেজাকে দিল ও। ‘নাও, তুমি পড়তে থাকো। আমি এই ফাঁকে গোসলটা সেরে আসি।’
রেজা বসল বই নিয়ে। নেডকে পড়ে শোনাল, ‘সিম্বুর কাজ হলো সব সময় তার প্রভুর পাশে থাকা, তাকে শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করা। কেউ সিম্বুর ক্ষতি কিংবা সে যাকে পাহারা দেয় তার ক্ষতির চেষ্টা করলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ছাড়ে।
‘একবার হাইতিতে দুটো সিম্বু পুতুল পাওয়া গিয়েছিল। মিউজিয়ামে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল ওগুলো। তারপর থেকেই ঘটতে শুরু করল অঘটন। যারা ওগুলোকে খুঁজে পেয়েছিল, রহস্যময়ভাবে ভয়ংকর মৃত্যু ঘটল তাদের। তাতেও অঘটন বন্ধ হলো না। মিউজিয়ামের পানির পাইপ বিস্ফোরিত হতে লাগল, ছাদের ভারী আস্তর খসে পড়ে কাচের বাক্স চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে শেষে যেখান থেকে পুতুল দুটো আনা হয়েছিল, ফিরিয়ে দিয়ে এল মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ। অবশেষে বন্ধ হলো দুর্ঘটনা।’
খানিক পরে নেড আর সুজাকে নিয়ে হোটেলের লবিতে চলে এল রেজা। মুরাদ সাহেব ওখানেই আছেন। রেজার হাতে একটা ব্রিফকেস। ওতে তার কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রয়েছে।
তিনজনকে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলেন মুরাদ সাহেব। রাস্তায় নেমে হাত তুলে ট্যাক্সি ডাকলেন।
‘সিলভার স্টারে যাব,’ জানালেন তিনি ড্রাইভারকে।
‘কী!’ চমকে উঠল রেজা। ‘কোথায় যাচ্ছি?’
‘এই তো কাছের একটা রেস্টুরেন্টে,’ বললেন মুরাদ সাহেব। ‘তোমাদের পছন্দ হবে। সিলভার স্টারের সি-ফুডও চমৎকার।’
আর কিছু না বলে চুপচাপ ট্যাক্সিতে উঠল রেজা, সুজা ও নেড। রেস্টুরেন্টে ঢুকে কোণের দিকে একটা টেবিল দখল করল। বিকেলের ঘটনা বাবাকে জানাল রেজা।
‘সাদা গাড়িতে চড়ে নীল চোখো লোক?’ আনমনা ভঙ্গিতে বললেন মুরাদ সাহেব। ‘এক চোখো। মনে হয় বুঝতে পারছি মহিলা কার কথা বলেছে।’
‘কার কথা?’ অবাক হলো রেজা।
‘লোকটার নাম পিয়েরে দুঁপা,’ বললেন মুরাদ সাহেব। ‘নষ্ট এক চোখ ঢেকে রাখে সাদা কাপড়ের টুকরো দিয়ে। সাদা মার্সিডিজ চালায়। ঠান্ডা মাথার ভয়ংকর এক খুনি।’
‘খাইছে!’ বলে উঠল নেড।
‘দুঁপার সঙ্গে বেশ কয়েকবার টক্কর লেগেছে আমার,’ মুরাদ সাহেব বললেন। ‘কিন্তু লোকটা বান মাছের মতো পিচ্ছিল। ওকে ধরার জন্য যতবার জাল গুটিয়ে এনেছি, ততবারই ও জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে। ওর বিরুদ্ধে ডাকাতির বহু অভিযোগ এনেছি, লাভ হয়নি। সব সময় ফসকে গেছে। মহা ধুরন্ধর এক লোক। তার কাজে যে-ই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, পথের কাঁটা দূর করতে দ্বিধা করেনি কখনোই।’
‘ওর বিশেষত্ব কী?’ জানতে চাইল রেজা।
‘অ্যান্টিক চোর,’ জবাব দিলেন মুরাদ সাহেব। ‘বিবেকবর্জিত কিছু সংগ্রাহকের কাছে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে, চড়া দামে। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে অবশ্য ওসব সংগ্রাহক তাদের সংগ্রহের প্রদর্শনী করার সাহস পায় না কখনোই। কী এক সাংঘাতিক নেশায় যেন তবু কেনে ওরা।’
