পিন্টুর ঝাড়ু

সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়ু ভোওওওও করে উঠে গেল আকাশে।
অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

পিন্টুকে নিয়ে আর পারলাম না। বর্ষার শুক্রবার সকাল, আগড়ুম-বাগড়ুম মেঘ ডাকছে আকাশে। ভাবলাম আরাম করে একটু ঘুমাব, তা না। এই সময়ই ওর ফোন করতে হবে? সকাল সাতটায় ব্যাটা ফোন করে বলে, নতুন কী একটা বানিয়েছে, দেখতে যেতে হবে। এই পাগলের কথা শুনে কাজ নেই ভেবে ফোন রেখে ঘুম দিলাম আবার। কিন্তু টানা দশবার ফোন দিল পিন্টু। যেতেই হবে। টানা ফোনের আওয়াজে ঘুমটাও যেহেতু ভেঙে গেছে, ভাবলাম যাই।

ওমা! গিয়ে দেখি রাব্বীও ঘুম ঘুম চোখে বসে আছে পিন্টুর বাসার ড্রয়িংরুমে। আমাকে দেখে চোখ কচলে জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে, তোকেও পিন্টু ডেকেছে?’ চোখ কচলে উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ। দেখি, কী এমন আশ্চর্য জিনিস দেখাতে এই সাতসকালে ডেকেছে। যদি ফাজলামি হয়, তাহলে ওরে এমন পিটানি আজকে পেটাব আর কোনো দিন ডাকার সাহস পাবে না।’ একটু পরে পিন্টুর মা এসে বেশ ভালো নাশতা দিয়ে গেলেন আমাদের। খুব আয়েশ করেই খাচ্ছিলাম। পিন্টুদের বাসায় এলে মজার মহার খাবারা রান্না করে খাওয়ান আন্টি। এই বাসার এই একটা জিনিসই ভালো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আন্টি, পিন্টু কোথায়?’ আন্টি হতাশ গলায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তোমাদের বন্ধুকে নিয়ে আর পারি না। কাল একটা নতুন ঝাড়ু কিনে আনলাম ঘর মোছার জন্য। সেটা নিয়েই সারা রাত কী কী যেন করল, এখনো করছে। ভেতরের ঘরে আছে, তোমরা খেতে থাকো, ও একটু পরেই আসবে।’

সত্যিই তাই। একটু পর চিরচেনা খিলখিল হাসিটা হাসতে হাসতে এল পিন্টু। তার হাতে একটা ঝাড়ু। পিন্টুর এই হাসি সব সময়ই খুব বিরক্ত লাগে আমার। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই নিশ্চয়ই বলবি না, এই ঝাড়ু দেখাতে আমাদের সাতসকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলে এনেছিস?’ পিন্টু হাসতে হাসতেই উত্তর দিল, ‘আরে! এটা কোনো সাধারণ ঝাড়ু নয় তো! এটা রিমোট কন্ট্রোলড ঝাড়ু!’ পিন্টুর কথা শুনে কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকলাম আমি আর রাব্বী। তারপর রাব্বী বলল, ‘মানুষ রিমোট কন্ট্রোলড গাড়ি বানায়, প্লেন বানায়, রোবট বানায়। আর তুই বানালি ঝাড়ু! তোর এই ঝাড়ু কী করবে? রিমোট চাপ দিলে ঘরদুয়ার পরিষ্কার করে দেবে?’ এবার একটু রহস্য করেই বলল পিন্টু, ‘না না! এই ঝাড়ু উড়বে!’ আমি ছোটবেলা থেকেই হ্যারি পটারের ভীষণ ভক্ত, হ্যারি পটারের ওই ব্রুমস্টিক নিমবাস- দুই হাজারের মতো একটা ঝাড়ুর ভীষণ শখ ছিল আমার। তাই উড়ন্ত ঝাড়ুর আইডিয়াটা ভালোই লাগল। বললাম, ‘তাহলে ওড়া দেখি তোর এই ঝাড়ু।’ ‘ওড়াব, ওড়াব, এত অধৈর্য হচ্ছিস কেন? তার আগে ছাদে চল, তোরা দুজন এই ঝাড়ুর ওপর উঠে বসবি, তারপর ওড়াব।’ পিন্টুর এ কথা শুনে একটু নড়েচড়ে বসলাম আমি আর রাব্বী। রাব্বী জিজ্ঞেস করল, ‘তোর এই যাত্রীবাহী ঝাড়ু কি আমাদের আগে কোনো যাত্রী নিয়ে উড়েছে? না, আমরাই ইতিহাসে প্রথম?’ ‘আর কাকে নিয়ে উড়বে? প্রথম এক্সপেরিমেন্টটা তোদের দিয়ে করব বলেই তো তোদের ডেকে পাঠালাম। এখন চল।’ পিন্টুর সোজাসাপ্টা উত্তর।

