টুসির দাঁত

অলংকরণ: আরাফাত করিম

টুসির দাঁতটি দুদিন নড়ে আবার বসে গেছে। এতে তার ভাবনার শেষ নেই। স্কুলে সহপাঠীদের দু-একটা করে দাঁত পড়েছে। তার দাঁত কবে পড়বে, সেটা নিয়ে সে চিন্তিত ছিল। প্রথমে দু-একজনের দাঁত পড়ায় অন্যরা খুব হাসাহাসি করেছিল। আড়ি দিয়েছিল, ‘তোমাদের দাঁত পড়ে গেছে, তোমাদের সঙ্গে কথা বলব না।’

ওরা তখন আলাদা হয়ে গেল। টিফিনের ছুটির সময় ওরা গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকে। ওদের কেউ খেলায় নিল না কয়েক দিন। ওরা মন খারাপ করেছে ঠিকই কিন্তু দুজনের মধ্যে একটি জুটি গড়ে উঠেছে।

অবশ্য আড়ি দেওয়ার জোটটি ভাঙতে বেশি সময় লাগে না। দু-এক দিন পরপর একজন–দুজন করে দাঁত পড়ে যাওয়ার দলে ভিড়তে শুরু করে। এখন আর কেউ বলে না, ‘ও মা! তোমার দাঁত পড়ে গেছে? তুমি ভাত খাও কী করে, পড়ে যায় না?’

দাঁতপড়া মেয়েটি কোনো জবাব দিতে পারত না। অন্যরা একসঙ্গে এত প্রশ্ন করে যেত যে নার্ভাস হয়ে যেত সে। তারপরও বলত, ‘আমার মতো তোমাদের দাঁতও পড়বে একদিন।’

তখন হো হো করে হেসে উঠত ওরা। পানি এসে যেত মেয়েটির চোখে। দু-একজন আবার পানি মুছে দিয়ে বলত, ‘আরে আমরা মজা করছি, আর তুমি কাঁদছ।’

কখনো কখনো এমন হতো দাঁতের ফাঁক দিয়ে বাতাস বেরিয়ে যাওয়ায় উচ্চারণ ঠিকমতো হতো না। তখন অন্যরা এটা নিয়ে আনন্দে মেতে উঠত।

এখন কিন্তু অবস্থা পুরোপুরি ভিন্ন। দাঁত পড়েনি এমন হাতেগোনা কজন আছে। তাদের দাঁত পড়ে না কেন, সেই চিন্তায় মাঝেমধ্যে অস্থির হয়ে যায় সবই। টুসিরও এ রকম সময়ে দাঁতটি নড়াচড়া করতে না–করতে আবার বসে গেল। মা একটু চেষ্টা করেছিল ফেলে দিতে। কিন্তু নড়াটা খুব সুবিধার নয় ভেবে ঠিক করল আরও দুদিন পর ফেলবে । পরদিন টুসির বাবাকেও বলেছিল কথাটা।

বাবা শুনে হেসে উঠে বলল, ‘আমার মেয়ের দাঁত পড়বে তাহলে?’

মা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আরে একটু দেখো না, দাঁতটা কী রকম নড়ছে।’

বাবা মেয়েকে কাছে ডেকে হাঁ করতে বলল। হাঁ করে সব দাঁত দেখাল টুসি। কোনটি নড়ছে, জানতে চাইল বাবা। টুসি আঙুল দিয়ে দেখাল দাঁতটা। বাবাও আঙুল বসিয়ে একটু ঠেলা দিয়ে দেখল। তারপর বলল, ‘এখনো তো তেমন নড়ছে না। ভালো করে না নড়লে কী করে ফেলব?’

তখন টুসি প্রশ্ন করল, ‘দাঁত না নড়লে কী হয়?’

‘পাশে আরেকটি নতুন দাঁত গজিয়ে যায়।’

টুসি দাঁতে আঙুল দিয়ে পরখ করে বলে, ‘পাশে তো ফাঁকা নেই, কোথায় গজাবে নতুন দাঁত?’

‘সে তার জায়গা করে নেবে। তবে একটু বাঁকা হয়ে, এই আরকি।’

টুসি ভাবনায় পড়ে যায়, ‘তাহলে আমার দাঁত বাঁকা হয়ে যাবে?’