‘মহিলা জ্যোতিষী সিম্বুর কথা বলেছিল,’ বলল রেজা। ‘আর সিম্বু হলো দামি অ্যান্টিক। সব খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে।’
মাথা ঝাঁকালেন মুরাদ সাহেব। কপালে ভাঁজ পড়ল। ‘কিন্তু দুঁপা কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ। সিম্বুর অভিশাপ থেকে এক শ হাত দূরে থাকার কথা তার। অবশ্য প্রচণ্ড লোভ তাকে কোন্ পর্যন্ত নিয়ে যাবে সেটা অনুমান করা কঠিন।’
‘আঙ্কেল, জ্যোতিষী মহিলা যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করল, সেগুলো কি বিশ্বাস হয় আপনার?’ জিজ্ঞেস করল নেড।
শ্রাগ করলেন মুরাদ সাহেব। ‘কে জানে! হয়তো কিছু ঘটার আভাস পেয়েছে মহিলা। বাস্তব প্রমাণ। অভিশাপ, ভবিষ্যদ্বাণী—এসব জিনিসে বিশ্বাস নেই আমার। তবে জগতে ব্যাখ্যাতীত বহু জিনিসই ঘটে। সবকিছুই হেসে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই।’
‘সিলভার স্টারে আসার পর থেকেই মনটা খচখচ করছে আমার,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুজা।
‘আমার ধারণা,’ রেজা বলল, ‘দুঁপা যতই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হোক না কেন, সিম্বুকে পাওয়ার লোভ ছাড়তে পারবে না কিছুতেই।’
রেজার কথা কানে গেল না সুজার। সে রেজার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে আছে, চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে বিস্ময়ে। সুজার দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রেজা। হাঁ হয়ে গেল মুখ।
‘ওই তো সেই লোক!’ ফিসফিস করল সে। ‘নীল চোখো লোকটা!’
মুরাদ সাহেবকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে হলো না। দুঁপা নিজেই এগিয়ে এল তাদের টেবিলের দিকে। ‘মঁশিয়ে মুরাদ, আপনাকে আবার দেখে খুব খুশি হলাম,’ তার গলার স্বর তেলতেলে, বিরস।
‘কিন্তু তোমাকে দেখে আমি খুশি হতে পারিনি, দুঁপা,’ বললেন মুরাদ সাহেব। ‘কী চাও?’
‘আপনারা আসার আগে এই টেবিলে এক বন্ধুকে নিয়ে বসেছিলাম আমি। সে একটা খাম নাকি ফেলে রেখে গেছে এখানে। খামটা কি আপনাদের চোখে পড়েছে?’
‘না, পড়েনি,’ জবাব দিলেন মুরাদ সাহেব।
‘কিছু মনে না করলে একটু উঠে দাঁড়াবেন দয়া করে?’ বলল লোকটা।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ালেন মুরাদ সাহেব। দেখাদেখি রেজারাও।
দুঁপা টেবিলের নিচে, চেয়ারের নিচে, গদির তলায় তন্নতন্ন করে খুঁজল। পেল না কিছুই। তার চেহারা কঠিন। ‘বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত, মঁশিয়ে মুরাদ। তবে খামটা আপনাদের চোখে পড়ে গেলে, দয়া করে আমাকে পৌঁছে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব। আমি জানি আপনার মতো গণ্যমান্য ব্যক্তির ওপর ভরসা রাখা চলে, কী বলেন?’
মুরাদ সাহেব কটমট করে তাকালেন দুঁপার দিকে। ‘খামটা আমরা পাইনি।’
তীক্ষ হয়ে উঠল দুঁপার কণ্ঠ। ‘আমি চাই না পুলিশ ডেকে আপনার এবং আপনার ছেলেদের সার্চ করাই।’ চেয়ারের ওপর রাখা রেজার ব্রিফকেসের দিকে ইঙ্গিত করল সে। ‘ওটাতে নেই তো?’