রাব্বী আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মুন্না, আমি যা বুঝতেছি আর এক মিনিটও দেরি করা যাবে না, তাড়াতাড়ি বাসায় চল। এই পাগলের কথামতো ঝাড়ুর ওপর উঠে বসব, তারপর ঝাড়ু না আকাশ থেকে মাটিতে ফেলে দেয়। আমার এত জলদি মরার শখ নেই।’ উড়ন্ত ঝাড়ুর ব্যাপারে একটা আকর্ষণ থাকলেও আমি ভেবে দেখলাম, রাব্বীর কথাই ঠিক। বাসায় ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। এমন সময় পিন্টু শুরু করল তার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের কোনো বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা হলে নিঃসন্দেহে সেখানে ফার্স্ট হতো পিন্টু। সে কোনো দিন কাউকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে কাজ হাসিল করতে ব্যর্থ হয়েছে—এমন রেকর্ড ইতিহাসে নেই। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই কিছুক্ষণ পর আমি আর রাব্বী নিজদের আবিষ্কার করলাম পিন্টুদের বাসার ছাদে, ওই রিমোট কন্ট্রোলড ঝাড়ুর ওপর। এখন শুধু আকাশে ওড়ার অপেক্ষা।

‘আমি আমার হাতের মোবাইলটা থেকে কন্ট্রোল করব ঝাড়ু। আর তোদের তো মোবাইল আছে। মোবাইল দিয়ে যোগাযোগ রাখ আমার সঙ্গে। আশা করি কোনো সমস্যা হবে না। হলেই আমাকে ফোনে বলবি, সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়ু ল্যান্ড করাব। প্রথম রাইডে আশপাশেই ওড়াচ্ছি, কোনো সমস্যা না হলে সেকেন্ড রাইড দেব। থ্রি-টু-ওয়ান গো...।’ এই বলেই পিন্টু তার মোবাইলে চাপ দিল। একটা ঝাঁকি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল ঝাড়ু। আমি আর রাব্বী ঝাড়ুর ওপরে বসে ছিলাম। ঝাড়ুর সঙ্গে ওপরে উঠে যেতে লাগলাম আমরাও। কোনো ঝঞ্ঝাট ছাড়াই প্রথম রাইড শেষ করে আবার ল্যান্ড করলাম পিন্টুদের ছাদে। ফিরে আসার পর পিন্টুর খুশি দেখে কে! সত্যি বলতে আমি আর রাব্বীও বেশ খুশি ছিলাম। প্লেনে চড়ার বহুদিনের শখ আমার, তা পূরণ হলো ঝাড়ুর ওপর চড়ে। সেকেন্ড রাইডে পিন্টুও যেতে চাইল। সঙ্গে আমিও গোঁ ধরলাম, যাবই। রাব্বী রয়ে গেল পিন্টুদের ছাদে, তাকে সব বুঝিয়ে দিল পিন্টু। হাতে ধরিয়ে দিল রিমোট। পিন্টু ঝাড়ুর ওপর বসে থ্রি-টু-ওয়ান বলে রাব্বীর দিকে তাকিয়ে চিত্কার করল, ‘ফ্লাই বাটন প্রেস কর।’

সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়ু ভোওওওও করে উঠে গেল আকাশে। ঠিক তখনই সকাল থেকে আগড়ুম-বাগড়ুম ডেকে চলা মেঘ ফেটে নামল বৃষ্টি, সঙ্গে জোর বাতাস। ঝাড়ুটাও শুরু করল উল্টাপাল্টা আচরণ। আমি আর পিন্টু দুজনই বুঝতে পারলাম, বিপদে পড়েছি। পিন্টু ফোনে রাব্বীকে বলছে, ইমার্জেন্সি ল্যান্ড বাটনে প্রেস করতে। রাব্বীকেও দেখলাম মোবাইল নিয়ে গুঁতোগুঁতি করে যাচ্ছে। কিন্তু ঝাড়ুটা প্রচণ্ড গোঁয়ারের মতো একবার ওদিকে যায় তো একবার এদিকে, কখনো আবার সোজা উঠে যাচ্ছে ওপরে। আমি পিন্টুর পেছনে বসে চোখ বুজে দোয়া-দরুদ পড়ছি আর নিজেকে গাল দিচ্ছি! কেন যে দ্বিতীয়বার রাইড দিলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে কী যেন বলতে লাগল পিন্টু, কিন্তু বৃষ্টি আর বাতাসে কিছু বুঝতে পারছিলাম না। উঠতে উঠতে কত ওপরে উঠে যাচ্ছিলাম, তারপর আর কিছু খেয়াল নেই।

পিন্টুকে নিয়ে আর পারলাম না। বর্ষার শুক্রবার সকাল, আগড়ুম-বাগড়ুম মেঘ ডাকছে আকাশে। ভাবলাম আরাম করে একটু ঘুমাব, তা না। এই সময়ই ওর ফোন করতে হবে? সকাল সাতটায় ব্যাটা ফোন করে বলে, নতুন কী একটা বানিয়েছে, দেখতে যেতে হবে। এই পাগলের কথা শুনে কাজ নেই ভেবে ফোন রেখে ঘুম দিলাম আবার। কিন্তু টানা দশবার ফোন দিল পিন্টু। যেতেই হবে। টানা ফোনের আওয়াজে ঘুমটাও যেহেতু ভেঙে গেছে, ভাবলাম যাই।

ওমা! গিয়ে দেখি রাব্বীও ঘুম ঘুম চোখে বসে আছে পিন্টুর বাসার ড্রয়িংরুমে। আমাকে দেখে চোখ কচলে জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে, তোকেও পিন্টু ডেকেছে?’ চোখ কচলে উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ। দেখি, কী এমন আশ্চর্য জিনিস দেখাতে এই সাতসকালে ডেকেছে। যদি ফাজলামি হয়, তাহলে ওরে এমন পিটানি আজকে পেটাব আর কোনো দিন ডাকার সাহস পাবে না।’ একটু পরে পিন্টুর মা এসে বেশ ভালো নাশতা দিয়ে গেলেন আমাদের। খুব আয়েশ করেই খাচ্ছিলাম। পিন্টুদের বাসায় এলে মজার মহার খাবারা রান্না করে খাওয়ান আন্টি। এই বাসার এই একটা জিনিসই ভালো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আন্টি, পিন্টু কোথায়?’ আন্টি হতাশ গলায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তোমাদের বন্ধুকে নিয়ে আর পারি না। কাল একটা নতুন ঝাড়ু কিনে আনলাম ঘর মোছার জন্য। সেটা নিয়েই সারা রাত কী কী যেন করল, এখনো করছে। ভেতরের ঘরে আছে, তোমরা খেতে থাকো, ও একটু পরেই আসবে।’

