জাহিদ হাসান: অধরা কণার বিজ্ঞানী

জন্মদিনের পাওয়া উপহারগুলো খুলে খুলে দেখছিল ছোট্ট জাহিদ। একটা ছোট্ট কাঁটা ওর সব মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। কাঁটাকে যেভাবেই ঘুরিয়ে দেওয়া হোক না কেন, সেটা সব সময় উত্তর-দক্ষিণ হয়ে থাকে! এরই মধ্যে জাহিদ জেনেছে এটাকে কম্পাস বলে। কিন্তু বুঝতে পারছে না কোন শক্তি এটাকে এভাবে একমুখো করে রেখেছে। খুলে দেখার জন্য জাহিদ কম্পাসের কাঁটাটিকে দুই টুকরো করে ফেলল এবং অবাক হয়ে দেখল দুটো টুকরোই কিন্ত অখণ্ডটার মতো উত্তর-দক্ষিণ হয়ে থাকে!

গবেষণাগারে সহকর্মীদের সঙ্গে জাহিদ হাসান (ডান থেকে দ্বিতীয়)
গবেষণাগারে সহকর্মীদের সঙ্গে জাহিদ হাসান (ডান থেকে দ্বিতীয়)

কেমন করে এর রহস্য ভেদ করা যায়?

ছোট্ট জাহিদ জেনে গেল বিজ্ঞানই হলো এই রহস্যভেদের মূলমন্ত্র। তখন থেকেই বিজ্ঞানের সঙ্গে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে জাহিদ। কিছুটা এগিয়ে বুঝতে পারে, কেবল পাঠ্যপুস্তকে তার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর নেই। শুরু হলো বিজ্ঞানের বই সংগ্রহ আর পড়া। সেই যে বিজ্ঞানের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ সৃষ্টি হলো জাহিদের মনে, সেটিই তাকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, নিত্যনতুন সৃষ্টির অন্বেষণে। যে রহস্যময় ও অদৃশ্য শক্তি কম্পাসের কাঁটাকে উত্তর-দক্ষিণ করে রাখে, সে রকম নানা শক্তিই কিন্তু এই জগতের খেলার নিয়মগুলো মেনে চলছে।

কয়েক বছর পর আইনজীবী বাবা রহমত আলী এক ঈদে জাহিদ আর তার দুই ভাইবোনকে ৫০০ টাকা করে দিলেন নিজেদের ইচ্ছেমতো কিছু কেনাকাটা করার জন্য। সময়টা প্রায় ৩০ বছর আগের। কাজেই ৫০০ টাকা কিন্তু অনেক টাকা। টাকা নিয়েই জাহিদের ভাইবোন দৌড়াল মার্কেটে, কাপড়চোপড় কেনার জন্য। কিন্তু ছোট্ট জাহিদ অপেক্ষা করল তার গৃহশিক্ষকের জন্য।

সন্ধ্যাবেলা ঢাকার ২৯ সেন্ট্রাল রোডের ওই বাসায় হাজির হলেন জাহিদের গৃহশিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষার্থী মাহমুদ হাসান। জাহিদের জন্য বিজ্ঞানের বই খুঁজে এনে দেওয়া মাহমুদ সাহেবের আরেকটা কাজ। জাহিদ বাবার দেওয়া ৫০০ টাকা মাহমুদ সাহেবের হাতে দিয়ে বসে পড়ল বিজ্ঞানের বইয়ের তালিকা করতে! এই তালিকার অনেকটা জুড়ে ছিল আবদুল্লাহ আল-মুতীর লেখা বিজ্ঞানের নানান বই।

বিজ্ঞানের জগতের আকর্ষণে একসময় জাহিদের মনে হয় আইনস্টাইন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন, সেই প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে সে।

