স্কুল পালানো

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

১৬ মার্চ ২০২০।

শাদিদ, ফিহান, অন্বয় আর আমি ঠিক করেছিলাম, যেভাবেই হোক আজকে স্কুল পালাতে হবে। নাইনে ওঠার পর থেকে সবার মধ্যে একটা পাকা পাকা ভাব চলে আসছে। যেই ভাবা সেই কাজ। এই প্রথম স্কুল পালানো। সবাই তাই একটু ভয়ে ছিলাম। যদিও বড় ভাইয়াদের দেখে শিখেছি, কীভাবে স্কুল পালাতে হয়! টিফিনের বেল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে ক্লাস থেকে বের হলাম। আমাদের স্কুল মানে রংপুর জিলা স্কুল। বিশাল বড়। স্কুলের মূল ভবনের পেছনেও আছে আরও একাডেমিক ভবন ও স্কুলের হোস্টেল। স্কুল পালাতে গেলে হোস্টেলের পেছনের প্রাচীর টপকে পালাতে হয়। তারপরই রাস্তা।

মূল ভবনের পেছনের দরজায় এসে থমকে দাঁড়ালাম আমরা। কারণ আর কিছুই নয়, যে পথে যাব, সেই পথেই দাঁড়িয়ে আছেন স্কুলের ত্রাস সঞ্চারকারী আতিয়ার স্যার। যাঁর মূল কাজ টিফিনের সময় ওখানটায় দাঁড়িয়ে থাকা। যাতে কেউ স্কুল পালাতে না পারে। আমাদের আরেকটা সুবিধা ছিল, পরদিনই বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে দেয়ালপত্রিকা প্রদর্শনী হবে। সেই কাজে প্রতি ক্লাসের কয়েকজন করে বিভিন্ন বিল্ডিংয়ে দেয়ালপত্রিকায় তুলির শেষ আঁচড় দিতে ব্যস্ত ছিল। তখনই আমাদের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। স্যারের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় স্বভাবতই তিনি জিজ্ঞেস করলেন কোথায় যাচ্ছি। তা–ও আবার ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে! পাকা অভিনেতা অন্বয় স্যারকে এমনভাবে বুঝিয়ে বলল, যেন দেয়ালপত্রিকার কাজে সাহায্য করতে যাচ্ছি। কারণ, টিফিনের পর অনেকেই নিজ নিজ ক্লাসের দেয়ালপত্রিকার কাজে সাহায্য করতে যাচ্ছিল। তো স্যারকে সেটা বোঝানোর জন্য আমাদের অন্য বন্ধুরা যে ভবনটায় কাজ করছিল, সেদিকে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুদূর গিয়ে দেখি, স্যার অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। সেই সুযোগে আমরাও প্রাচীরের দিক লক্ষ্য করে ভোঁ–দৌড়। অবশেষে বহুল আকাঙ্ক্ষিত প্রাচীরের সামনে এসে দাঁড়ালাম।

শাদিদ উচ্চতায় একটু খাটো। প্রাচীরের উচ্চতা দেখে যেন আকাশ থেকে পড়ল ও। কোনোভাবেই ওই উঁচু প্রাচীর টপকাবে না সে। কী করা যায়? ভাবনায় পড়ে গেলাম আমরা। তিনজন মিলে কোনোমতে ওকে বোঝানো গেল যে আর ফেরার উপায় নেই। ক্লাসেও ফেরা যাবে না। লম্বু ফিহান খুব সহজেই প্রাচীর টপকাল। আমি আর অন্বয় প্রাচীরের এ পাশে রয়ে গেলাম শাদিদকে সাহায্য করার জন্য। শাদিদ একটা পা প্রাচীরের খাঁজে দিয়ে কোনোমতে এক ধাপ উঠল। আরেকটা পা অন্য একটা খাঁজে দিয়ে আরেকটা ধাপ উঠে যেই না হাতের ওপর ভর করে শরীরটাকে পুরো তোলার চেষ্টা করছিল, তখনই হাত ফসকে পপাত ধরণিতল! ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। একেবারে প্রাচীরের ওই পাশে। প্রথমবারের মতো স্কুল পালানো গেল!

সেদিনের কথা মনে পড়লে এখনো হাসি পায়। সেদিন কে জানত ওই দিনটাই ২০২০ সালে স্কুলে যাওয়ার শেষ দিন হয়ে থাকবে!

লেখক: দশম শ্রেণি, রংপুর জিলা স্কুল, রংপুর