সত্যিই তাই। একটু পর চিরচেনা খিলখিল হাসিটা হাসতে হাসতে এল পিন্টু। তার হাতে একটা ঝাড়ু। পিন্টুর এই হাসি সব সময়ই খুব বিরক্ত লাগে আমার। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই নিশ্চয়ই বলবি না, এই ঝাড়ু দেখাতে আমাদের সাতসকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলে এনেছিস?’ পিন্টু হাসতে হাসতেই উত্তর দিল, ‘আরে! এটা কোনো সাধারণ ঝাড়ু নয় তো! এটা রিমোট কন্ট্রোলড ঝাড়ু!’ পিন্টুর কথা শুনে কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকলাম আমি আর রাব্বী। তারপর রাব্বী বলল, ‘মানুষ রিমোট কন্ট্রোলড গাড়ি বানায়, প্লেন বানায়, রোবট বানায়। আর তুই বানালি ঝাড়ু! তোর এই ঝাড়ু কী করবে? রিমোট চাপ দিলে ঘরদুয়ার পরিষ্কার করে দেবে?’ এবার একটু রহস্য করেই বলল পিন্টু, ‘না না! এই ঝাড়ু উড়বে!’ আমি ছোটবেলা থেকেই হ্যারি পটারের ভীষণ ভক্ত, হ্যারি পটারের ওই ব্রুমস্টিক নিমবাস- দুই হাজারের মতো একটা ঝাড়ুর ভীষণ শখ ছিল আমার। তাই উড়ন্ত ঝাড়ুর আইডিয়াটা ভালোই লাগল। বললাম, ‘তাহলে ওড়া দেখি তোর এই ঝাড়ু।’ ‘ওড়াব, ওড়াব, এত অধৈর্য হচ্ছিস কেন? তার আগে ছাদে চল, তোরা দুজন এই ঝাড়ুর ওপর উঠে বসবি, তারপর ওড়াব।’ পিন্টুর এ কথা শুনে একটু নড়েচড়ে বসলাম আমি আর রাব্বী। রাব্বী জিজ্ঞেস করল, ‘তোর এই যাত্রীবাহী ঝাড়ু কি আমাদের আগে কোনো যাত্রী নিয়ে উড়েছে? না, আমরাই ইতিহাসে প্রথম?’ ‘আর কাকে নিয়ে উড়বে? প্রথম এক্সপেরিমেন্টটা তোদের দিয়ে করব বলেই তো তোদের ডেকে পাঠালাম। এখন চল।’ পিন্টুর সোজাসাপ্টা উত্তর।

রাব্বী আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মুন্না, আমি যা বুঝতেছি আর এক মিনিটও দেরি করা যাবে না, তাড়াতাড়ি বাসায় চল। এই পাগলের কথামতো ঝাড়ুর ওপর উঠে বসব, তারপর ঝাড়ু না আকাশ থেকে মাটিতে ফেলে দেয়। আমার এত জলদি মরার শখ নেই।’ উড়ন্ত ঝাড়ুর ব্যাপারে একটা আকর্ষণ থাকলেও আমি ভেবে দেখলাম, রাব্বীর কথাই ঠিক। বাসায় ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। এমন সময় পিন্টু শুরু করল তার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের কোনো বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা হলে নিঃসন্দেহে সেখানে ফার্স্ট হতো পিন্টু। সে কোনো দিন কাউকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে কাজ হাসিল করতে ব্যর্থ হয়েছে—এমন রেকর্ড ইতিহাসে নেই। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই কিছুক্ষণ পর আমি আর রাব্বী নিজদের আবিষ্কার করলাম পিন্টুদের বাসার ছাদে, ওই রিমোট কন্ট্রোলড ঝাড়ুর ওপর। এখন শুধু আকাশে ওড়ার অপেক্ষা।

‘আমি আমার হাতের মোবাইলটা থেকে কন্ট্রোল করব ঝাড়ু। আর তোদের তো মোবাইল আছে। মোবাইল দিয়ে যোগাযোগ রাখ আমার সঙ্গে। আশা করি কোনো সমস্যা হবে না। হলেই আমাকে ফোনে বলবি, সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়ু ল্যান্ড করাব। প্রথম রাইডে আশপাশেই ওড়াচ্ছি, কোনো সমস্যা না হলে সেকেন্ড রাইড দেব। থ্রি-টু-ওয়ান গো...।’ এই বলেই পিন্টু তার মোবাইলে চাপ দিল। একটা ঝাঁকি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল ঝাড়ু। আমি আর রাব্বী ঝাড়ুর ওপরে বসে ছিলাম। ঝাড়ুর সঙ্গে ওপরে উঠে যেতে লাগলাম আমরাও। কোনো ঝঞ্ঝাট ছাড়াই প্রথম রাইড শেষ করে আবার ল্যান্ড করলাম পিন্টুদের ছাদে। ফিরে আসার পর পিন্টুর খুশি দেখে কে! সত্যি বলতে আমি আর রাব্বীও বেশ খুশি ছিলাম। প্লেনে চড়ার বহুদিনের শখ আমার, তা পূরণ হলো ঝাড়ুর ওপর চড়ে। সেকেন্ড রাইডে পিন্টুও যেতে চাইল। সঙ্গে আমিও গোঁ ধরলাম, যাবই। রাব্বী রয়ে গেল পিন্টুদের ছাদে, তাকে সব বুঝিয়ে দিল পিন্টু। হাতে ধরিয়ে দিল রিমোট। পিন্টু ঝাড়ুর ওপর বসে থ্রি-টু-ওয়ান বলে রাব্বীর দিকে তাকিয়ে চিত্কার করল, ‘ফ্লাই বাটন প্রেস কর।’

সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়ু ভোওওওও করে উঠে গেল আকাশে। ঠিক তখনই সকাল থেকে আগড়ুম-বাগড়ুম ডেকে চলা মেঘ ফেটে নামল বৃষ্টি, সঙ্গে জোর বাতাস। ঝাড়ুটাও শুরু করল উল্টাপাল্টা আচরণ। আমি আর পিন্টু দুজনই বুঝতে পারলাম, বিপদে পড়েছি। পিন্টু ফোনে রাব্বীকে বলছে, ইমার্জেন্সি ল্যান্ড বাটনে প্রেস করতে। রাব্বীকেও দেখলাম মোবাইল নিয়ে গুঁতোগুঁতি করে যাচ্ছে। কিন্তু ঝাড়ুটা প্রচণ্ড গোঁয়ারের মতো একবার ওদিকে যায় তো একবার এদিকে, কখনো আবার সোজা উঠে যাচ্ছে ওপরে। আমি পিন্টুর পেছনে বসে চোখ বুজে দোয়া-দরুদ পড়ছি আর নিজেকে গাল দিচ্ছি! কেন যে দ্বিতীয়বার রাইড দিলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে কী যেন বলতে লাগল পিন্টু, কিন্তু বৃষ্টি আর বাতাসে কিছু বুঝতে পারছিলাম না। উঠতে উঠতে কত ওপরে উঠে যাচ্ছিলাম, তারপর আর কিছু খেয়াল নেই।

রাজাও আমাদের দেখে খুব চেঁচামেচি করলেন, কিন্তু আমরা তারও কিছুই বুঝতে পারলাম না। কে জানে ফাঁসির আদেশ-টাদেশ দিয়ে দিলেন কি না।
অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক
একটু পরে পিন্টু তার সেই চিরচেনা খিলখিল হাসিটা হাসতে হাসতে হাতে করে একটা ঝাড়ু নিয়ে আমাদের সামনে এল।

যখন খেয়াল হলো, তখন চোখ খুলে দেখতে পাই আমি শুয়ে আছি একটা বাগানে। চারপাশে প্রচুর আম-কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফুল-ফলের গাছ। ফুল-ফলের গন্ধে এলাকাটা একেবারে ম-ম করছে। আমার পাশেই কিছু দূরে শুয়ে আছে পিন্টু। একটা বড় গাছের ডালে আটকে আছে পিন্টুর সেই ঝাড়ু। তার মানে ল্যান্ড আমরা করেছি ঠিকই, কিন্তু কোথায় ল্যান্ড করেছি, তা জানি না। পিন্টুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিরে? কই এসে পড়লাম? ফিরব কীভাবে?’ পিন্টু উত্তর দিল না। ঝাড়ুটা নেড়েচেড়ে বলল, ‘ব্যাটারির চার্জ শেষ। অনেকক্ষণ ধরে উড়েছি মনে হয় আমরা।’ পকেট হাতড়িয়ে রাব্বীকে ফোন দিল পিন্টু। জিজ্ঞেস করল কী হয়েছিল আসলে। রাব্বী বলল, ইমার্জেন্সি ল্যান্ড বাটনে চাপ দেওয়ার পরও কাজ না করায় উল্টাপাল্টা বাটন টিেপছিল সে। তারপর কী হয়েছে সে জানে না। পিন্টু রাব্বীকে ছাদেই থাকতে বলল।

