ইউক্রেনের এক গাঁয়ে থাকত এক গরিব লোক, নাম টোডি। শাইনডেল নামে তার এক বউ ছিল আর ছিল সাতটা বাচ্চা। তাদের ঠিক ঠিক খাওয়ানোর মতো পয়সাপাতি তার কখনোই হলো না। অনেক ব্যবসাই করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সবই ব্যর্থ। লোকে বলে, টোডি যদি ঠিক করে মোমবাতির ব্যবসা করবে, তাহলে সূর্যই আর ডুববে না। তারা তার নাম দিয়েছিল চালবাজ টোডি, কারণ তার যা-কিছু আয়-রোজগার, সবই জালিয়াতি করে।
এবার শীত পড়েছে জবর। তুষারপাতও হচ্ছে বেশি। চুল্লির লাকড়ি কেনার পয়সাটা পর্যন্ত টোডির নাই। গরম থাকার জন্য দিনভর বিছানাতেই থাকে তার সাত ছেলেমেয়ে। বাইরে যখন বরফ পড়ে, ক্ষুধাও বেড়ে যায় চড়বড় করে। কিন্তু শাইনডেলের ভাঁড়ার তো খালি। চড়াগলায় সে টোডিকে বকাঝকা করে, ‘বউবাচ্চাকেই যদি খাওয়াতে না পারো, তাহলে বিয়ে করেছিলে কেন? আমি পুরুতের কাছে যাব, তালাক নেব।’
‘তালাক দিয়ে কী করবি, শুনি? খাবি?’ গজগজ করে টোডি।
এই গাঁয়েই থাকে এক ধনী, নাম লাইজার। কৃপণ স্বভাবের জন্য তার নামই হয়ে গিয়েছিল কিপ্টা লাইজার। প্রতি চার সপ্তাহে একবার মাত্র বউকে রুটি সেঁকতে দেয় ও, কারণ সে আবিষ্কার করেছে বাসি রুটির চেয়ে তাজা রুটি খাওয়া হয় বেশি।
গুটিকয় স্বর্ণমুদ্রা ধার করতে বেশ কয়েকবার লাইজারের কাছে গেছে টোডি। প্রতিবারই জবাব দিয়েছে লাইজার, ‘তোমার পকেটের বদলে আমার সিন্দুকে টাকা থাকলে আমার ভালো ঘুম হয়।’
লাইজারের একটা ছাগল আছে, জীবনে ওটাকে কিছু খেতে দেয় না। প্রতিবেশীদের বাড়িতে যাওয়া শিখে গেছে ওটা, তারাই দয়া করে ওটাকে আলুর খোসা দেয়। যথেষ্ট খোসা না পেলে কখনো কখনো চালা থেকে পুরোনো খড় টেনে ছিঁড়ে খায়। গাছের বাকলও পছন্দ। তারপরও প্রতিবছর একটা করে বাচ্চা দেয় ছাগলটা। লাইজার দুধ দোয়ায় ঠিকই, কিন্তু কিপ্টুস তো, নিজে না খেয়ে অন্যের কাছে বিক্রি করে।
টোডি ঠিক করল, লাইজারকে একটা উচিত শিক্ষা দেবে, পাশাপাশি নিজের জন্য দরকারি কিছু টাকাও বাগিয়ে নেবে।
একদিন বাক্সে বসে ঝোলে ভিজিয়ে রুটি খাচ্ছে লাইজার (গদি ক্ষয়ে যাবে, এই ভয়ে ছুটির দিন ছাড়া অন্য দিন সে চেয়ারে বসে না), এমন সময় দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল টোডি।
‘রেব লাইজার,’ সে বলল, ‘একটা আরজি ছিল। আমার বড় মেয়ে বাশার বয়স তো পনেরো হয়ে গেল। শিগগিরই তার বাগদান হবে। জানেভ থেকে তাকে দেখতে আসছে এক ছেলে। আমার ছুরি-কাঁটা সব আবার টিনের। টিনের চামচ দিয়ে ছেলেকে স্যুপ পরিবেশন করতে আবার বউয়ের ভীষণ আপত্তি। আপনার একটা রুপার চামচ যদি একটু ধার দিতেন। দিব্যি গিলে বলছি, কালই ফেরত দেব।’
লাইজার জানত পবিত্র শপথ ভাঙার সাহস টোডির হবে না। তাই চামচটা তাকে ধার দিল।