‘তোমার দাঁত বাঁকা হবে কেন? তোমার দুধের দাঁত তো এখনো ভালো করে নড়েনি।’

‘স্কুলে আমার বন্ধুদের সবার দাঁত পড়ে গেছে, আমরা তিনজন ছাড়া।’

‘দু-এক দিনের মধ্যে তোমারটাও পড়ে যাবে।’

কিন্তু না। দুই দিন, তিন দিন এভাবে সপ্তাহ পার হয়ে গেল। দাঁত আর নড়ে না।

কয়েক দিন পর টুসি মাকে বলল, ‘আমি দাঁত ব্রাশ করার সময় ব্রাশের সঙ্গে কী একটা লাগছে।’

‘কী লাগবে আবার, মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছ, হয়তো কিছু লেগে আছে।’

‘না, ব্রাশ করার পরও আছে।’

‘দেখি’ বলে মা হাঁ করতে বলে।

দুদিন নড়া দাঁতটির ভেতরের দিক থেকে আরেকটি দাঁতের মাথা দেখা যাচ্ছে।

‘এইতো নতুন দাঁত উঠে যাচ্ছে। এখন আগের দাঁতটি না তুললে এটা তো বাঁকা হয়ে যাবে।’

ভেতরের রোগী বেরিয়ে আসতেই টুসি দরজার ফাঁকে ঢুকে পড়ে। ডাক্তার উত্সুক চোখে তার দিকে তাকিয়ে জানতে চায়, ‘দাঁত ওঠাতে তোমার ভয় করছে না?’

মা পুরোনো দাঁতটি আঙুল দিয়ে ঠেলে দেখল। ‘না, এটা মোটেই নড়াচড়া করছে না। এটা তুলতে ডাক্তার লাগবে।’

সন্ধ্যার পর বাবা অফিস থেকে ফিরলে টুসি হাঁ করে বলে, ‘দেখো নতুন দাঁত গজিয়েছে।’

বাবা মাথা নিচু করে মেয়ের ছোট্ট হাঁয়ের ভেতর দেখে, ‘তাইতো। নতুন দাঁত দেখা যাচ্ছে।’

মেয়ে বলে, ‘পুরোনো দাঁতটি আর নড়ছে না। ওটা তুলতে নাকি ডাক্তার লাগবে।’

‘তাই? কে বলল?’

মেয়ে জবাব দেয়, ‘আম্মু।’

‘আচ্ছা। ডাক্তারের সঙ্গে ফোনে কথা বলে দেখব।’

মা তখন বলে, ‘দেখবে বললে কী করে হবে? এখন দেখো, দাঁত ওটা আরও বেড়ে গেলে পুরোনোটা তুলতে অসুবিধা হয়।’

ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতেই তিনি এখনই চেম্বারে নিয়ে যেতে বললেন। বাবা আর দেরি না করে টুসিকে নিয়ে বের হলেন। টুসি খুব খুশি। এর আগে সে দুবার ডাক্তারের চেম্বারে গেছে। একবার বাবার সঙ্গে আরেকবার মায়ের সঙ্গে। বাবাকে চেম্বারের পাশে লম্বা চেয়ারটিতে শুইয়ে দিয়ে ওপরে অনেক রকম লাইট জ্বালিয়ে সব দাঁত নাকি ফিলিং করেছে। কিছুদিন পর লম্বা চেয়ারটিতে মায়ের দাঁতও ওয়াশ করেছে। এসব টুসি খুব ভালো করে দেখেছে। ডাক্তারও তার সঙ্গে দুষ্টুমি করেছে। তখন থেকে তার ইচ্ছা আম্মুর মতো চেয়ারটিতে শুয়ে দাঁত পরিষ্কার করাবে। এখন দাঁত ওঠানোর সুযোগ পেয়ে সে ভারি খুশি হলো।

ডাক্তারের চেম্বারে এসে অ্যাকুয়ারিয়ামের রঙিন মাছগুলো দেখল কিছুক্ষণ। তারপর বলতে লাগল, ‘আমার দাঁত তুলবে কখন?’