মুরাদ সাহেব বসে পড়েছিলেন, লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ন্যাপকিনটা টেবিলে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘আমি জানি না তোমার খামে কী আছে। তবে মনে হচ্ছে ওটা পড়তে পারলে খুশিই হবে পুলিশ। যাও, ডেকে নিয়ে এসো পুলিশকে। আমরা অপেক্ষা করছি।’
ঘোঁত ঘোঁত করে উঠল দুঁপা, বিড়বিড় করে কী যেন বলল। বোধ হয় গোয়েন্দাদের মজা দেখাবে বা এ রকম কিছু। তারপর জুতোর গোড়ালিতে ভর করে চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। চলে গেল যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে।
‘এতে কী প্রমাণ হলো?’ সুজার প্রশ্ন।
‘জ্যোতিষীর কাছে গেলে জবাব মিলতে পারে,’ ঠাট্টা করল রেজা।
‘ব্যাপারটা অদ্ভুত,’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন মুরাদ সাহেব। ‘আমার ধারণা, দুঁপা বা সিম্বুকে নিয়ে আরও ঘটনা ঘটবে।’
‘সিম্বু সম্পর্কে আর কী জানো, বাবা?’ রেজা জিজ্ঞেস করল।
‘আটলান্টা রাজ্যের অনেকেই জানে সিম্বুর কথা। গৃহযুদ্ধের আগে এই পুতুলটাকে নিয়ে একটা গুজব চালু হয়েছিল,’ মুরাদ সাহেব বললেন। ‘ধনী এক বুড়ো বাস করত এখনকার রুট থ্রি-এইটি রোডের ধারে, বিশাল এক বাড়িতে। আপনার বলে কেউ ছিল না বুড়োর। কালো চামড়ার এক চাকরকে নিয়ে থাকত বিশাল বাড়িতে। চাকরটাকে পছন্দ করত বুড়ো। চাকরটারও ছিল বুড়োর জন্য জান-প্রাণ। ভুডু ম্যাজিকে বিশ্বাস করত চাকরটা। তার মালিককেও সে ভুডু চর্চায় উৎসাহিত করে তোলে। যাহোক, গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ইউনিয়ন আর্মি হামলা চালায় দক্ষিণ এবং পুবে। বুড়ো তার ধনসম্পদের কী দশা হবে তা ভেবে খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়।’
‘খুবই স্বাভাবিক,’ মুচকি হাসল রেজা।
‘সোনার টাকা, মোহর—যা কিছু ছিল তার, সব গলিয়ে সোনার বার বানিয়ে মাটিতে পুঁতে রাখে বুড়ো। সেসব পাহারা দেওয়ার জন্য ওগুলোর সঙ্গে রেখে দেয় একটা সিম্বু পুতুল। পুতুলটা বানিয়ে দিয়েছিল তার কালো-চাকর। ইউনিয়ন আর্মিকে ঠেকাতে পাথরের দেয়ালও তুলেছিল বুড়ো। কিন্তু ঠেকাতে পারেনি। সৈন্যরা বাড়িতে ঢুকে খুন করে বুড়ো আর তার চাকরকে। তবে যত দূর জানি, সোনাদানার সন্ধান আজতক কেউ পায়নি।’
‘দারুণ গল্প!’ সুজা বলল। ‘সেই গুপ্তধনের খোঁজ করেনি কেউ?’