ওই সন্ধ্যায় বাশাকে দেখতে কোনো ছেলেই এল না। যথারীতি খালি পায়ে আর ছেঁড়া কাপড়ে এখানে–সেখানে ঘুরে বেড়াল সেই মেয়ে। টোডির জামার তলেই পড়ে রইল সেই রুপার চামচ। বিয়ের প্রথম দিকে টোডিরও কিছু রুপার বাসনকোসন হয়েছিল। বহু আগেই তার প্রায় সবই বিক্রি করে দিয়েছে টোডি, আছে খালি তিনটা রুপার চামচ। পরবের সময় বের করা হয় শুধু।
পরদিন খালি পায়ে (জুতা বাঁচাতে) বাক্সে বসে ঝোল দিয়ে শুকনো রুটি খাচ্ছে লাইজার, আবার উদয় হলো টোডি।
‘গতকাল যে চামচটা নিয়েছিলাম, এই যে—’ বলে নিজের একটা চামচসহ ওটা টেবিলে রাখল।
‘এই চা-চামচটা আবার কেন?’ জানতে চাইল লাইজার।
তখন টোডি বলল, ‘আপনার টেবিল চামচ এই চা-চামচটার জন্ম দিয়েছে। এটা ওর বাচ্চা। আমি সাচ্চা মানুষ, তাই মা–বাচ্চা দুটোকেই ফেরত দিচ্ছি।’
অবাক হয়ে টোডির দিকে তাকিয়ে রইল লাইজার। একটা রুপার চামচ আরেকটা চামচের জন্ম দিয়েছে—এমন কথা সে কস্মিনকালে শোনেনি। যাহোক, লোভের কাছে সন্দেহ হার মানল। সানন্দে দুটো চামচই সে গ্রহণ করল। কী অভাবনীয় সৌভাগ্য! ভাগ্যিস টোডিকে চামচটা ধার দেওয়া হয়েছিল।
কয়েক দিন পর লাইজার খালি গায়ে (কোট বাঁচাতে) বাক্সে বসে সেই শুকনো রুটি ঝোলে ভিজিয়ে খাচ্ছে, দরজা খুলে গেল, ঘরে ঢুকল টোডি।
‘জানেভের ছেলেকে বাশারের মনে ধরেনি, তার কানগুলো নাকি গাধার মতো। আজ সন্ধ্যায় তাকে দেখতে আসবে আরেক ছেলে। তার জন্য স্যুপ রান্না করছে শাইনডেল। কিন্তু টিনের চামচ দিয়ে স্যুপ পরিবেশন করতে তার ভীষণ লজ্জা। আপনি কি আমাকে—’
কথা শেষ করার আগেই তাকে থামিয়ে দিল লাইজার। ‘একটা রুপার চামচ ধার চাও তো? নিশ্চিন্তে নিয়ে যাও।’
পরদিন আবারও নিজের একটা রুপার চা-চামচসহ চামচটা ফেরত দিল টোডি। আবারও ব্যাখ্যা করল, রাতে বড় চামচটা একটা ছোট চামচ জন্ম দিয়েছে। নিজের কাছে পরিষ্কার থাকতে তাই নবজাতকসহ মাকে ফেরত দিয়ে যাচ্ছে। আর বাশারকে দেখতে এসেছিল যে ছেলেটা, তাকেও পছন্দ হয়নি মেয়ের, তার নাকটা নাকি এত লম্বা যে থুতনি ছুঁয়েছে। বলাই বাহুল্য, যারপরনাই খুশি হলো কিপ্টা লাইজার।
তৃতীয়বারও একই ব্যাপার ঘটল। টোডি জানাল, পাত্র তোতলা—এই দোষে এবার পাত্রকে ফিরিয়ে দিয়েছে মেয়ে। সে আরও জানাল যে আবারও একটা বাচ্চা বিইয়েছে লাইজারের রুপার চামচ।
‘এমন কি কখনো হয়েছে, একটা চামচের যমজ বাচ্চা হয়েছে?’ জানতে চাইল লাইজার।
বিষয়টা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল টোডি। ‘কেন হবে না? এমনও শুনেছি, তিনটা পর্যন্ত বাচ্চা দিয়েছে একটা চামচ।’
