বাবার কাছে খোলা চিঠি

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

প্রিয় বাবা,

তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি। কখনো সেভাবে এই বিশেষ দিনে তোমাকে কাছ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে পারিনি। সুদূর বিদেশে বসবাস করা সত্ত্বেও আর পাঁচজন বাবা-মেয়ে থেকেও তোমার–আমার সম্পর্ক ছিল বেশি ঘনিষ্ঠ। বন্ধুত্ব ছিল অটুট। দীর্ঘ দুই-তিন বছর পরপর তুমি বাংলাদেশে আসতে, তা–ও তিন মাস কিংবা তার থেকেও কম সময়ের জন্য। সব সময় শুনেছি বাবারা একটু কড়া। সন্তানকে মানুষ করতে, সততার পথে রাখতে কড়া হতে হয় বাবাদের।

কিন্তু তুমি একদম তার বিপরীত। কখনো আমাদের ওপর শাসন চলেনি তোমার। দিয়েছ একবুক ভালোবাসা। নিজের হাজার কষ্টের পরেও হাসিমুখে আমাকে ‘মা’ বলে ডাকতে। তুমি মনে করতে, কখনো শাসন করে সন্তানকে সৎপথে পরিচালিত করা সম্ভব নয়। আর আমিও তোমার ভালোবাসা, বিশ্বাস, স্নেহের কথা মাথায় রেখে তোমারই দেখানো পথে চলেছি। কারণ, আমি যে তোমার ‘মা’।

কখনো কোনো ভুল করলে তোমার চোখ গরম করা শাসন আমাদের ওপর পড়েনি, বরং হাসিমুখে বলেছ, ‘মা, সোনাবাবু, তোমার এটা ভুল হচ্ছে।এটা কোরো না।’

আমিও সেই ভালোবাসা, স্নেহকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে তোমার কথা মান্য করে চলেছি। দেশে আসার সময় আমার কাছে সব সময় জানতে চাইতে, আমার কী লাগবে। প্রতিবার তোমায় একটি কথাই বলতাম, বাবা তুমি সুস্থভাবে দেশে আসো, আর কিছুই লাগবে না। আশ্চর্য! তুমি নিজের পছন্দমতো আমার জন্য অনেক কিছুই নিয়ে আসতে, যে জিনিসগুলো আমি মনে মনেই চেয়েছিলাম।

তুমি খুব সহজেই মানুষের মনটাকে বুঝতে পারো বাবা। কিন্তু কী করে পারো, সেটা আমার আজও অজানা। আমার সামান্য জ্বর হলে রাতের ঘুম চলে যেত তোমার। আমাদের একটু কিছু হলেই কান্নায় ভেঙে পড়তে তুমি। নিজের জন্য কখনো বিন্দুমাত্রও ভেবে দেখনি বাবা। তোমার দোয়াই ছিল আমার সবকিছুর মূল ওষুধ। তুমি যার জন্যই দোয়া করতে, কী সুন্দর তা কাজে লেগে যেত!

আমার যখন তিন বছর বয়স, তখন তুমি বাড়িতে এসে একবার আমাকে খাইয়ে দিয়েছিলে। তখন তোমায় বলেছিলাম, তুমি নাচ না করলে খাব না। সেটাও তুমি করেছিলে।

৪-৫ মাস পরপর আমার আর ভাইয়ের জন্য চকলেট, খেলনা আরও হাজারো জিনিস পাঠাতে। কখনো টাকা খরচের বিষয়টা চিন্তা করোনি। বরং আমাদের ভালো থাকার কথাই ভেবে গেছ।

একটি গান আছে, ‘বাবা মানে হাজার বিকেল আমার ছেলেবেলা…’ কিন্তু তুমি কুয়েত আর আমরা বাংলাদেশে থাকার জন্য আমার ছেলেবেলার বিকেলগুলোতে কাছে পাইনি তোমাকে। তোমার হাত ধরে কখনো স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি আমার।

প্রায়ই শুনি, প্রবাসী বাবাদের সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ক অতটা ঘনিষ্ঠ হয় না। কিন্তু তোমার আমার সম্পর্ক সেসব কথাকে হার মানায় বাবা।

