চাঁদের সঙ্গে ক্যাম্পফায়ার

কুয়াশা, পাহাড়, নদী আর চাঁদ—সব মিলিয়ে বেশ অদ্ভুত একটা পরিবেশ। হুট করে ঘোর ধরিয়ে দেয়। ধরিয়ে দেয় ভয়ও। মাচায় শুয়ে চাঁদ দেখতে দেখতে হুট করে মনে হলো সামনের গাছটার সঙ্গে যে কায়াক নৌকাগুলো বাঁধা ছিল, সেগুলো নেই। এতক্ষণ ধরে এখানে বসে আছি, কাউকে দেখলামও না। তন্ময়কে বললাম, সে-ও বেশ অবাক হলো। এখানকার বাঁধা নৌকাগুলো আসলেই হাওয়া! এই রাতের বেলা ভূতের খেলা শুরু হলো কি না কে জানে। বেশ ঠান্ডা এখানে, তা–ও ঘামছি।

চাঁদের আলোয় ক্যাম্পিংয়ের আইডিয়া আমাদের সামনে পেশ করে তোহা। সব সময়ের মতো বিশাল প্ল্যান আর একগাদা উৎসাহী জনতা নিয়ে পূর্ণিমার রাতে শুরু হয় ক্যাম্পিংয়ের তোড়জোড়। অন্যদের উৎসাহ দেখে তোহা আর লোরকা হেসেই অস্থির। কারণ, আমরা ৩ জন এবারও নিশ্চিত ছিলাম, শেষমেশ এই অত্যুৎসাহী ১০–১২ জনের দল থেকে সর্বোচ্চ ৫–৬ জন থাকবে। তাই বলে তো পরিকল্পনা আটকে থাকতে পারে না। এযাবৎকালের সব ভ্রমণে তোহা আমাদের গাইড এবং অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে আসছে। এদিকে যতই সময় এগিয়ে আসছে, সবার সঙ্গে সময় মিলিয়ে কোনোভাবেই ক্যাম্পিংটা আর পূর্ণিমার রাতে ফেলা যাচ্ছে না। অমুকের ক্লাস তো তমুকের পরীক্ষা। আস্তে আস্তে আমাদের যাত্রার সময় এগিয়ে আসে আর গ্রুপ থেকে একজন একজন করে ঝরে পড়ে। শেষমেশ একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, রাঙামাটির বাসে আটজনের একটা দল কাপ্তাইয়ের পথে রওনা দিয়ে দিয়েছে। যাত্রার শুরুতেই মুঠোফোনটা ছিনতাইয়ের হাত থেকে বেঁচে যায়। ছিনতাইকারী মুঠোফোন না নিতে পেরে শখের ইয়ারফোন ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেছে। মনটন খারাপ করে বাসে বসে ছিলাম। রাতের অন্ধকার আকাশে হাজার হাজার তারা। এরই মাঝে কথা নেই বার্তা নেই, বাস রোলার কোস্টারের মতো একবার ডানে যায়, একবার বায়ে। মাঝে মাঝে গাছের ডালপালা জানালায় লেগে ছিটকে গায়ে এসে পড়ছে। পেছন থেকে এক ভদ্রমহিলা ফিলিংসের বারোটা বাজিয়ে বকা দিয়ে উঠলেন, ‘এই, জানালা বন্ধ করো।’ শেষরাতের দিকে গিয়ে যখন পৌঁছালাম, দেখি স্থানীয় লোকজন এই অন্ধকারেও বাজার বসিয়ে ফেলেছে। কারও হাতে বিশাল কচু, কারও হাতে পাহাড়ি সবজি, আবার কারও কাঁধে বড়সড় পাহাড়ি শূকর।

বাস এরপর আরও ২০ মিনিট নাচানাচি করে আমাদের নামিয়ে দিল বনরূপায়। সেখান থেকে কাপ্তাই হ্রদ দেখা যায়। হ্রদের ওপর সেই সূর্যের প্রতিফলন—সে এক অসাধারণ দৃশ্য। কাপ্তাইয়ের ওপাশে বড় বড় পাহাড় দেখা যাচ্ছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে সময় চলে গেল, টেরও পাইনি। তোহা আগে থেকেই স্থানীয় এক কেউকেটার সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের সারা দিন লেকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য নৌকা ঠিক করে ফেলেছে। তোহাকে আমরা এমনিতে কেউ দাম দিই না। তবে ওর সুবাদে বনরূপার স্থানীয় বাজারটা ঘুরে দেখা হয়ে গেল।