তারপর প্রায় এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল, লাইজারের কাছে এল না টোডি। শুক্রবার সকালে বাক্সে বসে ঝোল আর শুকনো রুটি খাচ্ছে লাইজার (প্যান্টটা বাঁচাতে পরনে শুধু জাঙিয়া), টোডি এসে বলল, ‘শুভদিন রেব লাইজার।’
‘তোমাকেও অনেক অনেক শুভদিন,’ বন্ধুর গলায় জবাব দিল লাইজার। ‘তুমি কি রুপার চামচ ধার নিতে এসেছ? যদি তা-ই হয় তো, নিয়ে যাও।’
‘আজকে একটা বিশেষ আবদার নিয়ে এসেছি। আজ সন্ধ্যায় লুবলিন নগরী থেকে বাশাকে দেখতে আসবে এক ছেলে। বিরাট ধনীর ছেলে। ছেলে শুনেছি চালাকচতুর, দেখতে-শুনতেও ভালো। আর যেহেতু শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই থাকবে, তাই খালি রুপার চামচেই হবে না, এবার একজোড়া রুপার মোমদানিও লাগবে। আমারগুলো আবার কাঁসার কিনা। ওগুলো টেবিলে রাখতে লজ্জা পাচ্ছে বউ। আপনার মোমদানি জোড়া ধার পাওয়া যাবে কি? সাবাথের ঠিক পরপরই ফেরত দেব।’
ইতস্তত করতে লাগল লাইজার, মোমদানি তো বড় দামি জিনিস। কিন্তু চামচগুলোর বরাতের কথা মনে পড়তেই বলল, ‘বাড়িতে আটটা রুপার মোমদানি আছে, সব কটিই নিয়ে যাও। জানি কথামতো সব কটিই ফেরত দেবে তুমি। আর ওগুলোর কোনোটার যদি বাচ্চা হয়, সন্দেহ নেই, এবারও আগের মতোই সততার পরিচয় দেবে তুমি।’
‘নিশ্চয়ই,’ আশ্বাস দিল টোডি। ‘ভালো কিছু আশা করতে দোষ কি!’
যথারীতি রুপার চামচটা নিজের জামার নিচেই লুকিয়ে রাখল টোডি। কিন্তু মোমদানিগুলো নিয়ে সোজা বেনের কাছে চলে গেল, সেগুলো ভালো দামে বিকোল। তারপর টাকাটা নিয়ে শাইনডেলকে দিল। কোথা থেকে এই ধনরত্ন এল, এত টাকা দেখে জানতে চাইল ও।
‘একটা গরু উড়ে এসে আমাদের ছাদের ওপর এক ডজন রুপার ডিম পাড়ল,’ টোডি জানাল। ‘ওগুলো বিক্রি করে দিলাম। আর এই হচ্ছে সেই টাকা।’
‘জীবনে শুনিনি, উড়ে এসে ছাদে রুপার ডিম পাড়ে গরু,’ সন্দেহ প্রকাশ করল শাইনডেল।
‘সবকিছুরই একটা প্রথম আছে,’ জবাব দিল টোডি। ‘টাকাটা না চাও তো ফেরত দিতে পারো।’
‘ফেরত দেওয়ার তো কথা হচ্ছে না,’ বলল শাইনডেল। তার ভালো করেই জানা আছে, তার স্বামীর মাথাভর্তি ধূর্তামি আর চালিয়াতি। আর বাচ্চারা যখন উপোস আর ভাঁড়ারও শূন্য, তখন এত সব প্রশ্ন না তোলাই ভালো। বাজারে গিয়ে মাছ, মাংস, ময়দা মায় পুডিংয়ের জন্য বাদাম আর কিশমিশ পর্যন্ত কিনল শাইনডেল। তারপরও যখন টাকা রয়ে গেল, বাচ্চাদের জন্য জুতা আর কাপড় কিনল।
টোডির বাড়িতে সেটা ছিল আনন্দ উচ্ছল এক সাবাথ। ছেলেরা গাইল, মেয়েরা নাচল। এত টাকা কোথায় পেয়েছ, বাচ্চারা জানতে চাইলে বাবা বলল, ‘সাবাথের সময় টাকার কথা বলা নিষেধ।’
শুক্রবার লাইজার (কাপড়-জুতা বাঁচাতে প্রায় উদোম ও খালি পা) বাক্সে বসে ঝোল দিয়ে সবে এক টুকরো শুকনো রুটি শেষ করেছে, এমন সময় টোডি এসে হাজির। রুপার চামচটা ফেরত দিয়ে বলল, ‘কপাল খারাপ, এবার কোনো বাচ্চাই দেয়নি আপনার চামচ।’