শেষ পর্যন্ত সেখানে পড়তে না পারলেও এখন সেখানেই পড়াচ্ছেন জাহিদ হাসান। আইনস্টাইনের মতো প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আমাদের জাহিদ হাসান। মাত্র কয়েক দিন আগে তাঁর নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী খুঁজে পেয়েছেন ভাইল ফার্মিয়ন নামের কণা। সেই ১৯২৯ সাল থেকেই যে কণার সন্ধান করে বেড়াচ্ছেন বিশ্বের বিজ্ঞানীরা।

জাহিদ হাসানের লেখা বই

স্টিভেন ভাইনবার্গের সাহচর্য

২৯ সেন্ট্রাল রোড থেকে ধানমন্ডি গবর্ণমেন্ট বয়েজ হাইস্কুল বেশি দূরের রাস্তা নয়। সেই স্কুলেই জাহিদের পড়াশোনা। স্কুলের বন্ধুদের কাছে জাহিদ ‘তাপস’ নামেই পরিচিত। আর শিক্ষকেরা জানেন, এই ছেলেটি নিশ্চিতভাবেই এসএসসিতে মেধাতালিকায় স্থান পাবে। যেকোনো গাণিতিক সমস্যা নানান পদ্ধতিতে করতে পারত সে। বিজ্ঞানের কঠিন সব বিষয়ও সহজে বোঝার ক্ষমতা ছিল। তাই ১৯৮৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় মাত্র ২ নম্বর কম পেয়ে যখন ঢাকা বোর্ডের মেধাতালিকায় সে দ্বিতীয় স্থান পেল, তখন তার বন্ধুরা সেটা মেনে নিতে পারেনি। তারা নেমে এল রাস্তায়! তাদের বক্তব্য ছিল বাংলাদেশে জাহিদের চেয়ে ভালো কোনো শিক্ষার্থী নেই। বন্ধুদের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতেই যেন ১৯৮৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে কেবল ঢাকা বোর্ড নয়, সব বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে জাহিদ হলো প্রথম। এই সময় যে কেবল পড়েছে তা-ই নয়, জাহিদ নিজেই লিখে ফেলেছে বিজ্ঞানের বই —এসো ধূমকেতুর রাজ্যে

তত দিন আইনস্টাইনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা বেড়েছে অনেকখানি। কিন্তু জায়গা হলো না প্রিন্সটনে। জাহিদ বললেন, ‘আমি আইনস্টাইনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলাম না।’ কিন্তু সুযোগ পেলেন বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন ভাইনভার্গের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ নিতে জাহিদ ভর্তি হলেন অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্টিভেন ভাইনবার্গের কারণে শুরুর দিকে মহাবিশ্বের জন্ম-মৃত্যুর তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন জাহিদ। তবে বিজ্ঞানী স্টিভেন ভাইনবার্গ জাহিদকে ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলেন। তাঁর কাছ থেকেই জাহিদ জানতে পারেন, তত্ত্বীয় জগতে নতুন কিছুর সন্ধান যেমন আনন্দের, তেমনি বাস্তব জগতে সেই নতুনকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দও কম নয়। আইনস্টাইনের আলোর তড়িত্ ক্রিয়ায় ব্যবহূত পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে নতুন এক জগতের সন্ধান পান জাহিদ। ভাইনবার্গের সঙ্গে কাজ করে জাহিদ পাড়ি জমান স্ট্যানফোর্ডে। সেখানেই তাঁর মাস্টার্স আর পিএইচডি। পিএইচডি করার সময় জাহিদ বের করেন কঠিন বস্তুর মধ্যে ইলেকট্রনের চারটি কোয়ান্টাম সংখ্যা বের করার একটি কৌশল।

এভাবে জাহিদ ক্রমাগত দক্ষ হয়ে ওঠেন। এই সময়টাতে, মানে ১৯৯৭ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জাহিদ স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার একসিলারেটর সেন্টারে গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। এই সময় ডাক পেতেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের কাজ সম্পর্কে বলার।