‘করেছে নিশ্চয়। আমি জানি না,’ জবাব দিলেন মুরাদ সাহেব। ‘তবে কেউ ওগুলোর খোঁজ পেলে মূল্যবান সিম্বু পুতুলটাও পেয়ে যাবে।’
‘তা পাবে,’ নেড বলল। ‘সেই সঙ্গে অভিশাপের শিকারও হওয়া লাগবে হয়তো।’
নীরব হয়ে গেল চারজনেই। চুপচাপ খাওয়া শেষ করল।
তারপর এয়ারপোর্টে গেল রেজা, সুজা ও নেড, মুরাদ সাহেবকে পৌঁছে দিতে। মুরাদ সাহেব নিউইয়র্কে যাবেন বিশেষ কাজে।
যাওয়ার পথে কেন যেন অস্বস্তি লাগতে লাগল রেজার। অদ্ভুত এক অনুভূতি। ট্যাক্সির রিয়ার ভিউ মিররে চোখ রেখে বলল, ‘কেউ আমাদের পিছু নিয়েছে।’
সামনের ট্রাফিক লাইটে দাঁড়াতেই চেনা গেল লোকটাকে। সাদা একটা মার্সিডিজ, রেজাদের ট্যাক্সির প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়াল। এক চোখো সেই লোকটা।
‘হয়তো ভেবেছে তার খামটা মেরে দিয়েছি আমরা!’ নিচু স্বরে বলল সুজা।
‘মনে হয়,’ চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন মুরাদ সাহেব। ‘আমাদের খুন করার ইচ্ছে থাকলেও অবাক হব না। সাবধানে থাকতে হবে। বিশেষ করে তোমাদের।... আগামী ক’দিন কি প্ল্যান তোদের, রেজা? কী করবি ভাবছিস?’
‘কোস্টের দিকে যাব। সৈকতে ঘুরে বেড়াব। দেখি, আরও কী কী করা যায়।’
‘যা-ই করিস, সাবধানে থাকিস। বলা যায় না...’
আর কয়েক মিনিটের মধ্যে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল ওরা। পিয়েরে দুঁপার টিকিটিও দেখা গেল না আর আশপাশে। বাবাকে প্লেনে তুলে দিয়ে আবার ট্যাক্সি নিল রেজা। হোটেলে ফিরে এল রেজারা। রাস্তার ওপারে দুঁপার গাড়িটা দেখতে পেল রেজা।
‘লোকটা আসলে চায় কী?’ নেডের প্রশ্ন।
‘লোকটা বোধ হয় ধরেই নিয়েছে আমরা তার খাম চুরি করেছি। তাই পিছু ছাড়ছে না,’ রেজা বলল। ‘লোকটার ওপর আমাদেরও নজর রাখতে হবে।’
ট্যাক্সি ভাড়া চুকিয়ে হোটেলে ঢুকল ওরা। রুমে এসে ব্রিফকেসটা বিছানার ওপর ছুড়ে ফেলল রেজা। ওটার দিকে তাকাতেই চোখ স্থির হয়ে গেল সুজার।
‘রেজা! ব্রিফকেসের নিচে কী যেন লেগে আছে!’ চিৎকার করে উঠল সে। ‘কী ওটা?’
একটা খাম। আটকে আছে ব্রিফকেসের তলায়।
‘আরি!’ রেজাও অবাক। ‘এটা এল কোত্থেকে!’
খামটা খুলে নিল সে। ‘বুঝতে পেরেছি। ব্রিফকেসের গায়ে কোনোভাবে লেগে গিয়েছিল চিবানো চুইয়িংগাম। তাতে আটকে গিয়েছিল খামটা। চেয়ারেই পড়ে ছিল ওটা, মিথ্যে বলেনি দুঁপা। বড়ই কাকতালীয় ঘটনা। এবং অদ্ভুত।’
‘খোলো তো দেখি!’ তাড়া দিল নেড। ‘ভেতরে কী আছে দেখার জন্য তর সইছে না আমার।’
খাম খুলল রেজা। ভেতরে জরাজীর্ণ, মলিন এক টুকরো কাগজ। তাতে অদ্ভুত কিছু কথা ছড়ার মতো করে লেখা। রেজা জোরে জোরে পড়ে শোনাল:
ভাবছ ওটা আছে হোথায়
খুঁজলে পাবে নাকো সেথায়
পাহাড় বেয়ে ওঠো মাথায়
আবার নামো নিচে
অনেক গভীর শিকড় যেথায়
পাহারা দেয় সিম্বু সেথায়
সোনা চুরির ফন্দি ছাড়ো
মানে মানে কেটে পড়ো
নইলে আছে দুঃখ অনেক
বাঁচবে নাকো কেউ!
