যত চুরি ল্যুভর্ জাদুঘরে

প্যারিসের ল্যুভর জাদুঘরফাইল ছবি: রয়টার্স

মাত্র চার মিনিটের একটি চুরির ঘটনা শোরগোল ফেলে দিয়েছে। বলা হচ্ছে, আধুনিক কালের অন্যতম চমকপ্রদ চুরির এটা। ঘটনাস্থল ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের ঐতিহাসিক ল্যুভর জাদুঘর। সময়টা গতকাল রোববার, ১৯ অক্টোবর, সকালে। জাদুঘরটি থেকে চোখের পলকে চুরি হয়ে যায় নেপোলিয়ন যুগের অলংকার।

এর মধ্যে রয়েছে ফরাসি রাজপরিবারের বহু পুরোনো অলংকার—এমেরাল্ড নেকলেস ও কানের দুল, যা নেপোলিয়ন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মারি লুইজকে বিবাহের সময় উপহার দিয়েছিলেন। এখন ফ্রান্সজুড়ে প্রশ্ন উঠেছে—কীভাবে মুখোশধারী চোরেরা কড়া নিরাপত্তা এড়িয়ে এত অমূল্য সম্পদ চুরি করতে পারল?

যদিও ল্যুভরের ইতিহাসে এটাই প্রথম চুরির ঘটনা না। এর আগেও কয়েকবার এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এ জাদুঘর।

ল্যুভর: দুর্গ, রাজপ্রাসাদ থেকে জাদুঘর

ল্যুভর নির্মিত হয়েছিল ১২ শতকে। দুর্গ হিসেবে। পরে সেটি রাজপ্রাসাদ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে। তবে আধুনিক জাদুঘর হিসেবে ল্যুভরের যাত্রা শুরু হয় ১৭৯৩ সালে, ফরাসি বিপ্লবের পর। ১৭৯২ সালে বিক্ষুব্ধ জনতা রাজা ষোড়শ লুই ও রানি মারি অঁতোয়ানেতের প্রাসাদ দখল করে নেয়। রাজতন্ত্রের অবসান ঘটায়। ওই সময় রাজপরিবারের সংগ্রহে থাকা সব শিল্পকর্ম রাষ্ট্রের সম্পত্তি হয়ে যায়।

রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক সম্পদ রক্ষা ও সংরক্ষণের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে ল্যুভর জাদুঘর। আধুনিক গণতান্ত্রিক ফ্রান্সের আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রগুলোর একটি এটি। প্রতিবছর দেশি–বিদেশি লাখো পর্যটক ল্যুভরে ঘুরতে যান।

১৯১১ সাল: ‘মোনালিসা’ চুরি

ল্যুভরের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত চুরির ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯১১ সালের ১১ আগস্ট সকালে। সেদিন জাদুঘরটি থেকে চুরি হয়ে যায় জগদ্বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘মোনালিসা’।

ইতালীয় কর্মী ভিনচেনজো পেরুজ্জিয়া, যিনি অল্প সময়ের জন্য জাদুঘরটির ফ্রেম ও কেস তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন, পুরোনো ইউনিফর্ম পরে ল্যুভরে ঢোকেন এবং মোনালিসা চিত্রকর্মটি চুরি করে বেরিয়ে যান।

সেই সময় চিত্রকর্মটি ‘Salon Carr’éনামের কক্ষে ঝুলছিল। মাঝেমধ্যে রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা ফটোগ্রাফির জন্য সরানো হতো—তাই প্রথমে কেউ খেয়াল করেনি। এক ধনী দর্শক যখন পরের দিন গ্যালারিতে ছবির কাজ করার জন্য আসেন, তখনই দেখা যায়, দেয়ালে শুধু ফ্রেমের হুক রয়ে গেছে।

পেরুজ্জিয়া চিত্রকর্মটি নিজের অ্যাপার্টমেন্টে দুই বছর লুকিয়ে রাখেন। ১৯১৩ সালে তিনি অন্য জাদুঘরে সেটি বিক্রি করার চেষ্টা করেন। তখন চিত্রকর্মটি উদ্ধার করা যায়। পেরুজ্জিয়া দাবি করেন, দেশপ্রেমের কারণে মোনালিসা চুরি করেছিলেন। যদিও মোনালিসা আসলে ফ্রান্সে তৈরি হয়েছিল। ১৫১৮ সালে ফরাসি রাজা ফ্রান্সিস প্রথম সেটি কিনেছিলেন।

