মা, তোমাকে খুব ভালোবাসি

মা, তুমি হয়তো ভাবছ, তুমি আমাকে যত ভালোবাস, আমি তোমাকে ঠিক ততটা ভালোবাসি না। কিন্তু জেনে রাখো, মা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। যতটা ভালোবাসা সম্ভব, তার চেয়ে বেশি। ভালোবাসি মনে মনে, ভালোবাসি সর্বান্তকরণে, কিন্তু হয়তো বলে উঠতে পারি না। বলাটা হয়ে ওঠে না।

তুমি হয়তো বলবে, ‘সে কী কথা! তুই তো আমাকে সকাল-বিকাল বলিস না যে তুই আমাকে ভালোবাসিস। তোর কথায়ও তো সেটা ফুটে ওঠে না। তোর ভাবে-ভঙ্গিতেও তো আমি বুঝে উঠতে পারি না যে তুই আমাকে এতটুকু পাত্তা দিস।’ তুমি এ রকম বলতে পারো বটে। আর তা যদি বলো, হাতে-কলমে তোমার কথাটাকে মিথ্যা প্রমাণ করা আমার জন্য মুশকিল।

কিন্তু বাতাস যে আছে, সেটা কি আমরা চোখে দেখি? আমরা তো বাতাসের সমুদ্রে ডুবে আছি। বাতাস যেমন চোখে দেখা যায় না, তেমনি তোমার জন্য আমার ভালোবাসাটাও হয়তো অনুভব করতে পারা যায়। আর আমি জানি, তুমিও খুব ভালো করে জানো, তোমার জন্য আমার টানটা কত বেশি। আর এই অপরিসীম মায়ার কথা ঠিক বলে বোঝানোও যাবে না। বলার মতো নয়। এটা তোমার আর আমার মধ্যে একটা গোপন রসায়ন, যেটা তুমিও বোঝো। আমিও বুঝি।

আমি কিন্তু ঠিকই জানি, মানি, এটা বলে বেড়ানোর মতো কথাও নয়, এটা একেবারে ‘সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে’র মতো সত্য যে তুমিই আমার পৃথিবী। আর এটাও আমি জানি, আমিই তোমার পৃথিবী।

তোমার সবকিছু আমার ভালো লাগে। তুমি আমাকে দশ মাস পেটে ধরে রেখেছ, এটা আমাকে বলে দিতে হবে না। তোমার পেটে যখন ছিলাম, তোমার দেহের খাবার খেয়েই তো আমি পুষ্ট হয়েছি। তুমি কত কষ্ট পেয়েছ, কিন্তু আমি যেন কষ্ট না পাই, সে জন্য তোমার কত যত্ন ছিল, খেয়াল ছিল, সাবধানতা ছিল। তারপর তোমাকে অনেক ব্যথা দিয়ে আমি জন্ম নিলাম। একেবারে অসহায় ছোট্ট একটা বাচ্চা! এত্তটুকুন! তুমিই আমাকে বুকে জড়িয়ে রাখলে। তোমার স্তন্য পান করালে। আমি তোমার শরীরের ওমে ওমে বড় হতে লাগলাম। সারা রাত আমার জন্য তোমাকে জেগে থাকতে হতো। কত কষ্ট করেছ। আমাকে গোসল করিয়েছ, আমার কাঁথা–কাপড় বদলে দিয়েছ। তারপর একটু একটু করে আমি খেতে শুরু করলাম। কত যত্ন করে আমাকে খাইয়েছ। সেই যে একটা কথা প্রচলিত আছে, গরুর বাছুর জন্ম থেকেই গরু, হাঁসের বাচ্চা জন্ম থেকেই হাঁস, কিন্তু মানুষের বাচ্চা অনেক যত্ন–চেষ্টার পর মানুষ। সত্যি তো, বাছুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাঁটতে পারে, হাঁসের ছানা সাঁতার কাটতে পারে, কিন্তু আমরা, মানুষের বাচ্চারা, হাঁটতে শিখি এক বছর পর, কিন্তু নিজে নিজে চলতে পুরোপুরি কোনো দিনও কি পারি? এই যে আমি ভাবি, এখন বড় হয়ে গেছি, একা একা স্কুলে যাই, কিন্তু তার পেছনে সব সময় কি তুমি নেই? তোমার মুখের কথা শুনে শুনে আমি কথা বলা শিখেছি। তুমি আমাকে একটু একটু করে মুখে তুলে খাইয়েছ। তুমি আমাকে কাপড় পরিয়েছ। তুমি আমাকে পড়তে শিখিয়েছ। তুমি আমাকে লিখতে শিখিয়েছ।

এখনো, তুমি আমার সবকিছুর যত্ন নাও। সবকিছুর ব্যাপারে খেয়াল রাখো। আমার পরের দিন স্কুল আছে কি না, কোন জামাটা পরে যাব, কোন বইটা লাগবে, কোন বিষয়ে আমি খারাপ করছি, সব বিষয়ে তোমার খেয়াল। আমার জ্বর হলে তুমি কী রকম উদ্বিগ্ন হও। আমার সুস্থতার জন্য কত কী না করতে থাকো! আমার কপালে পানিপট্টি দেওয়া, আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, ওষুধ খাওয়ানো এসব তো আছেই। আমার জন্য কত না দোয়া করো! আমার মন খারাপ হলে তোমার মন খারাপ হয়। আমি একটা জিনিস চাইলে তুমি যদি তা দিতে না পারো, তাহলে তুমি কত না দমে যাও।