অবাক হয়ে গেল ওরা।
‘মুরাদ আঙ্কেল যে বুড়ো লোকটার গল্প বলেছে, এটা নিশ্চয় তার কাজ।’ অবশেষে বলল নেড। ‘ওই লোক তার ক্রীতদাসের সাহায্যে সোনাদানা লুকিয়ে রেখেছিল। পাহারার ব্যবস্থা করেছিল সিম্বুকে দিয়ে।’
‘জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে,’ ফাঁকা শোনাল নেডের কণ্ঠ। ‘আমরা লোভে পড়ে গুপ্তধনের সন্ধানে বেরোলেই অভিশাপ নেমে আসবে আমাদের ওপর।’
‘দূর, তোমার অভিশাপ! কে বিশ্বাস করে?’ মুখ ঝামটা দিল সুজা।
‘যা-ই বলো, অদ্ভুত কিছু যে ঘটছে এখানে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কী বলো, রেজা?’
চিন্তিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে ফিরে তাকাল রেজা, ‘হুঁ!’
‘আমাদের এখন কী করা উচিত তাহলে?’ সুজার প্রশ্ন।
হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল রেজা। ‘ব্যাপারটার শেষ দেখে ছাড়ব। সোনা যদি পাই, পুলিশ বা কোনো চ্যারিটির হাতে তুলে দেব।’
জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল রেজা। দুঁপা ওদের দিকে নজর রাখছে কি না দেখতে পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল। ‘বৃষ্টি শুরু হয়েছে,’ জানাল সে। ‘আমাদের বন্ধুটি এখনো আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে...না না, চলে যাচ্ছে। ভেবেছে হয়তো ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আমরা কোথাও বেরোব না।’
আকাশ ফুটো করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। গাছের শাখায় ঝোড়ো হাওয়ার মাতামাতি।
‘চলো, এই সুযোগে বেরিয়ে পড়ি,’ প্রস্তাব দিল নেড। ‘রেইনকোট আছে। কাজেই ভিজতে হবে না বৃষ্টিতে। আর ক্যাম্পিংয়ের জন্য গর্ত খোঁড়ার কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছিলাম। ওগুলোও নেব সঙ্গে।’
‘প্রস্তাবটা মন্দ না,’ নিমরাজি হলো রেজা। ‘ঠিক আছে, চলো। চুপচাপ হোটেলে বসে থাকতে ভাল্লাগবে না। দেখেই আসি সিম্বুকে পাওয়া যায় কি না।’
কয়েক মিনিট পরে হোটেলের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল ওরা। এখানে ওদের বাইক রেখেছে। সাবধানে বাইকে দুটো নিয়ে উঠে এল মেইন রোডে। তাকাল এদিক-ওদিক। নাহ্, সাদা মার্সিডিজের চিহ্নও নেই কোথাও। রাস্তা প্রায় জনমানবশূন্য। গন্তব্য বুড়োর বাড়ি।
ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। একটু পরেই থেমে গেল বৃষ্টি। মেঘ সরিয়ে দিয়ে হেসে উঠল ঝলমলে চাঁদ। নদীর ধারে চলে এসেছে ওরা। নদীর পাশের সরু রাস্তায় ঢুকে পড়ল। অনেকটা পথ যাওয়ার পর চোখে পড়ল বুড়োর বাড়ি। রাস্তা মেরামতির কাজ চলছে। বড় বড় সব যন্ত্রপাতি। খানিক দূরে একটা পাথুরে দেয়াল। ঘিরে রেখেছে বুড়োর শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটাকে। মোটরসাইকেল থামাল ওরা। হেঁটে ঢুকে পড়ল গেট দিয়ে। চাঁদটাকে আড়াল করে দিতে শুরু করেছে মেঘ। বাতাস উঠছে। একটু পরেই আবার নামল বৃষ্টি।
‘বাহ্, দারুণ!’ বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠল নেড। ‘এই আসে এই যায়!’