তদন্তের সময় যুবক পাবলো পিকাসোকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কারণ, এর আগে তিনি ল্যুভর জাদুঘর থেকে চুরি হওয়া দুটি প্রাচীন মূর্তি কিনে নিয়েছিলেন।

ফ্রান্সের ল্যুভর জাদুঘরের প্রবেশ দ্বারের সামনের কাচের পিরামিডের পাশ দিয়ে হাঁটছেন পর্যটকেরা। প্যারিস, ২ নভেম্বর, ২০২৩
ছবি: রয়টার্স

নাৎসিদের দখলে

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ১৯৪০ সালে ফ্রান্সে নাৎসি জার্মান বাহিনী প্রবেশ করলে ল্যুভরের সংগ্রহশালা ঝুঁকির মুখে পড়ে। তবে তৎকালীন পরিচালক জ্যাক জোঝার আগেভাগে ১ হাজার ৮০০টির বেশি কাঠের বাক্সে মূল্যবান শিল্পকর্ম অন্যত্র সরিয়ে নেন।

নাৎসিরা প্যারিসে ঢোকার পর জাদুঘরটি প্রায় খালি অবস্থায় পায়। এরপরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্ম নাৎসিদের হাতে যায়। পরে সেসব স্পেনে পাঠানো হয়। এর মধ্যে বার্তোলোমে মুরিওর ‘The Immaculate Conception of Los Venerables’ ছিল।

বিশ্বযুদ্ধের পরেও চুরি

১৯৬৬: যুক্তরাষ্ট্রে প্রদর্শনের পর ফেরত আনার পথে বেশ কিছু প্রাচীন গয়না খোয়া যায়। পরে নিউইয়র্কের একটি মুদিদোকানে সেগুলো পাওয়া যায়।

১৯৭৬: জানুয়ারিতে একটি ফ্লেমিশ চিত্রকর্ম চুরি হয়। ডিসেম্বর মাসে মুখোশধারী চোরেরা জাদুঘরের দ্বিতীয় তলার স্ক্যাফোল্ডিং ব্যবহার করে রাজা দশম চার্লসের হীরাখচিত তলোয়ার চুরি করে, যা এখনো উদ্ধার হয়নি।

১৯৯০: দিনের আলোয় ছোট একটি রেনোয়া ছবি চুরি হয়। সঙ্গে প্রাচীন রোমান গয়না ও কয়েকটি ছবিও খোয়া যায়।

১৯৯৮: ক্যামিল কোরোতের ‘Le Chemin de Sèvres’ শিল্পকর্মটি ফ্রেম কেটে চুরি করা হয়, যা এখনো উদ্ধার হয়নি।

২০২৫ সালের চুরি

মুখোশধারী চোরেরা গতকাল রোববার নেপোলিয়ন যুগের একাধিক মূল্যবান রত্ন, অলংকার চুরি করে। এর মধ্যে একটি এমেরাল্ড ডায়মন্ড নেকলেস ছিল, যা নেপোলিয়ন তাঁর স্ত্রী ইউজেনিকে উপহার দিয়েছিলেন। এ পর্যন্ত কেবল একটি টায়রা উদ্ধার হয়েছে—তা–ও ভাঙা অবস্থায়। বাকিগুলোর কোনো হদিস নেই।

তবে আশার কথা, হারানো শিল্পকর্ম ফেরত পাওয়ার ইতিহাস রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৮৩ সালে চুরি হওয়া একটি ইতালিয়ান রেনেসাঁ বর্ম ২০২১ সালে এসে ফ্রান্সের এক ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে উদ্ধার করা হয়।

ল্যুভরের দীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে চুরি ও চোরের সঙ্গে লড়াই করে সাংস্কৃতিক সম্পদ রক্ষার গল্প জড়িয়ে আছে। যতই কাচের দেয়াল, সেন্সর আর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হোক না কেন, অমূল্য শিল্পের প্রতি লোভ ও রোমাঞ্চ—দুটোই সব সময় দেখা গেছে। তাই ফরাসি জাতীয় ঐতিহ্য রক্ষার এ লড়াইও চলছে।

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক থেকে