হুমায়ূন আহমেদের দরজার নিচে চিঠি দিয়ে এসেছিলাম
স্কুলের পিকনিকে আমার কখনোই যাওয়া হতো না। মা যেতে দিতেন না কখনো। ক্লাস টেনে উঠে শুনলাম, এবার পিকনিক হবে নুহাশপল্লিতে। যদিও পিকনিকে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না আমার। আমি তো জানি, মা যেতে দেবেন না। কিন্তু ক্লাসে স্যার যখন বললেন, ‘ওখানে কে থাকবেন জানিস? হুমায়ূন আহমেদ!’ শুনেই আমি নাম দিয়ে দিলাম। এই পিকনিকে যেতেই হবে। হুমায়ূন আহমেদের অটোগ্রাফ নেওয়ার শখ আমার বহুদিনে। বাসায় এসে বহুকষ্টে রাজি করালাম মা-বাবাকে। অনেক অনুরোধ, ভালো ফলের আশ্বাস দিয়ে অবশেষে রাজি করানো গেল তাঁদের।
স্কুলের বাসে করে গিয়ে দেখি, কী সুন্দর নুহাশপল্লি! সুইমিংপুল, পুকুর, ট্রি হাউস, ঢাউস দাবার বোর্ড—সবই দেখা হলো, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদকে তো দেখছি না। উনি কোথায়? স্যাররা বললেন, ‘আরে বোকা, ওনার কি এত সময় আছে যে তোদের সঙ্গে বসে পিকনিক করবেন? উনি ঢাকায়।’
সেদিন চোখের সামনে হুমায়ূন আহমেদকে দেখে অটোগ্রাফ নিতে খুব ইচ্ছা করছিল। কিন্তু আমরা কেউই নড়তে পারছিলাম না। প্রিয় লেখককে দেখার উত্তেজনা নয়, প্রচণ্ড ভিড় এককোণে আটকে রেখেছিল আমাদের।
সেটাও ঠিক। কী করা যায় তাহলে? নুহাশপল্লির কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে খুঁজে বের করলাম হুমায়ূন আহমেদের ঘর। একটা চিঠি লিখে ঢুকিয়ে দিলাম সেই ঘরের দরজার নিচ দিয়ে। ভাবলাম, উনি ঘরে ঢুকলে নিশ্চয়ই দেখবেন এবং আমার চিঠিটাই পড়বেন! কী দারুণ ব্যাপার! পরবর্তী কয়েক দিন খুব ভাবে ছিলাম—হুমায়ূন আহমেদকে চিঠি লিখেছি আমি! বন্ধুরাও পিঠ চাপড়ে দিত—দোস্ত, তোর কী বুদ্ধি! ইশ! আমার নামে একটা চিঠি যদি লিখে দিতি!
বড় হয়ে টের পেয়েছি, সেই চিঠি হুমায়ূন আহমেদের কাছে পৌঁছানোর সম্ভাবনাই ছিল না। কারণ, উনি আসবেন শুনলেই নুহাশপল্লির কর্মীরা তাঁর ঘর পরিপাটি করে রাখে। সেখানে একটা চিরকুট পড়ে থাকতে দেখলে সেটার গন্তব্য একটাই—ডাস্টবিন।
তবে কয়েক বছর পর বইমেলায় একবার হুমায়ূন আহমেদকে দেখেছিলাম। সম্ভবত ২০০৯ সালে। আমি আর আমার বন্ধু পাভেল মেলায় ঘুরছি, হঠাৎ একটা জনস্রোত আমাদের ঠেলে একটা স্টলের পাশে দাঁড় করিয়ে দিল। কী ব্যাপার? চারপাশে হইচই—হুমায়ূন আহমেদ আসছে। হুমায়ূন আহমেদ! আমরা কয়েক হাত দূর থেকে দেখলাম, হুমায়ূন আহমেদ অন্যপ্রকাশের স্টলে এসে বসলেন। স্টলের ভেতরে–বাইরে প্রচণ্ড ভিড়। ভিড়ের মধ্যেই একটার পর একটা অটোগ্রাফ দিচ্ছেন লেখক।
সেদিন চোখের সামনে হুমায়ূন আহমেদকে দেখে অটোগ্রাফ নিতে খুব ইচ্ছা করছিল। কিন্তু আমরা কেউই নড়তে পারছিলাম না। প্রিয় লেখককে দেখার উত্তেজনা নয়, প্রচণ্ড ভিড় এককোণে আটকে রেখেছিল আমাদের। এমনই ভিড় যে সামনে–পেছনে কোথাও এগোনোর উপায় নেই। পুরো মেলাটা যেন হেলে পড়েছিল অন্যপ্রকাশের স্টলের সামনে। চিৎকার, চেঁচামেচি, ধাক্কাধাক্কি। সবাই সামনে যেতে চাইছে। আমরা কোনোমতে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছি। অন্য স্টলের বিক্রেতাদের মুখে বিস্ময়। অনেকে বিশ্বাসই করতে পারছে না যে হিমু-মিসির আলির লেখক তাদের সামনে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল দেখে দ্রুতই চলে গেলেন হুমায়ূন আহমেদ। তবু আমরা আরও কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
বিশ্বাস করার কথাও নয়। তখন প্রায় প্রতিদিনই মেলায় যেতাম। প্রতিদিনই গুজব শোনা যেত, আজ হুমায়ূন আহমেদ আসবেন। সবার মধ্যে একটা উত্তেজনা। কোথাও একটু জটলা দেখলেই মনে হতো, এই বুঝি হুমায়ূন আহমেদ এসেছেন। ছুটে গিয়ে দেখতাম, টিভি ক্যামেরায় সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন অন্য কেউ।
অথচ সেদিন সত্যি সত্যি হুমায়ূন আহমেদ এসেছিলেন। মনে আছে, বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও সামনে যেতে ব্যর্থ হয়েছিলাম আমরা। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম, এখানেই দাঁড়িয়ে থাকি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল দেখে দ্রুতই চলে গেলেন হুমায়ূন আহমেদ। তবু আমরা আরও কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যারা অটোগ্রাফ পেয়ে বিশ্বকাপজয়ের হাসি হাসছিল, তাদের দেখে আফসোস করছিলাম, আর ভাবছিলাম, পরেরবার দেখা হলে অটোগ্রাফ নেবই।
পরে অনেকবার বইমেলায় গিয়েছি, যাচ্ছি। কিন্তু অটোগ্রাফ আর নেওয়া হয়নি, হবেও না আর কোনো দিন। এখনো বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করেই মনে হয়, যাই, হুমায়ূন আহমেদের একটা বই কিনি। অনেকে জিজ্ঞেসও করে, ‘আরে, এই বই এত দিনেও পড়ো নাই?’
‘পড়েছি।’
‘তাহলে?’
‘এমনিই কিনলাম।’
নতুন বই তো আর আসবে না, পুরোনোটাই নাহয় কিনলাম।