স্বপ্নের আইনস্টাইনের বিশ্ববিদ্যালয়ে

‘আমি একটা বক্তৃতা দিতে গিয়েছি প্রিন্সটনে। বক্তৃতা শেষেই তারা আমাকে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। আমার তখন এমনকি কোনো জীবনবৃত্তান্তও তৈরি ছিল না। পিএইচডিও শেষ হয়নি।’ আরাধ্য স্বপ্ন ধরা দেওয়ার কথা আমাকে বলেছেন এভাবে। ‘না’ বলার অবস্থা ছিল না। কেবল পিএইচডি শেষ করা বাকি ছিল।

বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, নিলস বোর, ওপেন হাইমারের স্মৃতিবিজড়িত প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে ২০০২ সালে জাহিদ যোগ দেন আরএইচডিকে ফেলো হিসেবে। এটি একটি স্বতন্ত্র ফেলোশিপ। পরে সেখানকার পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন। ২০১১ সালেই জাহিদ বিভাগের পূর্ণাঙ্গ প্রফেসর হয়ে যান।

ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানই জাহিদের কাজের ক্ষেত্র। এরই মধ্যে প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থী তাঁর তত্ত্বাবধানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সবাই কোনো না কোনো পরীক্ষাগারে বিজ্ঞানী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন।

এরই মধ্যে জাহিদ হয়ে উঠেছেন এই জগতের একেবারেই সামনের কাতারের বিজ্ঞানী। তাঁর প্রকাশিত শতাধিক বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের দুই তৃতীয়াংশই ছাপা হয়েছে নেচার, ফিজিকস টুডে, সায়েন্স, ফিজিক্যাল রিভিউ-এর মতো বনেদি, অভিজাত ও বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকীতে।

টপোলজিক্যাল ভ্যালি

কম্পিউটার, স্মার্টফোনসহ সব ইলেকট্রনিকস সামগ্রীর প্রাণভোমরা ছয় দশক আগে উদ্ভাবিত ট্রানজিস্টার। কিন্তু এরই মধ্যে ট্রানজিস্টার তার কর্মদক্ষতার প্রায় সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে। বিজ্ঞানী-প্রকৌশলীরা খুঁজছেন নতুন কোনো বস্তু কিংবা বস্তুর নতুন কোনো অবস্থা যা দ্রুতগতির কম্পিউটিংয়ের সহায়ক হবে এবং পাশাপাশি তাতে শক্তির ক্ষয়ও হবে কম।

ঠিক এমনই ‘একটা কিছু’ খুঁজে পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, জার্মানি ও সুইডেনের একদল বিজ্ঞানী। এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশের অধ্যাপক জাহিদ হাসান। বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত নতুন এই বস্তু-দশার (state of the matter) নাম দেওয়া হয়েছে ‘টপোলজিক্যাল ইনসুলেটর’ বা ‘স্থানিক অন্তরক’। বস্তুর ভেতরে ঋণাত্মক বিদ্যুত্বাহী ইলেকট্রন কণার চলাচলের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা বস্তুকে কয়েক ভাগে ভাগ করেন। যার মধ্যে ইলেকট্রন সহজে চলাচল করতে পারে (পরিবাহী, যেমন তামা), যার মধ্যে পারে না (অন্তরক, যেমন কাঠ) এবং এই দুইয়ের মাঝামাঝি (অর্ধপরিবাহী, যেমন সিলিকন)। অর্ধপরিবাহীর ভেতরে ঋণাত্মক ইলেকট্রনের পাশাপাশি ধনাত্মক চার্জেরও ছোটাছুটি থাকায় এটি হয়ে উঠেছে ইলেকট্রনিকসের মূল উপকরণ। অর্ধপরিবাহী সিলিকনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ডিজিটাল কর্মকাণ্ডের এলাকাটি সিলিকন উপত্যকা নামে পরিচিত। এ ছাড়া রয়েছে অতিপরিবাহী বা সুপার কন্ডাক্টর। অতিপরিবাহীর ভেতর দিয়ে ইলেকট্রন কোনো শক্তি খরচ ছাড়াই চলাচল করতে পারে। কিন্তু স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এখনো কোনো অতিপরিবাহী পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে, জাহিদ হাসান বিভিন্ন মৌলিক পদার্থ, তথা বিসমাথ, থ্যালিয়াম, সালফার ও সেলেনিয়ামের সংমিশ্রণে যে যৌগ তৈরি করেছেন, সেটি এমনিতে অন্তরক। কিন্তু এটির উপরিতলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার জগতে ইলেকট্রন খুবই কম বাঁধার মধ্যে ছোটাছুটি করতে পারে। ফলে এটি হয়ে উঠেছে অতিপরিবাহী। ‘এটি একটি বড় বিষয়।’ বলেন জাহিদ হাসান। ‘কারণ দেখা যাচ্ছে আগের বিসমাথ-নির্ভর বস্তুর তুলনায় নতুন এই বস্তুতে ইলেকট্রন প্রায় ১০ হাজার গুণ বেশি গতিতে চলাচল করতে পারছে।’