আমাকে সর্বদা সব কাজে তুমি উৎসাহ দিয়েছ, আমার পাশে থেকেছ। কখনো মনে হয়নি আমরা অনেক দূরে বাস করি। পড়া শেষে বাসায় আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেলে তোমার চিন্তার শেষ ছিল না যে আমি কখন বাসায় ফিরব।

গত বছর তুমি জানতে পারলে আমি আম্মুর কাছে পুতুল চেয়েছি, কিন্তু আম্মু কিছুতেই দিতে রাজি নয়। তুমি কী সুন্দর করে আম্মুকে রাজি করিয়ে সেই পুতুল কিনে দিয়েছ।

ভাইয়া কী পরিমাণ দুষ্টুমি করত! তুমি বারবার বলতে, ‘তুই কবে ভালো হবি?’ তবু তাকে কখনো বকা দাওনি, একটিবার মারও দাওনি।

জানো বাবা, আজ ভাইয়া খুবই শান্ত হয়ে গেছে। আগের মতো আর দুষ্টুমি করে না। সে তোমায় খুব মিস করে৷ তোমার খুব ইচ্ছা ছিল ও নেভি স্কুলে পড়বে। সেই ইচ্ছাও পূরণ হয়েছে বাবা। তুমি কি সেসব দেখতে পাও?

তোমার তো গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা ছিল। তা ছাড়া আজ পর্যন্ত যাদের জন্য কাজ করে গেছ, সবাই তোমাকে খুব মিস করে। তোমার কথা বলে কাঁদে। এই পৃথিবীতে তোমার মতো মানুষ না আগে দেখেছি, না ভবিষ্যতে দেখব।

বাবা আমরা তো সবাই খুব হাসিখুশিই ছিলাম। এই নিষ্ঠুর করোনা তোমাকে আমাদের থেকে নিয়ে গেল। এক বছরে তিনটি ঈদ গেল, তোমার মতো করে কেউই শুনতে চায়নি, ‘মা কেমন কাটল ঈদ?’

আম্মু সব সময় স্নেহমমতা সবকিছু দিয়ে আমাদের কষ্টটাকে দূর করতে চায়। কিন্তু বাবা তো বাবাই, তা–ই না?

গত এক বছরে বুঝতে পেরেছি যে টাকাপয়সা বড় জিনিস নয় বাবা। তুমি যে আমাদের বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়েছ, সেটাই বড়। ১৮ বছরে তুমি আমাদের জন্য যা করেছ, তার ঋণ কি আমি শোধ করতে পারব? প্রত্যেক সন্তানের জীবনে চারটি হাত থাকে তাদের বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য। দুটি হাত আমি হারিয়েছি।

খুব ছোটবেলায় তুমিও নিজের বাবাকে হারিয়েছিলে। সব সময় বলতে, বাবা হারানোর কষ্ট কতটা, তা তুমি জানো। তুমি কখনো চাওনি সেই কষ্ট আমরা পাই। তাই আমাদের আগলে রেখেছিলে। বাবার ভালোবাসার অপূর্ণতা তুমি রাখোনি। আমি অনেক ভাগ্যবান যে তোমায় বাবা হিসেবে পেয়েছিলাম। তুমি শুধু আমাদের জন্য দোয়া কোরো, যেন তোমার মনের ইচ্ছা পূরণ করতে পারি। তোমার সততাকে ধরে রাখতে পারি।

জান্নাতে যেন তোমার সঙ্গেই থাকতে পারি বাবা। সেদিন তোমার মৃত্যুসংবাদ শুনে ভেবেছিলাম এটা মিথ্যা কথা। বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারে না। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে ভুলে গিয়েছিলাম সব। আজ জানো, ভীষণ কান্না পাই, তোমাকে কাছ থেকে দেখতে ইচ্ছা করে খুব। আজও আমি তোমায় বলতে পারিনি, বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসি। এতটা ভালোবাসি যে কখনোই পরিমাণ করা সম্ভব নয়। তোমার জন্য যদি নিজের জীবন উৎসর্গ করা সম্ভব হতো, তবে আমি সেটাই করতাম বাব। কিন্তু এভাবে তোমাকে হারিয়ে ফেলতে চাইনি।

তোমারই মেয়ে,
সাদিয়া।

লেখক: দ্বাদশ শ্রেণি, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ, খুলনা