সজ্জন বাবা ও আমি

অলংকরণ: আপন জোয়ার্দার

জন্মের পর থেকে বাবাকে দেখিনি। ছয় বছর বয়সে যখন আমাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়, তখন আমি দেখতাম আমার বন্ধুদেরকে তাদের মা–বাবা স্কুলে নিয়ে যেত। কিন্তু আমি যে একা স্কুলে যেতাম, এমনটা নয়। আমাকে আমার দাদু স্কুলের কিছুটা পথ এগিয়ে দিয়ে আসত, এ কারণে আমার ভীষণ মন খারাপ হতো। আর মনে মনে বলতাম, সবারই মা–বাবা সবাইকে স্কুলে নিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত তো আমার বাবাকেই আমি চোখের দেখাও দেখলাম না ভালো করে। তার পরদিন আমি আমার মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মা, তুমি আমায় কখনো স্কুলে নিয়ে যাও না কেন?’ মা বলল, ‘আমি তো ভীষণ রকমভাবে কাজে ব্যস্ত থাকি। তাই তোমাকে নিয়ে যাওয়া হয় না স্কুলে। আর আমি স্কুলে নিয়ে যাই না তো কী হয়েছে? দাদি তো তোমায় প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যায়, একজন নিয়ে গেলেই তো হয় তাই না!’

আমি তখন চুপ হয়ে বসে রইলাম কিছু না বলে, আর ভাবতে থাকলাম মায়ের আদর তো প্রায় সব সময়ই পাই। কিন্তু আমার বাবার আদর তো কখনোই পাইনি? বাবা কেমন তা-ও জানি না। তবে মায়ের কাছ থেকে শুনেছি, বাবা নাকি কাজের সূত্রে দূরের কোনো একটা দেশে গেছে। সেখান থেকে নাকি খুব তাড়াতাড়ি ফেরা যায় না।

বাবার সঙ্গে খুব একটা কথা হতো না; কারণ, ঘরে ঘরে তখন মুঠোফোন ছিল না। দাদা বাজারের কোনো একটা দোকান থেকে বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলে আসত, বাসায় এসে দাদুকে বলত যে তাদের ছেলে ভালো আছে, চিন্তা যেন না করে। বাবার সঙ্গে মায়েরও তেমন কথা হতো না। মা যখন মামার বাসায় যেত, তখন একটু কথা বলতে পারত।

তারপর যখন একটু বড় হলাম, তখন আমার বাবা বিদেশ থেকে একটা মুঠোফোন পাঠাল। তখন বাবার সঙ্গে হয়তো কথা হতো কিন্তু মন থেকে কখনোই কথা বলতে চাইতাম না আমি। মা জোরপূর্বক আমাকে দিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলাত। বাবার সঙ্গে আমার খুব অভিমান হয়েছিল। আমার পাশের বাসার বন্ধুর বাবাকে দেখতাম রোজ তাদের জন্য সন্ধ্যায় নাশতা নিয়ে আসত, মাঝেমধ্যে তাদের ঘুরতে নিয়ে যেত।

আমাকে যে অভাবে রেখেছে তা কিন্তু না, চাওয়ার আগেই সবকিছু পেয়ে যেতাম। তবু তাতে আমার মন শান্ত থাকত না। কারণ, আমি তো এত কিছু চাই না। শুধু বাবাকে দেখতে চাই। একটু মনভরে বাবার ভালোবাসা পেতে চাই, বাবা আজ যেন থেকেও নেই। কেউ বুঝতেই চায় না আসলে আমি কী চাই।

আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন আমার বাবা দেশে এল। আমাকে প্রথমে দেখেই জড়িয়ে ধরল বাবা, কিন্তু তখনো আমার মধ্যে বাবার প্রতি কোনো অনুভূতি কাজ করছিল না। আমার খুব অভিমান হয়েছিল। প্রথম প্রথম বাবার সঙ্গে মিশতেই পারছিলাম না। বাবা আমাকে ডাকলে কাছে যেতে চাইতাম না। কেমন যেন একটা মনে হতো।

কিছুদিনের মধ্যেই বাবার সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে ওঠে। বাবার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া, ক্রিকেট খেলা, খাওয়াদাওয়া সবই হচ্ছিল। বাবা যেন একমুহূর্ত আমাকে ছাড়া থাকতে পারত না। বাবা এসেছিল তিন মাসের ছুটিতে। সময়টা যে কখন কেটে গেল, বুঝতেই পারিনি।

যখন বাবার চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এল, তখন আবার একটা ভয় কাজ করত। বাবার সঙ্গে তো আর দেখা হবে না। কখন যে দেখা হবে, তারও কোনো ঠিক নেই।

বাবা যেদিন চলে যাবে, সেদিন বাবাকে আমি প্রশ্ন করলাম, ‘বাবা, তুমি তো আমায় কখনো দেখোনি, না দেখেই এত ভালোবাসো! এতই যদি ভালোবাসো, তাহলে দূরপ্রবাসে পড়ে থাকো কেন?’

বাবা তখন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলল, ‘বাবা রে, অভাব। ছোটবেলায় অভাবে অভাবে বড় হয়েছি তো, আমার ছেলেমেয়েরা যাতে সে অভাব বুঝতে না পারে, সে জন্যই আমি দূরপ্রবাসে পড়ে থাকি।’

আমারও তো ইচ্ছা হয় নিজের পরিবার ও দেশের কাছে থাকতে। তখন বাবার কথা শুনে আমি মাটির দিকে নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে রইলাম। অজান্তেই চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা জল পড়ল। তখন বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল।

‘বাবা, আমার একটুও তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছা করছে না। তোমাকে খুব মিস করব।’ বাবা বলল, ‘মন খারাপ করার কিছুই নেই। এখন তো আর সেই আগেকার যুগ নেই যে আমাদের কথা হবে না। এখন থেকে আমাদের প্রতিদিনই কথা হবে।’ সর্বশেষ বাবা একটি কথাই বলল, ‌‘ভালো থেকো।’ তারপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

অদ্ভুত একটা মায়া কাজ করছিল বাবার প্রতি। আর মনে মনে ভাবতে থাকলাম, বাবারা বুঝি এমনই হয়। সন্তানদের এভাবেই তারা ভালোবাসে।