সপরিবারে বিজ্ঞানী জাহিদ হাসান

১৯৯৭ সালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ফিলিপ অ্যান্ডারসনের মতে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। কেবল তত্ত্বের কারণে নয়, বরং এর কারিগরি দিকটিও তাত্পর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে অনেক দিন ধরে তত্ত্বীয় পর্যায়ে থাকা কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করা যাবে।

জাহিদ হাসান আরও বলেন, ‘কেবল কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের নতুন জোয়ার নয়, এর ফলে বস্তু জগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে যেখানে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা কাজ করে, সেটির অধ্যয়নও আলাদা গতি পাবে।’ যেহেতু কার্যকর তাপমাত্রায় এটি বানানো যাবে। শুরু হবে এক নতুন ইলেকট্রনিকসের যুগের। যার কেন্দ্রে থাকবে এই স্থানিক অন্তরক। হয়তো তখন সিলিকন ভ্যালির নাম পাল্টে হবে টপোলজিক্যাল ভ্যালি।

৮৫ বছর পর অধরা কণার খোঁজ

দুনিয়ার সব বস্তুকণাকে বিজ্ঞানীরা দুই দলে ভাগ করেন। এক দলের নাম বসু কণা বা বোসন। আলোর কণা ফোটন এই দলের অন্তর্ভুক্ত। এই কণাগুলো বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সমীকরণ বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে। সেই তত্ত্বানুযায়ী, ২০১২ সালে বিজ্ঞানীরা এই দলের অন্যতম সদস্য হিগস বোসন, যা ঈশ্বর কণা নামে পরিচিত, তা খুঁজে পান। 

প্রিন্সটনে বিখ্যাত তত্ত্বীয় পদার্থ বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড উইটেনের সঙ্গে জাহিদ হাসান
প্রিন্সটনে বিখ্যাত তত্ত্বীয় পদার্থ বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড উইটেনের সঙ্গে জাহিদ হাসান

অপর দলটিকে বলা হয় ফার্মিয়ন বা ফার্মি কণা। পরমাণুর গঠন-কণা ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন হলো ফার্মি-কণা। এগুলো বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি ও পল ডিরাকের ফার্মি-ডিরাক সংখ্যায়ন মেনে চলে। ইলেকট্রন, প্রোটনসহ জানা প্রায় সব ফার্মিয়নের নিজস্ব ভর আছে। এগুলো বৈদ্যুতিক চার্জও বহন করতে পারে বা চার্জ নিরপেক্ষও হতে পারে। কিন্তু ১৯২৯ সালে গণিতবিদ ও পদার্থবিদ হারম্যান ভাইল ভরশূন্য কিন্তু বৈদ্যুতিক চার্জ বহনকারী ফার্মি-কণার ভবিষ্যদ্বাণী করেন এবং দাবি করেন এমন কণা বাস্তবে রয়েছে। পরে বিজ্ঞানীরা তাঁর নামেই এর নামকরণ করেন ভাইল ফার্মিয়ন। জাহিদ হাসান জানালেন, মোট তিন ধরনের ফার্মিয়নের মধ্যে ডিরাক ও মাজোরনা নামের বাকি দুটি ফার্মিয়ন বেশ আগেই আবিষ্কার করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা ভাবছিলেন, মৌল কণা নিউট্রিনোই সম্ভবত ভাইল ফার্মিয়ন। কিন্তু ১৯৯৮ সালে আবিষ্কৃত হয় নিউট্রিনোরও ভর আছে। তখন থেকে আবার ভাইল ফার্মিয়নের  খোঁজ শুরু হয়। অবশেষে জাহিদের নেতৃত্বে প্রিন্সটনের বিজ্ঞানীরা সেই ভাইল ফার্মিয়নের খোঁজ পান।

