বিয়ারিং প্যাড কী, মেট্রোরেলে বিয়ারিং প্যাড কেন লাগে
ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের একটি বিয়ারিং প্যাড পড়ে এক পথচারীর মৃত্যু হয়েছে।
রোববার (২৬ অক্টোবর ২০২৫) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
এর পরপরই সতর্কতার জন্য উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের সব চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তেজগাঁও থানার ওসি মোবারক হোসেন জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলেই ওই পথচারীর মৃত্যু হয়। এখনো তাঁর পরিচয় জানা যায়নি।
এর আগেও ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফার্মগেটের কাছাকাছি একইভাবে একটি বিয়ারিং প্যাড পড়ে গিয়েছিল। তখনো ১১ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়েছিল।
বিয়ারিং প্যাড কী
বিয়ারিং প্যাড হলো একধরনের মোটা রাবারের তৈরি বিশেষ উপাদান, যা রাখা হয় মেট্রোরেলের উঁচু পিলারের মাথা আর তার ওপরের কংক্রিট কাঠামোর (ট্র্যাক বা ভায়াডাক্ট) মাঝখানে।
এই প্যাডের কাজ হলো —
• ট্রেন চলার সময় সৃষ্ট ঝাঁকুনি ও কম্পন শোষণ করা,
• গরম-ঠান্ডায় কাঠামোর প্রসারণ ও সংকোচন সহ্য করা,
• পিলার ও ট্র্যাকের সংযোগে নমনীয়তা বজায় রাখা।
প্রতিটি বিয়ারিং প্যাডের ওজন প্রায় ১৪০ থেকে ১৫০ কিলোগ্রাম।
একটি প্যাড নষ্ট হলে পুরো কাঠামোতে ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে—যার ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে।
আগে থেকেই ছিল উদ্বেগ
মেট্রোরেল প্রকল্পে ব্যবহৃত এই বিয়ারিং প্যাডের মান নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্ন উঠেছিল।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
তখন তাঁরা জানান, ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যে বিয়ারিং প্যাড সরবরাহ করছে, তার কিছু নমুনা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরীক্ষায় মান অনুযায়ী পাওয়া যায়নি।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ তখন পরীক্ষায় দেখতে পায়—দুটি নমুনা প্যাড পরীক্ষায় পাস করেনি।
এই ইতাল-থাই কোম্পানির আগেও থাইল্যান্ডে একটি নির্মাণ দুর্ঘটনার রেকর্ড ছিল, যেখানে শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন।
তবু পরবর্তী সময়ে তাদের দিয়েই মেট্রোরেলের কিছু অংশে কাজ করানো হয়।
এখন আবারও সেই বিয়ারিং প্যাড থেকেই ঘটল ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
কেন বিপজ্জনক
বিয়ারিং প্যাড খুলে গেলে বা পড়ে গেলে পুরো লাইন সামান্য নিচে নেমে যেতে পারে বা সরে যেতে পারে।
ফলে ট্রেনের ওজনের চাপ সঠিকভাবে ভাগ হয় না এবং কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে।
এ কারণে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি (ডিএমটিসিএল) ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে, যতক্ষণ না নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
মেট্রোরেল প্রকল্প সংক্ষেপে
• মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য: ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার
• রুট: উত্তরা তৃতীয় পর্ব, পল্লবী, রোকেয়া সরণি, ফার্মগেট, শাহবাগ, মতিঝিল
• পরিচালন সংস্থা: ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)
• প্রতি ঘণ্টায় দুই দিক মিলিয়ে যাত্রী বহন: প্রায় ৬০ হাজার জন।
সতর্ক থাকো
মেট্রোরেলের নিচ দিয়ে হাঁটার সময় বা গাড়ি চালানোর সময় সতর্ক থাকা দরকার।
যদি কোথাও নির্মাণকাজ চলছে বা কাঠামো থেকে কিছু পড়ার ঝুঁকি থাকে, সেই স্থান এড়িয়ে চলাই ভালো।
কারণ, বড় বড় কাঠামোর এক ছোট অংশও (যেমন বিয়ারিং প্যাড) অনেক ভারী হতে পারে এবং মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।
একটি ছোট রাবারের প্যাড—দেখতে সাধারণ মনে হলেও তার ওপর ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের স্বপ্নের মেট্রোরেল।
এই দুর্ঘটনা মনে করিয়ে দেয়, বড় প্রকল্পের সাফল্যের জন্য মান, নিরাপত্তা আর যত্ন—সবটাই সমান জরুরি।
প্রকৌশল পাঠ: বিয়ারিং প্যাডের বিজ্ঞান
মেট্রোরেল বা বড় কোনো সেতু তৈরির সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটি হলো, কাঠামোকে স্থিতিশীল রাখা।
রেললাইন বা সেতুর ওপর দিয়ে ভারী গাড়ি বা ট্রেন চললে পুরো কাঠামো একটু নড়ে ওঠে।
এই নড়াচড়ার ধাক্কা যদি সরাসরি পিলারে পড়ে, তাহলে কংক্রিটে ফাটল ধরতে পারে।
তাই প্রকৌশলীরা ব্যবহার করেন বিয়ারিং প্যাড—
একটি মোটা, শক্ত রাবার ও ইস্পাতের সংমিশ্রণে তৈরি উপাদান।
এটি করে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ:
১. কম্পন শোষণ করে—ট্রেনের চাকার কম্পন যেন কাঠামোতে আঘাত না হানে।
২. তাপমাত্রার পরিবর্তন সামলায়—গরমে লোহা প্রসারিত হয়, ঠান্ডায় সংকুচিত হয়; প্যাড সেই পরিবর্তন সহজে সহ্য করে।
৩. নমনীয়তা দেয়— পিলার ও ভায়াডাক্ট (লাইন ধরে রাখা কংক্রিট অংশ) একসাথে থেকেও সামান্য নড়াচড়া করতে পারে।
বিয়ারিং প্যাড দেখতে সাধারণ রাবারের ব্লকের মতো, কিন্তু এর ওজন প্রায় ১৪০ থেকে ১৫০ কিলোগ্রাম।
এর ভেতরে থাকে শক্ত রাবার ও ইস্পাতের স্তর, যা একে করে তোলে টেকসই ও নমনীয় দুইই।
একটি বিয়ারিং প্যাড ঠিকঠাক না থাকলে কী হয়
তাহলে কাঠামোর ভারসাম্য নষ্ট হয়।
পিলারের ওপরের ভার সঠিকভাবে বণ্টিত না হলে ওপরের ট্র্যাক সরে যেতে বা নিচে বসে যেতে পারে।
এমন দুর্ঘটনা ঘটলে ট্রেন চালানো একেবারেই নিরাপদ নয়।
তাই প্রকৌশলের নিয়ম হলো—
‘ছোট অংশও বড় কাঠামোর প্রাণ।’
মেট্রোরেলের এই বিয়ারিং প্যাডই তার সবচেয়ে নীরব কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর একটি।