‘আমি যেকোনো দেশে গেলেই দুটি জিনিস দেখি, একটা কাঁচাবাজার, অন্যটা বইয়ের দোকান। আমার মনে হয় কাঁচাবাজার আর বইয়ের দোকান সম্ভবত সমাজের অবস্থার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নির্দেশক।’—জ্ঞানতাপস জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের এই কথার মর্মোদ্ধার করতেই কাঁচাবাজারে ভ্রমণ আমাদের। এরপর ঘাটে গিয়ে নৌকা দেখে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। হ্রদের সবুজ পানি, নীল আকাশ আর দূরে বিশাল পাহাড়। নৌকাই আমাদের নিয়ে গেল রাজার বাড়ি। আমরা এখানকার বৌদ্ধমন্দির দেখতে গেলাম সবাই মিলে। এখানে ছোট কিছু দোকান আছে স্থানীয় লোকজনের। তাঁতে তৈরি কাপড় বিক্রি করেন তাঁরা। এসব দেখে ফ্লোরা পাগলপ্রায় হয়ে ওঠে। বেশ কয়েকটা জামাকাপড় কিনে ফেলছে দেখে ওকে পটিয়ে লোরকাও জামা কেনার কথা ভাবছিল।

‘আমি যেকোনো দেশে গেলেই দুটি জিনিস দেখি, একটা কাঁচাবাজার, অন্যটা বইয়ের দোকান। আমার মনে হয় কাঁচাবাজার আর বইয়ের দোকান সম্ভবত সমাজের অবস্থার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নির্দেশক।’

কিন্তু বিশাল আকারের কোনো জামা পাওয়া গেল না। এমন সময় ফোন করল আমাদের বন্ধু ইগিমি। রাঙামাটি থাকে। এমনিতেই খিদেয় আমাদের পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। ওর দাওয়াত পেয়ে মনে হলো হাতে চাঁদ পেয়ে গিয়েছি। ওর বাড়ি ভেদভেদিতে। আমরা তখনো নৌকায়। তোহা জানাল, এখানে চাং পাই নামের রেস্তোরাঁ আছে। সেখানে খাবারের কথা বলে গেলাম ঝর্না দেখতে। হামহাম দেখার পর ছোট ঝর্নাগুলোকে বেশি ছোট মনে হয়। আগেরবার অর্ধেক গিয়ে পালিয়ে যাওয়া আলিফ কিছুটা অনুশোচনা নিয়েই ঝর্না দেখে এল। এরপর সেই চাং পাইয়ে গিয়ে দেখি, খাবারদাবার প্রায় প্রস্তুত। ইগিমির বাসায় পেটভরে খাব বলে এখানে কম করে অর্ডার করা হয়েছিল। কিন্তু ব্যাম্বু চিকেন আর কাচকি মাছ ভাজা খেয়ে মনে হলো, অর্ডার বেশি দেওয়া উচিত ছিল। আফসোস!

ঝুলন্ত ব্রিজ কেন ঝোলে না, এই নিয়ে তর্ক করতে করতে আমরা চলে গেলাম ইগিমির বাসায়। ইগিমিদের বাড়ি ছবির মতো সুন্দর। বাইরে ফুলের বাগান, সেই ফুলে দুয়েকটা প্রজাপতিও দেখা গেল। ছোটবেলায় গ্রামের দৃশ্য আঁকার সময় ছাড়া এ ধরনের বাড়ি চিন্তা করেছি বলে মনে হয় না। বাড়ির ভেতরটাও সুন্দর। সবচেয়ে মজার বিষয়, বাইরে কিছুটা গরম থাকলেও ভেতরটা বেশ ঠান্ডা। বাতাস চলাচলের জন্য ছোট ছোট ফুটো করে রাখা। খাওয়াদাওয়ার পর্ব আসতেই দেখা গেল এলাহি কাণ্ড!