সত্য বটে, তুমি মুখে আমাকে সারাক্ষণ শাসন করো। ‘এই, এইভাবে কেউ খায়? ভালো করে মুছে খা। এইটা কী রকম লেখার ছিরি হলো! এই, সারা দিন কেন মুঠোফোনে মুখ গুঁজে থাকিস! এই, এখন কি টিভি দেখার সময়! এই, স্যান্ডেল কেউ এইভাবে রাখে! এই, নিজের টেবিলটা গুছিয়ে রাখতে পারিস না?’ সব সময় তুমি আমাকে ঝাড়ির ওপর রাখো। আমি কি বুঝি না, এটাই তোমার আদরের স্টাইল। সব সময় তো তুমি আমাকে কোলে করে নিয়ে ঘুরবে না, সব সময় আমাকে চুমু খাবে না। তুমি চাও, আমি যেন জীবনে সফল হই। তাই তুমি আমাকে শক্ত–পোক্ত করতে চাও, ‘যা, পড়তে বস।’ এসব কী হচ্ছে থেকে শুরু করে পিঠে দু–চারটা যে কখনো বসাওনি, তা–ও নয়। কিন্তু এ তোমার আর আমার নিজস্ব ব্যাপার। এটা তুমি আর আমি বুঝি।

মা, তোমার সবকিছু আমার ভালো লাগে। তোমার গায়ের গন্ধ পর্যন্ত। কিন্তু আমি তা বলি না। আমিও ঝাড়ি দিয়েই কথা বলি। কখনো বলি না, মা, মা, আমার খিদে পেয়েছ, মা আমাকে কি দয়া করে খেতে দেবে? বরং গলায় ঝাঁজ তুলে বলি, মা, দেখতে পাচ্ছ না আমার খিদা পাইসে, খাবার দাও না কেন? মায়েদের সঙ্গে ছেলেমেয়েরা এভাবেই কথা বলে। এটা কিন্তু খারাপ ব্যবহার নয়। এটা হলো আহ্লাদ। আমি যে তোমার পেটের ভেতর ছিলাম। তোমার শরীরের একটা অংশ আমি, তোমার শরীরের বাইরে ঘুরছি। আমি তো তোমাকে হুজুর হুজুর প্লিজ প্লিজ বলে কথা বলব না। আমি ধরেই নেব, আমার খিদে পাওয়ার আগে তুমি আমার খিদে বুঝতে পারবে আর আমার জন্য খাবার নিয়ে আমাকে সাধাসাধি করবে। আমি এটা-ওটা নিয়ে ব্যস্ততার ভাণ করে বলব, মা, খাবো তো! অস্থির হচ্ছ কেন।

আমি যখন খাই, তুমি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে। কখনো আবার আমার মুখে খাবার তুলে দেবে। আমি খাব, তুমি দেখবে। আমি খেলে সেই খাবার তোমার পাকস্থলীতেই যাবে। তোমার পেট ভরে যাবে। সন্তান খেলে মায়ের পেট ভরে, এটা আমি জানি। সন্তান খুশি হলে মায়ের মন ভরে যায়, এটাও আমি জানি, মা। আমার সুখেই তোমার সুখ। আমার সাফল্যেই তোমার সাফল্য। তুমি চাও, আমি সফল হই। আমার ভালো হোক। পৃথিবীর সব মা–বাবা চান, সন্তানের মঙ্গল হোক। কাজেই মা, তুমি, আমাকে অনেক কাজ করতে আদেশ করো, অনেক কাজ করতে মানা করো। আমি জানি, তুমি যা করছ, আমার ভালোর জন্য।

আমি যদি তোমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দিই, তাতেই তোমার জগৎ হাসির আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমি যদি তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি, তুমি কতই না খুশি হও। আচ্ছা, এবার থেকে আমি তোমাকে একটু নিয়ম করেই জড়িয়ে ধরব। একটু নিয়ম করেই বলব, মা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তুমি যাতে খুশি হও, তা–ই করব।

বলছি বটে, কিন্তু আমি আবার ভুলে যাব। আবার তোমার সঙ্গে গলা চড়িয়ে কথা বলব। কিন্তু আমি জানি, তুমি মনে মনে ঠিক জানো, আমি তোমাকে কত ভালোবাসি। আর আমিও জানি, তুমি আমাকে কত ভালোবাসো।

সামনে নাকি বিশ্ব মা দিবস। মা, আমার প্রতিটা দিনই মা দিবস।

ওই গানটা আছে না, মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে, মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে।

আসলেই, চাঁদের যে জ্যোৎস্না, তার চেয়ে মা, তোমার হাসি সুন্দর। তোমার হাসি নিয়েই চাঁদ আলো হিসেবে ছড়িয়ে দেয়। আর আমার তোমাকে মনে করতে হয় না, আমার মনে তোমাকে পড়তে হয় না, তুমি আমার মনেই থেকো। তুমি আর আমি যে একই সত্তা। অভিন্ন।

মা, ভুল করি। দোষ করি। আমি জানি, তুমি মনে রাখো না। তুমি মনে কোনো কষ্ট রেখো না। আমি কখনো তোমাকে কষ্ট দেব না। তোমার কথা শুনব। আর বড় হয়ে তোমার সব কষ্ট আমি দূর করে দেব।

তুমি, আমার মা, পৃথিবীর সেরা মা।

আমি তোমার শ্রেষ্ঠ সন্তান নই। কিন্তু আমি জানি, তোমার চোখে আমিই সেরা। আমার অনেক চুমু নাও। ভালোবাসা জেনো।