দুই বছরের শিক্ষাসফর

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

সবাই তো কলেজ থেকে শিক্ষাসফরে যায়। এক দিনের জন্য, খুব বেশি হলে দুই–তিন দিন। কিন্তু আমি এমন এক শিক্ষাসফরে এসেছি, যেখানে রীতিমতো দুই বছর পার হয়ে গেছে!

ঘটনা খুলেই বলি। ছোটবেলা থেকেই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বহু মাত্রায় ভাবি আমি। তবে অনেক চিন্তাভাবনার পর দেখা যায়, হুট করে নতুন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসি। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর সে রকমই হুট করেই সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকায় চলে যাব, তা–ও মা–বাবাকে ছেড়েই। তখনকার হিসেবে এটা মারাত্মক দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত।

তখন আমি থাকি খুলনা শহরে। বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর স্কুলগুলোর একটা থেকে এসএসসি দিয়েছি। স্কুলের নাম এস ও এস হারম্যান মেইনার স্কুল। খুলনার রাস্তায় জ্যাম নেই, হর্নের বিকট আওয়াজ নেই, বাসার পাশে বড় বড় খেলার মাঠ। থাকা-খাওয়া নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটে ঘুরতে যাই।

এ রকম এক শান্তির পরিবেশ থেকে একা একা ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেহাত পাগলামি। আমি ভাবুক গোছের ছেলে। কোনো কারণ ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। সব শুনে বাবা বলল, ‘তোমার ওপর আমার বিশ্বাস আছে। তুমি একা একা ঠিকই সব ম্যানেজ করতে পারবে। যাও ঢাকায়।’

মা বলল, ‘তোর ওপর আমার বিশ্বাস নেই। তুই কিচ্ছু ম্যানেজ করতে পারবি না। ঢাকায় যাবি না।’

আমি বললাম, ‘যাবই।’

‘যাবি না।’

‘ঠিক আছে। টস করে সিদ্ধান্ত নিই। শাপলা পড়লে ঢাকায় যাব, ব্রিজ পড়লে খুলনা থাকব।’

মা রাজি হলো। টস করলাম। পড়ল শাপলা।

মাকে বললাম, ‘ঢাকায় তাহলে যাচ্ছি।’

সত্যি আমি একা একা ঢাকায় চলে যাচ্ছি শুনে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব রীতিমতো অবাক। কলেজ পাস করে অনেকেই ঢাকায় যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। কিন্তু স্কুল পাস করে ঢাকায় যাচ্ছি, কেন যেন মানতে পারছে না কেউ। সবাই মিলে ঢাকায় যাওয়ার কুফল ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সবিস্তারে বর্ণনা করতে লাগল। তার একেকটা শুনে আমি আঁতকে উঠলাম! সেসব কুফলের একটা তালিকা করলে এমন দাঁড়ায়—

১. ঢাকা বিরাট শহর। একা একা ঢাকায় গিয়ে নিশ্চিত হারিয়ে যাবে। হারিয়ে না গেলেও যাতায়াতে ঝামেলা হবে। তার ওপর ঢাকায় ছিনতাইকারী, পকেটমারদের যা উৎপাত!

২. থাকবে কোথায়? ঢাকায় ব্যাচেলরদের থাকার বিরাট সমস্যা।

৩. খাবে কী?

৪. অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই।

ঘণ্টা ঘণ্টা জ্যাম ঠেলে কোচিংয়ে দৌড়াতে হলো না। তত দিনে আমি ভর্তি হয়েছি বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজে। আমার কলেজ পিলখানায়। পিলখানা এক অনন্যসুন্দর জায়গা।

৫. পড়াশোনার বারোটা বেজে যাবে।

৬. অসৎসঙ্গে পড়ে যেতে পারো। একবার পড়ে গেলে পুরো ভবিষ্যৎ ধ্বংস!

৭. ঢাকায় খরচ বেশি। বাবার দেওয়া টাকার ঠিকঠাক ম্যানেজ করতে পারবে না। মাসের অর্ধেক শেষ হতে না হতেই দেখবে টাকা শেষ!

৮. মা-বাবা ছাড়া থাকতে পারবে না।

কোনো কথাই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। তবে সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলেছি, তখন ঢাকায় যাবই। তবে প্রতিটা সমস্যার সমাধান করে তারপরই যাব ঢাকায়। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। সমস্যাগুলো সমাধান করতে লাগল সাত দিন। ২০১৮ সালের ৮ মার্চ রূপসা, পদ্মা ও বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে ঢাকার মাটিতে পা রাখলাম।

ঢাকায় আসার পরপরই প্ল্যানমাফিক কাজ শুরু হলো, আশঙ্কা, ভয়, কুফলগুলোর বিপরীত প্রতিক্রিয়া যাকে বলে।