টর্চ জ্বেলে এগোচ্ছে ওরা। বড় বড় ওকগাছের ডালে ঝুলে থাকা একধরনের শেওলার কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে যাত্রা। টর্চের আলোয় খুব কম জায়গাই আলোকিত হচ্ছে।
কানের পাশে নিশাচর পাখি তীক্ষ গলায় ডেকে উঠে দারুণ চমকে দিল ওদের। ডাকতে ডাকতে বৃষ্টির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ কোরাস ধরেছে ব্যাঙ। হাঁটু ডুবে যাওয়া গভীর জলায় নেমে পড়েছে রেজা। পায়ের নিচে পিচ্ছিল কী একটা কিলবিল করে উঠল। আঁতকে উঠল ও। এক লাফে উঠে এল তীরে।
‘কী হলো?’ জানতে চাইল সুজা।
‘সাপ!’ বিড়বিড় করল রেজা। ‘গোখরো! আরেকটু হলেই গেছিলাম।’
পুরোনো বাড়িটার কাছাকাছি এসেছে ওরা, এমন সময় মড়মড় করে একটা ডাল ভেঙে গেল। নেড দেখল ডালটা সোজা সুজার গায়ে পড়তে যাচ্ছে। সাবধান করে দেওয়ার সময় নেই। প্রচণ্ড এক ধাক্কা মারল সুজাকে। ছিটকে পড়ে গেল সুজা। বিশাল মোটা ডালটা এক সেকেন্ডের জন্য তার শিকার হারাল। ডালটার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল সুজা। ‘আরেকটু হলে আমিও গেছিলাম,’ খসখসে গলায় বলল ও।
রেজার দিকে তাকাল নেড। সিম্বু পুতুলের কারণে মিউজিয়ামে দুর্ঘটনাগুলোর কথা মনে পড়ে গেছে তার। ‘ফিরে যাবে নাকি?’
‘নাহ্? ওই তো সামনেই বাড়িটা।’
ওটাকে এখন আর বাড়ি বলা যায় না। দেয়ালগুলো শুধু খাড়া হয়ে আছে, ছাদ অদৃশ্য। এবড়োখেবড়ো মেঝে। আবর্জনা, ভাঙা কাঠ আর অন্যান্য পরিত্যক্ত জিনিসপত্রে বোঝাই মাটির নিচের ঘরটা।
‘ভাবছ ওটা আছে হোথায়, খুঁজলে পাবে নাকো সেথায়, পাহাড় বেয়ে ওঠো মাথায়, আবার নামো নিচে,’ বিড়বিড় করে ছড়াটা আওড়াল রেজা। ছোটখাটো একটা পাহাড়ের মতো টিলার মাথায় চড়ে তরাইয়ের চারপাশে চোখ বোলাল। বেশির ভাগটাই সমতল।
‘নেমে কোন দিকে যেতে হবে?’ জানতে চাইল সুজা।
‘মনে হয় বাড়ির পেছন দিকে যেতে বলেছে। চলো, দেখে আসি।’
দেখা গেল বাড়ির পেছনে মাটি ঢালু হয়ে নেমে গেছে।
‘অনেক গভীর শিকড় যেথায়, পাহারা দেয় সিম্বু সেথায়,’ এবার আবৃত্তি করল সুজা। ‘কিসের শিকড়? এদিকে কোনো বড় গাছটাছ তো চোখে পড়ছে না।’
‘রুট সেলারের কথা বলেনি তো?’ বলে উঠল রেজা। ‘ঠিক! তা-ই বুঝিয়েছে। সেলার শব্দটা ইচ্ছে করে বাদ দিয়েছে। গুপ্তধন শিকারিকে ধোঁকা দিতে। রুট মানে শিকড়। সেলার বাদ দেওয়াতে শুধু গাছপালাই খুঁজে বেড়াবে, যারা গুপ্তধন খুঁজতে আসবে। আমরাও সেই ধোঁকায় পড়েছিলাম।...আগেকার দিনে ঘরবাড়িতে রুট সেলার থাকত বলে জানতাম। লোকে শাকসবজি রাখত রুট সেলারে। তখন তো আর ফ্রিজ আবিষ্কার হয়নি।’
‘তা ঠিক,’ মাথা দোলাল সুজা। ‘প্রশ্ন হলো, রুট সেলারটা কোথায়?’