‘আর মোমদানিগুলোর কী হলো?’ উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইল লাইজার।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল টোডি। ‘মোমদানিগুলো মরে গেছে।’
বাক্স থেকে এমন বেমক্কা উঠে দাঁড়াল লাইজার যে ঝোলের প্লেটটাই উল্টে পড়ল।
‘ব্যাটা গাধা! মোমদানি আবার মরে কী করে?’ চিত্কার করে জানতে চাইল সে।
‘চামচ যদি জন্ম দিতে পারে, তাহলে মোমদানিও মরতে পারে।’
অনেক হই–হল্লা করল লাইজার। পুরুতের সামনে টোডিকে হাজির করল। উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনে হাসিতে ফেটে পড়লেন পুরুত। ‘উপযুক্ত সাজা হয়েছে,’ লাইজারকে বললেন তিনি। ‘চামচ বাচ্চা দেয়, এটা যদি বিশ্বাস না করতে, তাহলে এখন তোমাকে মোমদানি মরে গেছে, এই কথাটা বিশ্বাস করতে হতো না।’
‘কিন্তু এসব আবোলতাবোল কথার তো কোনো মানে হয় না,’ আপত্তি জানায় লাইজার।
‘তুমি কি আশা করোনি, মোমদানি আরও মোমদানির জন্ম দেবে?’ ভর্ৎসনার গলায় জানতে চান পুরুত। ‘লাভের বেলায় আবোলতাবোল মেনে নিতে পারলে লোকসানের সময়ও মেনে নিতে হবে,’ বলে তিনি মামলা খারিজ করে দিলেন।
পরদিন বউ যখন কিপ্টা লাইজারকে শুকনো রুটি আর ঝোল এনে দিল, সে বলল, ‘এখন থেকে আমি খালি রুটি খাব। ঝোলে বড্ড খরচ, মশলা বাদ দিলেও।’
বাচ্চা-বিয়োনো রুপার চামচ আর মরণশীল মোমদানির গল্পটা দ্রুতই শহরময় ছড়িয়ে পড়ল। টোডির জয়ে আর কিপ্টা লাইজারের হারে সবাই খুব খুশি। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটলেই সেটা নিয়ে গান বাঁধাটা মুচি আর দরজির শিক্ষানবিশের স্বভাব। এটা নিয়েও একটা গান বাঁধল তারা:
মোমদানির মরণে লাইজার
কেন দুঃখে হও তুমি জেরবার?
ধনী বটে তুমি দুনিয়ার সেরা
আছে বাচ্চাবিয়ানো চামচ জোড়া
আছে ছাদের উপর উড়ন্ত গো
আরও আছে তার রুপার পো
রুটিকণা খেয়েও কেন তবে চুপ
সামনে আসছে রুপার নাতিপুত।
সময় চলে যায়, লাইজারের রুপার চামচ আর বাচ্চা দেয় না।
আইজ্যাক বাশেভিস সিঙ্গার : সাংবাদিক ও নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক আইজ্যাক বাশেভিস সিঙ্গার ১৯০৪ সালে পোল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে তাঁর প্রথম প্রধান উপন্যাস দ্য ফ্যামিলি মসকট প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে ‘গিম্পেল দ্য ফুল’সহ বেশ কিছু প্রশংসিত ছোট গল্প লেখেন তিনি। ১৯৬০–এর দশকে তিনি লেখেন ‘দ্য স্পঞ্জিয়া অব মার্কেট স্ট্রিট’। ১৯৭৮ সালে নোবেল পুরস্কার পান সাহিত্যে। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় মৃত্যুবরণ করার আগ পর্যন্ত তিনি তাঁর লেখালেখি চালিয়ে যান।