‘এইতো, একটু পরে ডাকবে। ভেতরে রোগী আছে, ওরা বেরিয়ে আসুক, তারপর আমি তোমাকে নিয়ে ভেতরে যাব।’

সে কয়েক সেকেন্ড সোফায় বসে আবার উঠে অ্যাকুরিয়ামের কাছে যায়। রঙিন মাছগুলোর নাম জানতে চায়। এসব মাছের নাম বাবার জানা নেই। এমনকি বসা রোগীদের কারও জানা নেই।

ভেতরের রোগী বেরিয়ে আসতেই টুসি দরজার ফাঁকে ঢুকে পড়ে। ডাক্তার উত্সুক চোখে তার দিকে তাকিয়ে জানতে চায়, ‘দাঁত ওঠাতে তোমার ভয় করছে না?’

সে চটপট উত্তর দেয়, ‘না। আমার বন্ধুদের সবার দাঁত পড়েছে।’

‘বন্ধুদের পড়লে কি তোমারও পড়তে হবে?’

‘হ্যাঁ। না হলে যে ওরা আমার সঙ্গে আড়ি দেবে।’

‘তাই নাকি? দাঁত না পড়লে তোমরা কি আড়ি দাও? দেখি হাঁ করো তো।’

টুসি হাঁ করতেই ডাক্তার বলে, ‘একটা না, দুটো দাঁত একসঙ্গে তুলে ফেলতে হবে।’

টুসি দাঁতে আঙুল দিয়ে বলে, ‘এটা নড়েছে যে শুধু।’

‘এটা এবং পাশেরটা, দুটোই তুলতে হবে। তুমি ওখানে গিয়ে শুয়ে পড়ো।’

এই চেয়ারটার প্রতি টুসির অনেক কৌতূহল। আরাম করে হেলান দিয়ে শোয়া যায়। মুখের ওপর অনেকগুলো লাইট এসে পড়ে। পাশের স্ট্যান্ড থেকে দাঁতের নানা রকম সরঞ্জাম গোল ট্রে করে ডাক্তারের হাতের কাছে এসে যায়। কাঁচি, ছুরি বা হ্যামার যা–ই হোক একটুও ভয় পায় না টুসি। ডাক্তার গ্লাভস পরা হাতে টুসির মুখের ভেতরে ছোট্ট একটা সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে বলে, ‘ব্যথা পাচ্ছ তুমি?’

সে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, ‘না।’

‘তাহলে এখন চোখ বন্ধ করো।’

কিন্তু ডাক্তার যখন কাঁচির মতো যন্ত্রটা মুখের কাছে নিয়ে যায় সে তখন চোখ মেলে একপলক দেখে ফেলে। ডাক্তার টের পেয়ে বলে, ‘তুমি কিন্তু দেখে ফেলেছ।’

আবার চোখ বন্ধ করে টুসি। ডাক্তার এক মিনিটেরও কম সময়ে দাঁত তুলে রাখে টিস্যুর ওপর। সাদা কটনের প্যাক দিয়ে মাড়ির খালি জায়গাটিতে কয়েক সেকেন্ড ধরে রেখে বলে, ‘এটা দাঁত দিয়ে চেপে ধরো। এবার তুমি উঠে যেতে পারো। তোমার দাঁত দেখো, কী সুন্দর করে শুয়ে আছে টিস্যুর ওপর।’

টুসি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুটা সময়। তারপর দাঁত দুটি টিস্যুতে পেঁচিয়ে নেয়।

বাসায় আসার পথে টুসি কথা বলতে পারেনি কটনের প্যাক দুটি পড়ে যাবে ভেবে। মাড়ি আর ওপরের দাঁত দিয়ে চেপে ধরা কটন প্যাক দুটি বাসায় এসে মুখ থেকে বের করে। কটনে একটু রক্ত লেগে লাল হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে, ‘সামান্য ব্লিডিং হবে। বাসায় গিয়ে কটন প্যাক ফেলে দিতে পারবে।’

টুসি বেসিনে গিয়ে কয়েকবার কুলি করে। তারপর আয়নার কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁত দেখে।

মা টিস্যুতে প্যাঁচানো দাঁত দুটি হাতে নেয়। নিচের দিকে সরু গাছের শিকড়ের মতো মাড়ির ওপরের অংশটি একটু চ্যাপ্টা। মেয়ের আদর যেন এ দাঁত দুটিতে লেগে আছে।

মা টুসির চিবুক ধরে বলে, ‘হাঁ কর তো মা।’

সে হাঁ করতে মা ভালো করে দাঁত ওঠা খালি মাড়ি দেখে, পেছন থেকে ছোট্ট একটি দাঁত উঁকি দিচ্ছে। মেয়েটির এ জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেলেও বেমানান মনে হচ্ছে না।

সে মায়ের হাত থেকে টিস্যুসহ দাঁত দুটি নিয়ে বলে, ‘এগুলো আমার কাছে থাকবে।’

‘তুমি কী করবে এসব দিয়ে?’