‘চলো, ওই টিলায় উঠে লাফালাফি করি,’ বুদ্ধি দিল রেজা। ‘ফাঁপা হলে শব্দ শুনেই বোঝা যাবে।’
‘কিন্তু টিলায় চড়ব কেন?’ নেডের প্রশ্ন।
‘পাহাড় বেয়ে ওঠো মাথায়, আবার নামো নিচে, বলে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে ছড়াকার,’ জবাব দিল রেজা। ‘সে জন্যই উঠব। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, ওই টিলার নিচেই কোনখানে আছে গুপ্তধন।’
পাহাড়ের গায়ে লাফালাফি করতে গিয়ে কাদা মেখে ভূত হয়ে গেল তিনজনেই।
ঘণ্টা খানেক এভাবেই চলল। হঠাৎ নেড বলে উঠল, ‘দাঁড়াও। দাঁড়াও। এখানে ফাঁপা একটা আওয়াজ শুনেছি। খুঁড়ে দেখা যাক।’
পরের আধঘণ্টা নিবিষ্ট মনে মাটি খুঁড়ে চলল তিনজনে। পরিশ্রমের ফল মিলল অবশেষে। মাটি সরে বেরিয়ে এল কাঠ। আধপচা কাঠে শাবল দিয়ে বার কয়েক গুঁতো মারতেই ভেঙে গেল। টর্চের আলোয় একটা গর্ত দেখতে পেল ওরা। বারো ফুটমতো গভীর। খালি গর্ত।
গুঙিয়ে উঠল নেড। ‘খামোখাই এত খাটলাম!’
‘এক মিনিট,’ বলল রেজা। ‘এখানেই কোথাও আছে। নইলে এত খাটতে যেত না বুড়ো। রুট সেলারের কাঠের মেঝের নিচেই রেখেছে সোনার বারগুলো।’
সঙ্গে করে আনা টুল কিট থেকে রশি বের করল রেজা। রশির এক মাথায় হুক লাগিয়ে মাটিতে গাঁথল। রশি বেয়ে প্রায় বারো ফুট নিচে নেমে এল। মেঝেতে আবার ঠুকতে শুরু করল ফাঁপা আওয়াজ শোনার আশায়। এবার বেশিক্ষণ পরিশ্রম করতে হলো না। শুনতে পেল প্রত্যাশিত শব্দটা।
কুঠুরির কাঠের তক্তা ভেঙে খুলে ফেলেছে ওরা, এ সময় রুট সেলারে ঢুকতে শুরু করল বৃষ্টির পানি। পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দেওয়ার জন্যই যেন ওপরের একটা গর্তে জমা পানিও উপচে গিয়ে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল সেলারে।
দেখতে দেখতে গোড়ালি ডুবে গেল ওদের। ক্রমেই বাড়ছে পানি।
‘এখানে থাকলে তো দেখছি ডুবে মরব,’ মুখ অন্ধকার হয়ে গেছে সুজার। ‘জ্যোতিষীর কথাই শেষ পর্যন্ত ফলে যাবে মনে হচ্ছে!’