আমি আর পিন্টু দুজনে হাঁটতে লাগলাম ব্যাটারির চার্জের সন্ধানে। ঝাড়ুটা পিন্টুর কাঁধে। চারপাশের ঘরবাড়ি দেখে মনে হলো আমরা বোধ হয় পনেরো শ কিংবা ষোলো শ শতাব্দীতে চলে এসেছি। বাগানে কিছু অপূর্ব সুন্দরী কিশোরী ফুল তুলছে। ভাবলাম তাদের জিজ্ঞাসা করি জায়গাটার নাম কী, কিন্তু ডাকতেই ভয়ে পালাল তারা। কিছুই বুঝতে পারলাম না আমরা। তবে একটু পরেই তারা ফিরে এল আবার। সঙ্গে নিয়ে এল রাজার সৈন্যদলের বিশালদেহী সিপাহিদের। পিন্টুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোর ঝাড়ুতে টাইম ট্রাভেলের কোনো ব্যাপার ছিল নাকি রে? মনে তো হচ্ছে পিছিয়ে আসলাম কয়েক শ বছর।’ পিন্টু বলল, ‘না! আমিও বুঝতে পারছি না, কী হচ্ছে!’ সিপাহিরা এসে খুব কড়া ভাষায় আমাদের কী কী যেন বলতে লাগল, কিন্তু তাদের ভাষা আমরা কিছু বুঝতে পারলাম না। তবে এটা বোঝা যাচ্ছিল, তারা আমাদের শাস্তি দেবে এখন। পিন্টু আমার কানে কানে বলল, ওরা বোধ হয় ভাবছে আমরা মেয়েগুলোকে ডিস্টার্ব করতে এসেছি। মাফ চাইতে হবে। এক সিপাহি তলোয়ার বের করতেই আমরা হাতজোড় করে মাফ চাওয়ার ভঙ্গি করলাম। ভাষা না বুঝলেও এই ভঙ্গি বুঝল ওরা। আমাদের কিছু করল না। নিয়ে গেল রাজার কাছে।

রাজাও আমাদের দেখে খুব চেঁচামেচি করলেন, কিন্তু আমরা তারও কিছুই বুঝতে পারলাম না। কে জানে ফাঁসির আদেশ-টাদেশ দিয়ে দিলেন কি না। মাঝখানে পিন্টু হঠাৎ চিত্কার করে বলে, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি, এখানে এমন কেউ আছেন যে বাংলা অথবা ইংলিশ বলতে পারেন? রাজার এক উজির উঠে এলেন। এসে বললেন, ‘আপনারা বাঙ্গাল মুল্লুক থেকে কী উদ্দেশ্যে আসিয়াছেন?’ পিন্টু তাকে সব খুলে বলল। ওই উজির রাজার সঙ্গে কী যেন চ্যাওম্যাও ভাষায় কথা বলল আবার। তারপর আমাদের এসে বলল, ‘আমি চেষ্টা করিয়াছিলাম, আপনাদের যদি বাঁচানো যায়, কিন্তু রাজা মশাইয়ের মেজাজ শরিফ নেই আজকাল। রাজকন্যার গত এক মাস ধরিয়া মন খারাপ। রাজামশাই পুরস্কারও ঘোষণা করিয়াছেন, যে রাজকন্যার মন ভালো করিয়া দিতে পারিবে, তাহার জন্য, কিন্তু সব ব্যবস্থাই এখন পর্যন্ত ব্যর্থ। যাহোক, আপনাদের আজ সূর্যাস্তের পর ফাঁসির আদেশ হইয়াছে। আপনারা এই রাজ্যের নারীদের ফুলের বাগানে গিয়া, তাদের ত্যক্ত করিয়াছেন এই অভিযোগে।’ আমি আর পিন্টু একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। পিন্টু সেই উজিরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা যদি রাজকন্যার মন ভালো করে দিতে পারি?’ উজির আবার রাজার সঙ্গে চ্যাওম্যাও ভাষায় কী যেন বললেন। তারপর আমাদের বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনারা চেষ্টা করিয়া দেখুন, রাজকন্যার মন ভালো করিতে পারিলে নিজ মুল্লুকে ফেরত যাইতে পারিবেন, পুরস্কারও পাইবেন। আর না হইলে আপনাদের ফাঁসি।’ সিপাহিরা পাহারা দিয়ে রাজকন্যার কাছে নিয়ে গেল আমাদের।