ঢাকায় এসে প্রথম ছিলাম খালার বাসায়। মোটামুটি কিছুদিন থাকার পর একটা এক রুমের ছোট্ট বাসা ভাড়া নিয়ে ফেললাম। ছিমছাম বাসা, একা থাকার পক্ষে যথেষ্ট আরামদায়ক (এখানে ভাগ্যের সাহায্য আছে। নইলে এমন অসাধারণ বাসা পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়)। কিন্তু তখনো আমি ঢাকার রাস্তাঘাট একদম চিনি না। বাসা থেকে বের হয়ে যে ক পা আগাই, গুনে গুনে আবার বাসায় ফেরত আসি। সমাধান হয়ে এল গুগল ম্যাপ। ছোট ছোট দূরত্বে হেঁটে হেঁটে যাওয়ার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এল গুগলের এই ছোট ভাই। কিন্তু বড় দূরত্ব? বাস, রিকশা, সিএনজিতে কোত্থেকে উঠতে হয়, স্টপেজ কোথায়, ভাড়া কেমন—কিছুই তো জানি না। এবার সমাধান হয়ে এল ঢাকা হুইলস অ্যাপ। কোন বাস কোত্থেকে ছাড়ে, কোথায় যায়—সব জেনে গেলাম। ধীরে ধীরে একটা জিনিস শিখলাম, এই শহরে ‘না’ বলতে শেখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ‘না’ না বলতে পারলে যেমন ২০ টাকার ভাড়া ৪০ টাকা দেওয়া লাগে, তেমনই ৫০ টাকার জিনিস ১০০ টাকায় কেনা লাগে।

খাওয়াদাওয়া সমস্যারও সমাধান হলো। সমাধানের উপায় পাওয়া গেল তিনটি। প্রথমত, বাসায় রান্নার ব্যবস্থা করে নিলাম। ডিম, ভাত, নুডলস, আলুভর্তার মতো সহজ রান্নাগুলো রপ্ত করা হয়ে গেল। হিসাব করে দেখলাম, ঢাকায় আমার যে আত্মীয়স্বজন আছে, প্রত্যেকের বাসায় দুবেলা খেলে আর সারা মাসে খাওয়া নিয়ে চিন্তা থাকে না (জ্যাম ঠেলে এ বাসা–ও বাসা ঘুরতে হবে ভেবে এই চিন্তা বাদ পড়ল)!

এই থাকা-খাওয়ার ঘটনা লিখতে লিখতে পড়াশোনার কথা একদম লেখা হয়নি। পড়াশোনা একই সঙ্গে আমার প্রিয় ও অপ্রিয় বিষয়। কারণ, আমি খুব ভালো শিক্ষার্থী, কিন্তু ভালো পরীক্ষার্থী নই। তবে পড়াশোনার একটা ভালো উপায় আমি বের করলাম। শুরু হলো ইন্টারনেটে লেখাপড়া। নেটে খুঁজলে প্রায় সব টপিকেই ভালো ভালো লেকচার পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে ঘণ্টা ঘণ্টা জ্যাম ঠেলে কোচিংয়ে দৌড়াতে হলো না। তত দিনে আমি ভর্তি হয়েছি বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজে। আমার কলেজ পিলখানায়। পিলখানা এক অনন্যসুন্দর জায়গা। আমার ১১ বছরের স্কুলজীবন কেটেছে বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সেখান থেকে পিলখানার মতো সুন্দর জায়গায় না এলে হয়তো আমাকে হতাশ হতেই হতো। ঢাকার জ্যাম, ময়লা, ধুলাবালুর মধ্যে আমার কলেজ যেন এক আনন্দের ছোঁয়া নিয়ে এল।

২০১৩ থেকে আমার আনন্দের এক কারণ ছিল কিশোর আলো পড়া। কয়েকবার কুইজ পাঠিয়ে পুরস্কারও পেয়েছি। দূর থেকে কিশোর আলোর সব আয়োজনও দেখতাম। ঢাকায় আসার পর হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, কিশোর আলোর অফিস আসলে এখানে, ঢাকায় এবং এখানে মাঝেমধ্যে যাওয়া যায়। বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণও করা যায়। অনেক ছেলেমেয়ে এ রকম দারুণ দারুণ কাজের সঙ্গে যুক্ত। আমিও কিআতে যাওয়া শুরু করলাম। আস্তে আস্তে আবিষ্কার করলাম, কিশোর আলোর বিভিন্ন পাতায় আমার লেখা ছাপা হচ্ছে, ছবিও ছাপা হচ্ছে। জুলাই ২০১৯ সংখ্যায় তো প্রচ্ছদেই দেখলাম আমার ছবি!

পৃথিবীটা বড্ড ছোট। ছোট্টবেলার আবেগ নিয়ে প্রিয় ম্যাগাজিনের লেখা পড়া আর কয়েক বছর পর সেই ম্যাগাজিনের পাতায়ই নিজের লেখা ও ছবি দেখার আনন্দ কি–বোর্ড কিংবা কলমে লিখে প্রকাশ করা যায় না।

তবে শত আনন্দের মধ্যেও এটা ঠিক, মা–বাবাকে ছাড়া থাকা পৃথিবীর কঠিনতম কাজ। বাসা, খাওয়াদাওয়া, কলেজ মোটামুটি সবই তো আমি ব্যবস্থা করে নিতে পেরেছি। অসুস্থ হলে যেন বিপদে পড়তে না হয়, সে জন্য প্রাথমিক সব ওষুধ, থার্মোমিটার কাছে রাখি। বাবার পাঠানো টাকার অপচয় ঠেকাতে প্রতিদিন হিসাব করে খরচ করি। কিন্তু মা–বাবার ভালোবাসা, স্নেহ থেকে দূরে থাকলেই বোঝা যায় মা–বাবার ভূমিকা কী।

আজও কেউ যখন আমাকে এমন কিছু করার কথা বলে, যেটা করা অনুচিত, তখন বাবার কথাটা মনে পড়ে যায়। যে বিশ্বাস পুঁজি করে এই শহরে এসেছি, সেই বিশ্বাস ভাঙি কী করে!