আমাদের জন্য ইগিমিরা এমন কিছু নেই, যা তৈরি করেনি। আর খাবারদাবার এত সুস্বাদু যে কোনটা রেখে কোনটা খাব, সেটা চিন্তা করতেও বেশ সময় লেগে যাচ্ছিল। ইগিমিদের সঙ্গে এরপর কাপ্তাইয়ে সূর্যাস্ত দেখে আমরা আমাদের বাক্সপেটরা নিয়ে চলে এলাম কাঙ্ক্ষিত স্থানে, যার জন্য এই রাঙামাটি আসা। আমাদের ক্যাম্পিংয়ের জায়গা কর্ণফুলীর পাড়ে ছবির মতো ছোট্ট একটা স্পট—‘কাপ্তাই প্রশান্তি পার্ক’। তাঁবুর জোগাড় করে রেখেছিলাম, যদিও আমরা কেউ আগে তাঁবু টানাইনি। বহু কষ্টে তাঁবু টানিয়ে খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ করে আগুন জ্বালিয়ে বসলাম সবাই। লোরকা ভালো গিটার বাজায়, গানও গায় সুন্দর। গলা মিলিয়ে গাইতে গাইতে কখন যে আমাদের আগুন নিভে গেছে টেরও পাইনি। আগুন নিভে যাওয়াতে ভালোই হয়েছে। আকাশের চাঁদ একেবারে মাথার ওপর এসে থেমেছে। পরের রাতে পূর্ণিমা। তার আগেই সমস্ত রূপ নিয়ে চাঁদ হাজির। আমরা নেমে নদীর পাড়ে মাচায় গিয়ে বসলাম। বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ কুয়াশা এসে পাহাড় ঢেকে দিচ্ছে, আবার চলে যাচ্ছে, চাঁদ সরে যাচ্ছে। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখছি। এর মাঝে প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়েই হয়তো তন্ময় বাবা গো মা গো বলে চেঁচিয়ে উঠছে বারবার। তখনই দেখলাম গাছের সঙ্গে বাঁধা কায়াকগুলো হাওয়া! সবাই ভয় পেয়ে ভাবছি, আরে এগুলা কই! এখানেই তো ছিল!

আমাদের তাঁবু

আবার দেখি কখন যেন সামনে এসে পড়েছে, পরমুহূর্তেই হাওয়া! এরপর খেয়াল করলাম যে আমরা তো নদীর পাড়ে, বিশাল গাছের পেছনে। স্রোতের কারণে গাছের সঙ্গে কায়াকগুলোর লুকোচুরি বোঝাও যাচ্ছিল না। অন্ধকারে লাল–হলুদ নৌকাগুলোর খেলা এই আরামের মাঝেও ভয় ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। তারপর কখন যে মাচায় ঘুমিয়ে গিয়েছি, টেরও পাইনি। সকালবেলা উঠে শুরু হলো আফসোস। এত টাকাপয়সা দিয়ে তাঁবু ভাড়া করে মাচায় ঘুমালাম! টাকার কথা থাক, এত নাটক–সিনেমা করে তাঁবু খাটালাম, সেখানে কেউই ঘুমাল না? এটা আসলেই আফসোসের বিষয়।

এই ক্যাম্পিং স্পটে কর্ণফুলীর জলে কায়াকিংয়েরও ব্যবস্থা আছে। সকাল সকাল কায়াক নিয়ে নেমে গেলাম সবাই। এরপর ফ্রেশ হয়ে বাসায় ফেরার পালা। এ পর্যন্তই ছিল পরিকল্পনা। তন্ময় হুট করে বলে বসল, পরদিন প্রবারণা পূর্ণিমা। দিনটা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বেশ ঘটা করে পালন করেন। এসেই যখন পড়েছি, একটা রাত বেশি থেকে গেলে এমন কীই–বা হবে। সবাইকে যখন প্রায় রাজি করিয়ে আনা হয়েছে, তখন সেই আলিফ আবার বেঁকে বসল। তার নাকি আগামীকাল কী এক কম্পিটিশন। আমরা নিজেরাও ক্লাস পরীক্ষা বাদ দিয়ে আরেক রাত থাকার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু আলিফকে কোনোভাবেই রাখা গেল না। আগেরবারের মত শেষ মুহূর্তে এসে আমাদের রেখেই চলে গেল সে।

তাতে কি আর আমাদের ঘোরাঘুরি থামে? আমরা এলাম চট্টগ্রামে। এদিক–সেদিক ঘোরাঘুরি শেষে রাতের বেলা সবাই মিলে চলে গেলাম ডিসি হিলে। হাজার হাজার মানুষ মিলে ফানুস ওড়াচ্ছে এখানে। বিশাল আকারের রংবেরঙের ফানুস। হঠাৎ দেখি বাতিঘর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী দীপংকরদা এসে হাজির। তিনি আমাদের শহর ঘুরিয়ে দেখিয়ে নিয়ে এলেন বীর চট্টলায়, চট্টগ্রামের খাবার খাওয়াতে। তোহা কানে কানে বলল, এবার নাকি বাতিঘর থেকে কেনা বইয়ের দাম উসুল করে ছাড়বে। মুরগি আর হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খেতে খেতে ভাবছিলাম, পরদিন আবার ঢাকায় ফিরে যেতে হবে! একটু কষ্টও পাচ্ছিলাম। তখন তোহা বলল, আমরা নাকি শিগগিরই আবার বনজঙ্গল–পাহাড়ে ঘুরতে যাব। শুনে আমরা নতুন উদ্যমে খাওয়া শুরু করলাম।