রাজকন্যার মন ভালো করতে এর আগেও বহু দূরদেশ থেকে আসা অনেক মানুষ চেষ্টা করেছেন, লাভ হয়নি। গোমড়া মুখে বসে আছেন রাজকন্যা। পিন্টু আমাকে বলল, ‘তুই না গান পারস? গান গা একটা।’ স্কুলের দু-একটা ফাংশনে গান গেয়েছিলাম, সেই ভরসায় ওই রবীন্দ্রসংগীতটা ধরলাম, ‘আমার পরানও যাহা চায়’—কিন্তু লাভ হলো না। পিন্টু বলে, ‘বাংলায় কাজ হবে না, ইংলিশ ধর।’ একটা ইংলিশ গানও গাইলাম, তাও কিছু হলো না। পিন্টু বলল, গানের সঙ্গে নাচা লাগবে, নাচ। নাচলাম। তাও কিছু হলো না। দুজনে মিলে ডিগবাজি খেলাম, একজন আরেকজনকে মারলাম, কাতুকুতু দিলাম। কিছুতেই রাজকন্যার মন ভালো হয় না। এদিকে উজির এসে মনে করিয়ে দিলেন, সূর্যাস্তের সময় হয়ে যাচ্ছে। তখনই বুদ্ধিটা এল পিন্টুর মাথায়। আমাকে বলল, ‘তোর মোবাইলে স্ন্যাপচ্যাট আছে না?’ ‘হ্যাঁ আছে, তাতে কী?’ বললাম আমি। পিন্টু বলল, ‘মোবাইলটা দে।’ স্ন্যাপচ্যাট ফিল্টার দিয়ে পিন্টু নিজের কয়েকটা সেলফি তুলল। সেই ছবি দেখাতেই হাসি ফিরল রাজকন্যার মুখে। রাজকন্যাও নিজেরও কতগুলো ছবি তুলল সেই ফিল্টার দিয়ে। হাসতে হাসতে তার তো তো লুটপাট অবস্থা। রাজা-উজিরসহ সবাই অবাক! আমরা কী করে পারলাম রাজকন্যার মুখে হাসি ফোটাতে! আমাদের মাফ করে দেওয়া হলো, এমনকি দেওয়া হলো পুরস্কারও! রাজা তো খুশি হয়ে রাজকন্যার সঙ্গে পিন্টুর বিয়েও দিয়ে দিতে চাইলেন, পিন্টুই রাজি হলো না। তার নাকি অনেক কাজ, সময় নেই এখন।

পিন্টু আবার ঝাড়ুর ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করল। ঝাড়ুর ওপরে উঠে রাব্বীকে ফোন দিয়ে বলল, ‘আবার উল্টাপাল্টা বাটন প্রেস কর’। রাব্বী কী করল কে জানে, সোজা ওপরে উঠে গেল ঝাড়ু। রাজা, উজির, রাজকন্যা, সিপাহিরা সবাই হাত নাড়িয়ে বিদায় দিতে লাগল আমাদের। আমারই কেবল একটু মন খারাপ ছিল। রাজকন্যার স্ন্যাপচ্যাট জিনিসটা এতই পছন্দ হয়ে গেছে যে আমার মোবাইলটা দিয়ে আসতে হয়েছে। ঝাড়ু নিয়ে আমরা সোজা ল্যান্ড করলাম আবার পিন্টুদের ছাদে, একদম রাব্বীর গায়ের ওপর। নিচে নেমে আমি আর রাব্বী মিলে ঝাড়ুটা দিয়ে পিন্টুকে সেই মার মারতে লাগলাম। হঠাৎ পিন্টু বলল, এক মিনিট দাঁড়া। একটু চেক করে নিই, রাজা আমাদের পুরস্কার হিসেবে যে ৫০০ কোহিনূর হীরার মার্বেল দিলেন, ওগুলো আছে, নাকি হারিয়ে গেছে। এই বলে পিন্টু পকেটে হাত দিল। তারপর চিত্কার করে বলে উঠল, ‘আছে আছে, আবার মারা শুরু কর তোরা আমাকে! ইয়েএএএএএ...।’