‘সত্যি চলে যেতে চাইছ?’ জিজ্ঞেস করল রেজা।
‘দেখি আরেকটু,’ গুপ্তধন পাওয়ার আশা রেজার মতোই ছাড়তে পারল না সুজাও।
দেয়ালের আরেকটা তক্তা খুলে আনল নেড। পাহাড়ের গায়ে একটা সুড়ঙ্গ চোখে পড়ল। উচ্চতায় পাঁচ ফুটেরও কম। ওপরের দিকে উঠে গেছে সুড়ঙ্গটা। ফলে পানি ওটার নাগাল পাবে না।
‘বুড়ো এটা তৈরি করে রেখে গেছে,’ বলল রেজা। ‘জানত, বৃষ্টি হলে পানি ঢুকতে পারে। তাই এমন জায়গায় বানিয়েছে, যাতে পানি না জমে।’
মাথা নিচু করে সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে পড়ল ওরা। দশ ফুট যাওয়ার পরে বাঁ দিকে মোড় নিল। ধীরে ধীরে এগোতে লাগল হামাগুড়ি দিয়ে।
কড়াৎ করে বাজ পড়ল। এবং ঠিক ওই মুহূর্তে অযাচিতভাবে সিম্বুর মুখোমুখি হলো ওরা। একটা লোহার সিন্দুকের ওপর চুপ করে বসে রয়েছে ছোট্ট মূর্তিটা। হাঁ করে তাকিয়ে রইল তিনজনেই।
সিন্দুকে কি বারগুলো আছে?—সবার মনেই খেলে গেল একই প্রশ্ন।
‘বাক্সটা খুলব?’ ফিসফিস করে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল রেজা।
‘কি-কি-ক্কিন্তু, সিম্বুর অভিশাপ...’ ভয়ে কথা শেষ করতে পারল না নেড।
‘বাক্সটা খুললে যদি...!’ সুজাও ভয় পাচ্ছে।
সিম্বুর কদাকার ছোট্ট মুখটার দিকে তাকিয়ে ভয় লাগছে ওদের। ফিসফিস করে বলল রেজা, ‘সিম্বু, আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি। তোমার সোনা চুরি করার ইচ্ছেও আমাদের নেই। আমরা শুধু দেখতে চাই বাক্সের ভেতরে সোনাগুলো আছে কি না।’
আস্তে করে মূর্তিটা এক পাশে সরিয়ে রাখল রেজা। বাক্স খোলার চেষ্টা করল। খুব মজবুত তালা। ওদের কাছে এই তালা খোলার যন্ত্র নেই।
‘এখন কী করা?’ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে রেজার দিকে তাকাল সুজা। ‘সিম্বুকে নিয়ে যেতে পারি আমরা...’
কথা শেষ হলো না তার। বিকট শব্দে বাজ পড়ল আবার।
‘রুট সেলারে পানি জমছে জানা কথা,’ রেজা বলল। ‘বেশি দেরি করলে ভরে যাবে। বেরোনোর উপায় থাকবে না আমাদের। তার চেয়ে চলো এখন চলে যাই। কাল বৃষ্টির পানি নেমে গেলে আবার আসা যাবে। তালা খোলার যন্ত্র নিয়ে আসব কাল।’
‘ঠিক বলেছ,’ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল নেড। স্বস্তি পেল সিম্বুর প্রহরায় রাখা সোনা দেখতে গিয়ে তাকে রাগিয়ে দিতে হলো না বলে।
প্যাসেজওয়ে ধরে পিছিয়ে এল ওরা। রুট সেলারে ঢুকল। পানিতে থই থই করছে সেলার।
‘গর্ত থেকে পানি সরানোর ব্যবস্থা করতে না পারলে সকালের মধ্যে সেলার পুরো ডুবে যাবে,’ নিচের দিকে তাকিয়ে বলল রেজা।
শাবল দিয়ে খুঁচিয়ে সেলার থেকে পানি সরে যাওয়ার জন্য একটা মুখ তৈরি করল ওরা। সেলারের ছাদ যাতে ভেঙে ধসে পড়তে না পারে, সে জন্য তক্তা দিয়ে আটকে রাখার ব্যবস্থা করল।
কাজ শেষ করে রেজা বলল, ‘চলো, যাওয়া যাক।’
দড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল ওরা। মোটরসাইকেলে চড়ে হোটেলে ফিরল। দুঁপার সাদা মার্সিডিজটা দেখতে পেল না কোথাও।
ঘণ্টা খানেক পর অপ্রত্যাশিত একটা ফোন এল। রেজার আম্মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। অপারেশন লাগবে।
বাবাকে খবর পাঠাল রেজা। তক্ষুণি বাড়ি যেতে তৈরি হলো।
কয়েক মাস পর আবার আটলান্টায় আসার সুযোগ পেল ওরা। তত দিনে ওদের মা ভালো হয়ে গেছেন।
তবে ফিরে এসে দেখে সিম্বুর টিলাটার চিহ্নও নেই আর। ওটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে তার ওপর দিয়ে চলে গেছে চকচকে হাইওয়ে।
আফসোস করে রেজা বলল, ‘এত কষ্ট করেও সিম্বুর গুপ্তধন দেখতে পারলাম না!’
মাথা দুলিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল সুজা, ‘হুঁ, কোনো দিন আর পারবও না!’