‘এখন বলব না, কালকে বলব। মা ঠিক বুঝতে পারে না।’ টুসি দাঁত দুটি টিস্যুতে পেঁচিয়ে স্কুলের ব্যাগের ভেতর ভরে ফেলে।

পরদিন স্কুলে এসে অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে আশপাশের কয়েকজনকে দাঁত পড়েছে যে তা হাঁ করে দেখায়। ক্লাসে ঢুকতে সে হেসে ওঠে, টিচারসহ সবাই বুঝে যায় টুসির দাঁত পড়েছে। সে–ও নিজেকে আর আলাদা ভাবে না। অন্যদের মতো তারও দাঁত পড়েছে। একটা নয়, একসঙ্গে দুটো।

কখন টিফিনের ছুটি হবে, এখন থেকে সে চিন্তা তার মাথায় ঢুকে গেছে। টিচার ওদের সঙ্গে একটু গল্প করে বলে, ‘তোমাদের মধ্যে দাঁত পড়েনি, এমন কে আছে?’

সবাই প্রায় একসঙ্গে বলে, ‘টিচার, সানি। ওর একটা দাঁতও পড়েনি।’

সানি কিন্তু লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে থাকে।

টিচার বলে, ‘সানি তুমি লজ্জা পাচ্ছ কেন? দাঁত না পড়লে কিছু হয় না। এখন না পড়লে কয়েক মাস পরে পড়বে।’

সে তখন কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, ‘টিচার, ওরা সবাই আমার সঙ্গে আড়ি দিয়েছে। কেউ কথা বলে না আমার সঙ্গে।’

‘এটা তো ঠিক না। কারও কারও দাঁত দেরিতে পড়ে। তোমরা সবাই সানির সঙ্গে কথা বলবে। এখন আমি বোর্ডে যা লিখছি, তা তোমরা দেখে দেখে লেখো।’

টিফিন ছুটির সময় ওরা সবাই দল বেঁধে স্কুলের দেয়ালের পাশের বাদামগাছটির নিচে জড়ো হয়। গাছটির গোড়ায় পাতার আড়ালে গর্তটি খুঁজে বের করে। মাঠে এ সময় অন্য ক্লাসের ছেলেমেয়েরা খেলায় মেতে ওঠে। ওরা কিন্তু গর্তটির চারপাশে গোল করে দাঁড়ায়।

দাঁতদুটি টিফিন ছুটির আগে ব্যাগের পকেট থেকে বের করে জামার পকেটে ঢুকিয়ে রাখে টুসি। এখন দাঁত দুটি বের করে দেখায়। সবার দৃষ্টি দাঁতদুটির ওপর।

ওরা গর্তের আরো কাছাকাছি এসে বলে উঠে, ‘ইঁদুর ভাইয়া, ইঁদুর ভাইয়া, করছো তুমি কী? এই দেখনা তোমার জন্য কী এনেছি?’ বলতে বলতে গর্তের ভেতর দাঁত দুটি ফেলে দেয়।

তখন সবাই একসাথে আবার বলে উঠে, ‘ইঁদুর ভাইয়া, ইঁদুর ভাইয়া, টুসির দাঁত তুমি নাও, তোমার সরু দাঁত টুসিকে দাও।’

ওরা পাতা দিয়ে গর্তের মুখ ঢেকে দেয়। তারপর গাছের নিচ থেকে মাঠের দিকে পা বাড়াতে দেখে, সানি বসে আছে। ওর চোখে পানি।

তখন ওরা সবাই একজনের পেছনে আরেকজন লাইন করে সানির চারপাশে হেঁটে সুর করে গায়, ‘মেলা গো মেলা, আমরা সবাই খেলা, একটি ছেলে বসে আছে, তার কোনো বন্ধু নেই। ওঠো ওঠো সানি, মোছ চোখের পানি।’

সানি চোখে পানি নিয়েই দাঁত বের করে েহসে ফেলে।