তরুর জন্ম হয় শহরে। জন্মের পর থেকে বেশ কয়েক বছর তরুর পরিবার গ্রামেই থাকে। গ্রামের পরিবেশ খুবই মনোরম আর স্নিগ্ধ। তাই মনোরম পরিবেশে দাদা-দাদুর অফুরন্ত আদরের সঙ্গে তরু বড় হতে শুরু করে। তরু যখন ছোট, তখন তাদের বাড়িতে তার সমবয়সী ছোট আর কেউ ছিল না। এ জন্যই বোধ হয় তার আদরের ভাগটা একটু বেশিই ছিল। তরুর বয়স যখন মাত্র এক মাস, তখন তরুর বাবা কিছু চারা গাছ কিনে এনে বাড়ির আঙিনায় এবং পুকুরের পাড়ে লাগান। তরুর মা খুশি হয়ে বলে, ‘ভালোই হলো। মেয়েটাও বড় হবে, গাছগুলোও বড় হবে।’
তরু তো বড় হচ্ছে, একটু একটু করে গাছগুলোও বড় হচ্ছে। বাবার লাগানো গাছগুলোর মধ্যে একটি গাছকে তার খুব ভালো লাগে। স্কুল থেকে ফিরে সেই প্রিয় গাছের নিচে বসে সে। তখন তার কী যে ভালো লাগে! ঘর থেকে বেশি দূরে নয় গাছটা। মাঝেমধ্যে মাকে রাজি করিয়ে গাছের নিচে মাদুর পেতে ওখানে বসে বসে পড়া তৈরি করে ও। কখনো কখনো ছবি আঁকে। ছবি আঁকতে খুব ভালো লাগে তরুর। তরু প্রকৃতিপ্রেমী, গ্রামের ছবিই বেশি আঁকে। আরও আঁকে গাছ, নদী, ফুল, পাখির ছবি। এভাবে গাছটির প্রতি তরু একধরনের মায়া অনুভব করে। সে জানে গাছ মানুষ ও প্রাণীদের অক্সিজেন দিয়ে সাহায্য করে। তাই সব গাছই বন্ধু। কিন্তু তরুর প্রিয় গাছটি হয়ে ওঠে তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। প্রিয় গাছের ডালে রশি ঝুলিয়ে সে দোল খায়। ভুলে যায় মনের সব দুঃখ। এবার সে চতুর্থ শ্রেণিতে উঠবে। বাবা বলেছিলেন, নতুন বছরে নতুন একটি স্কুলে তরুকে ভর্তি করানো হবে। তার মানে তাদের আর গ্রামে থাকা হচ্ছে না। পড়াশোনার জন্য তো কষ্ট করতেই হবে। কিন্তু প্রিয় বন্ধুকে ছেড়ে যেতে হবে বলে খুব মন খারাপ হলো তরুর।
একে একে বছরগুলো কেটে যায়। তরু তার বন্ধুর কথা মনে রাখে সব সময়। নবম শ্রেণিতে পড়ছে সে। গ্রাম থেকে চলে আসার পর সে তার প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা করছে না, এ রকম নয়। প্রতিবার ঈদের সময় গ্রামে গেলে প্রিয় বন্ধুকে মন ভরে দেখে নেয়। গাছের ছায়ায় বসে শীতল করে নেয় মনকে। আর ভাবে, তাকে তো অনেক বড় হতে হবে। অনেক বড় হয়েও সে তার প্রিয় গাছবন্ধুকে ভুলবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে। এখনো গ্রামে গেলে প্রিয় গাছের নিচে বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরে সে। এখানে বসে মাছ ধরে অনেক মজা পায় তরু। তবে এখন আর আগের মতো দোল খায় না। কারণ, গাছের ডালে দোল খেলে যদি ডাল ভেঙে যায়। আর সেও এখন বড় হচ্ছে। ডাল ভেঙে গেলে তো বন্ধুর জন্য কেঁদেই ফেলবে সে।
হঠাৎ গ্রীষ্মের ছুটিতে বাবা বললেন গ্রামে নিয়ে যাবেন। সবাই খুব খুশি। তরু এবার আলাদা করে গ্রামের যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। ওদের স্কুলের লাইব্রেরি থেকে চারটি বই সংগ্রহ করে রাখে। গ্রামে যে চার দিন থাকবে, তখন সে বইগুলো পড়বে। গাছের ছায়ায় মাদুর পেতে ছবি আঁকবে বলে ছবি আঁকার সব সরঞ্জাম গুছিয়ে নেয়। ও ভাবে, এবার গ্রামে গিয়ে অনেক মজা করবে। দিনগুলোও এখন খুব সুন্দর, উজ্জ্বল সোনালি দিন। যেই পরিকল্পনা, সেই কাজ। তো গ্রামে গিয়ে আনন্দেই আত্মহারা। এত দিন পরে এসে প্রিয় গাছবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে সে। আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়। গাছের ছায়ায় বসে সে যকের ধন বইটা পড়ে ফেলে। খুব ভালো লাগে তার। এরপর ওদের বাড়ির একটা ছবি আঁকে। প্রথম দুদিন বাড়ির সবার সঙ্গে খুব মজা করেই কাটিয়ে দিল তরু। তৃতীয় দিন আবার যখের ধন বইটা শেষ করে যেই-না উঠবে, তখনই হঠাৎ আকাশ কালো হতে শুরু করল। অবশ্য আজ রোদও ছিল না বেশি। ধীরে ধীরে আকাশটা কাকের ডিমের মতো কালো রং ধারণ করল। কারও বুঝতে বাকি রইল না যে আজ ঝড় হবে, কালবৈশাখী। ঝড় শুরু হয়ে গেল। সে কী বাতাস আর শব্দ। বাতাসের বেগ বেড়েই চলছে। ঘরের জানালা খুলে বাইরের পরিস্থিতি দেখার মতো অবস্থাও নেই। তরুর পরিবারের সবাই ঘরে চুপ করে বসে আল্লাহর নাম নিচ্ছে। তারা আসলে ভাবতে পারেনি যে হঠাৎ করে এভাবে তাদের ঝড়ের কবলে পড়তে হবে। আর আগে যদি দিনের অবস্থা বোঝা যেত, তাহলে তারা এ রকম দিনে আসত না। কোনো রকমে রাতটা পার হলো। তরুর কিন্তু রাতে ভালো লাগল না। কারণ, ঝড়ের সময় বাতাসের সঙ্গে সে কড়কড় মড়মড় শব্দ শুনেছে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর তরু দাঁত ব্রাশ করতে যাবে, তখন দেখে, বাড়ির পাশের গোয়ালঘর উড়ে গেছে। বাবা বলাবলি করছেন, ঝড়ে নাকি কচি আম সব পড়ে গেছে। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে। বাইরে বের হলে তরুর সামনে পড়ে যে দৃশ্যটা, তাতে সে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বড় বড় দুটি গাছ শিকড়সহ উল্টে পড়ে আছে। আর তাদের মধ্যে একটি তরুর প্রিয় গাছটি। তরু এ দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। তার অনুভূতি এখন পাথর হয়ে গেছে, কোনো কথাই বলতে পরছে না সে।