আহনাফের মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে বিমানটি ৩০ ফুট দূরে পড়ে—মাইলস্টোন স্কুলের ভয়াল দুপুর

শিক্ষার্থী আহনাফ বিন হাসানপ্রতিকৃতি: আরাফাত করিম

ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২১ জুলাইয়ের সকালটা শুরু হয়েছিল অন্য সব দিনের মতোই। ক্লাসসহ অন্যান্য কার্যক্রম নিয়মমাফিক চলে।

বেলা একটা থেকে সোয়া একটা নাগাদ শিশুশিক্ষার্থীদের কেউ কেউ অভিভাবকদের অপেক্ষায় ছিল। কেউবা কোচিং ক্লাসে যাচ্ছিল। আবার কেউ হালকা নাশতা খাওয়ার জন্য বের হয়েছিল মাত্র।

কেউ ভাবতে পারেনি, এমন সময়ে এক ভয়ংকর বিপর্যয় নেমে আসবে স্কুল ক্যাম্পাসে। আর দিনটি হবে বাংলাদেশে বিমান দুর্ঘটনার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ এক দিন।

২১ জুলাই বেলা সোয়া একটার দিকে স্কুলটির একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয় বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান। এতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে।

বজ্রপাতের মতো শব্দ

সেদিন শিক্ষার্থী আহনাফ বিন হাসান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মাঠে দাঁড়িয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছিল। আহনাফ বলে, ‘মনে হচ্ছিল, আকাশ থেকে ৩০ বা ৪০টা বজ্র একসঙ্গে পড়ছে।...এমন শব্দ আমি জীবনে শুনিনি...।’

মুহূর্তের মধ্যে একটি যুদ্ধবিমান আহনাফদের মাথার ওপর দিয়ে সজোরে চলে যায়। তারপর স্কুলের একটি ভবনে আছড়ে পড়ে।

ভবনটি থেকে আহনাফ মাত্র ৩০ ফুট দূরে ছিল। আহনাফ সহজাতভাবে মাটিতে শুয়ে পড়ে। দুই হাত দিয়ে মাথা ঢেকে রাখে। পরে চোখ খুলে দেখে, চারপাশের পৃথিবী যেন পাল্টে গেছে।

বিবিসিকে আহনাফ বলে, চারদিকে শুধু ধোঁয়া, আগুন আর অন্ধকার। শিশুরা চিৎকার করছিল। সবকিছুই ছিল বিশৃঙ্খল।

আগুনের ভেতর থেকে উদ্ধার

ধোঁয়া ও আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। জ্বলন্ত বিমানের একটি টুকরা এসে আহনাফের ব্যাগে পড়ে। তার ব্যাগে, প্যান্টে আগুন ধরে যায়। হাতের চামড়া পুড়ে যায়।

আহনাফ বলে, ‘তাপটা ছিল অসহনীয়। কিন্তু আমি ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে যাই অন্যদের সাহায্য করতে।’

এ দুর্ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ‘ক্লাউড’ ও ‘স্কাই’ নামের দুটি শ্রেণিকক্ষ। ভবনের ফটকের কাছে এক ছাত্রের নিথর দেহ পড়ে ছিল।

আহনাফ বলে, ‘দেখে মনে হচ্ছিল, বিমানটি ভবনে আছড়ে পড়ার আগে তাকে আঘাত করেছিল। তারপর ভবনে ঢুকে যায়। সে আমাদের চেয়ে বয়সে ছোট ছিল।’

ধোঁয়ার মধ্যেই আহনাফ এক জুনিয়র শিক্ষার্থীকে দেখতে পায়, যার শরীর আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। তাকে এক বন্ধু টেনে আগুনের ভেতর থেকে বের করে এনেছিল।

আহনাফ বলে, ‘ওর বন্ধু আমাকে বলল, আমি একা পারছি না। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?’ তখন আমি ছেলেটিকে কাঁধে তুলে নিই। চিকিৎসাকক্ষে নিয়ে যাই।’

এক ছাত্রের গায়ে কিছুই ছিল না। আহনাফ নিজের ইউনিফর্ম খুলে তাকে দেয়। তারপর খালি গায়ে উদ্ধারকাজ চালিয়ে যায়।

সাহসী শিক্ষক মাহরীন

সেদিন অত্যন্ত সাহসী ভূমিকায় ছিলেন শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী। তিনি তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাচ্চাদের দায়িত্বে ছিলেন। আগুনের মধ্যে থেকে অন্তত ২০ জন ছাত্রকে বাঁচাতে সক্ষম হন তিনি। কিন্তু নিজে ৮০ শতাংশ পুড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সবাই এখন বীর বলে মনে করছেন। কারণ, তিনি নিজের জীবন দিয়ে শিশুদের বাঁচিয়েছেন।

হতাহত

প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণের (২৮ জুলাই ২০২৫) প্রতিবেদন বলছে, এ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৬ জন মারা গেছেন। তাঁদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী।

আর এখন যাঁরা চিকিৎসাধীন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

তবে গতকাল সকাল ১০টা নাগাদ তথ্যের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, এ ঘটনায় নিহত মানুষের সংখ্যা ৩৪। আর আহত ব্যক্তিদের মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৪৮ জন।

বিবিসি বলছে, যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই স্কুলশিশু, যাদের বয়স ১২ বছরের নিচে।

গতকাল রোববার সকাল ১০টা নাগাদ তথ্যের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, এ ঘটনায় নিহত মানুষের সংখ্যা ৩৪। আর আহত ব্যক্তিদের মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৪৮ জন।

নিধির করুণ গল্প

১১ বছরের ওয়াকিয়া ফেরদৌস নিধি সেদিন প্রতিদিনের মতোই স্কুলে গিয়েছিল। দুর্ঘটনার সময় তার বাবা মসজিদে নামাজ পড়ছিলেন। খবর শুনেই তিনি দৌড়ে ছুটে যান।

পরিবারটির সদস্যরা সারা রাত ধরে অন্তত ছয়টি হাসপাতালে গিয়ে নিধিকে খোঁজেন। অবশেষে ভোরে দাঁত ও চোখ দেখে নিধিকে শনাক্ত করেন তার বাবা। কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষার আগে পরিবারটিকে মৃতদেহ দেওয়া হয়নি।

তিন ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিল নিধি। সে দিয়াবাড়িতে চাচার পাশের বাসায় থাকত। চাচা সায়েদ বিল্লাল হোসেন বলেন, তাঁদের চোখের সামনেই সে বড় হয়েছে। সে ছাদে খেলাধুলা করত। বাড়ির পাশে নারকেলগাছটার নিচে বসে থাকত। সে শিশুদের ভালোবাসত। সেদিন যদি স্কুল শেষে কোচিং না থাকত, তাহলে হয়তো আজ সে বেঁচে থাকত।

ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া সন্তান

এক মা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, সেদিন তিনি তাঁর সন্তানকে টিফিন না দিয়ে খাবার কিনতে টাকা দিয়েছিলেন। স্কুলে বিরতির সময় সে খাবার কিনতে বাইরে বের হয়েছিল। আর এভাবেই সে সেদিন বেঁচে গিয়েছিল।

অন্যদিকে এক বাবা জানান, সেদিন তিনি তাঁর দুই সন্তানকে হারিয়েছেন। প্রথমে তাঁর মেয়ে মারা যায়। পরে মারা যায় ছেলে।

উদ্ধারকাজের ভয়াবহতা

বিস্ফোরণের পরপরই চারপাশে আগুন, ধোঁয়া ও ধ্বংসস্তূপ। শিশুরা দৌড়ে বের হচ্ছিল। কারও পোশাক পুড়ে গেছে, শরীরে ফোসকা। দ্বিতীয় তলায় আটকে পড়া শিশুদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল। আহনাফসহ অনেকে ফায়ার সার্ভিসকে সাহায্য করে। ভেতরে প্রবেশের জন্য গ্রিল ভেঙে দেয়, রাস্তাঘাট খালি করে।

স্কুলের ১২ একর ক্যাম্পাসটি সব সময় শিক্ষার্থীদের হাসি-আনন্দে ভরে থাকত। কিন্তু সেদিন আগুন, ছিন্নবিচ্ছিন্ন লাশ আর আতঙ্কে ছেয়ে যায় পুরো ক্যাম্পাস। উদ্ধারকাজে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। হেলিকপ্টারে আহত ব্যক্তিদের সরিয়ে নেওয়া হয়।

মানসিক ট্রমা

বাংলার শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি এখন স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারেছেন না। ভবনের দিকে তাকালেই দুঃখে ডুবে যান তিনি। তাঁর তিনজন পরিচিত ছাত্র মারা গেছে।

আহনাফ এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি। তিনি বলেন, দুই দিন ঘুমাননি। জানালার বাইরে তাকালেই মনে হয়, আবার যুদ্ধবিমান আসছে। চোখ বন্ধ করলেই ধোঁয়া দেখেন।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, স্কুলশিক্ষার্থীসহ অন্যদের জন্য মানসিক পরামর্শ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। মনোবিদেরা স্কুলে যাচ্ছেন। কাউন্সেলিং করছেন।

আরেকবার ভাবতে হবে

মাইলস্টোন স্কুলটি বিমানবন্দরের কাছে অবস্থিত। স্কুলটির ওপর দিয়ে যুদ্ধবিমান বা যাত্রীবাহী বিমান উড়ে যায়। এত দিন স্কুলটির ছাত্রদের কাছে এটি স্বাভাবিক দৃশ্য ছিল। তারা কেউ কল্পনা করেনি, একদিন আকাশ থেকে একটি যুদ্ধবিমান নেমে এতগুলো শিশুর জীবন কেড়ে নেবে।

এ দুর্ঘটনা মনে করিয়ে দেয়, স্কুলও অরক্ষিত হতে পারে। তাই নিরাপত্তা নিয়ে আরেকবার ভাবতে হবে।

তবে এ ভয়াবহতার মধ্যেও আহনাফের মতো শিক্ষার্থীর সাহস, শিক্ষক মাহরীন চৌধুরীর আত্মত্যাগ আমাদের আশা দেখায়। দুর্যোগে তাঁরা দেখিয়েছেন, মানবতাই সবার আগে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি ও প্রথম আলো