প্রিন্সটনে নোবেলজয়ী তত্ত্বীয় পদার্থ বিজ্ঞানী ফিলিপ ওয়ারেন অ্যান্ডারসনের সঙ্গে
প্রিন্সটনে নোবেলজয়ী তত্ত্বীয় পদার্থ বিজ্ঞানী ফিলিপ ওয়ারেন অ্যান্ডারসনের সঙ্গে

ভরশূন্য হওয়ার কারণে ধারণা করা যায়, ভাইল ফার্মিয়ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে বর্তমান অর্ধপরিবাহী ইলেকট্রনিক সামগ্রীর তুলনায় কমপক্ষে এক হাজার গুণ বেশি গতিতে চলাচল করতে পারবে। ভাইল ফার্মিয়নের আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এটি একই সঙ্গে চৌম্বকের একক মেরু (মনোপোল) এবং বিপরীত একক মেরুর (অ্যান্টি-মনোপোল) বৈশিষ্ট্য বহন করে। অর্থাত্, এর ফলে পথে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সেগুলো ইলেকট্রনের মতো ছড়িয়ে পড়ে না, বরং সামনের দিকে তাদের গতি বজায় রাখে। ইলেকট্রনিকসের ভেতরে ইলেকট্রনের যে ট্রাফিক জ্যাম হয়, এখানে সেটা হবে না। ব্যাখ্যা করলেন জাহিদ। জাহিদের আশাবাদ, এর মাধ্যমে সূচিত হবে নতুন ধরনের ইলেকট্রনিকস, যাকে আমরা বলছি ভাইলোট্রনিকস।  

দীর্ঘদিন ধরে ফার্মিয়ন নিয়ে কাজ করছেন কানাডার ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী আন্তন ভার্খব। একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে দেওয়া সাক্ষাত্কারে উচ্ছ্বসিত ভার্খব বলেন, তত্ত্বীয় জগতের জিনিসপত্র বাস্তব জগতে খুঁজে পাওয়ার মতো আনন্দের বিষয় আর কিছু নেই।

জাহিদ হাসানের গবেষক দল এই কণাকে খুঁজে পেয়েছে একটি যৌগিক কেলাসের মধ্যে এবং কেলাসেই কেবল এটিকে পাওয়া যায়। তবে হিগস বোসনের সঙ্গে ভাইলের পার্থক্য হচ্ছে হিগস বোসনের অস্তিত্ব কেবল কণা ত্বরকেই (হ্যাড্রন কলাইডার) পাওয়া যায়। কিন্তু ভাইল ফার্মিয়ন দিয়ে বানানো যাবে নতুন ও কার্যকর কম্পিউটিং ডিভাইস। তবে জাহিদ হাসানের ধারণা নিত্যব্যবহারের ভাইলোট্রনিকসের জন্য আমাদের আরও ১০ থেকে ২০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। 

গবেষণাগারে জাহিদ হাসান

নতুনদের জন্য

মাইক্রোসফট করপোরেশনে কর্মরত স্ত্রী প্রকৌশলী সারাহ আহমেদ, ছেলে আরিক ইব্রাহিম ও মেয়ে সারিনা মরিয়মকে নিয়ে জাহিদের সংসার। শিকড়ের টানে যুক্ত আছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা বোর্ডে। সুযোগ পেলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কাজ করার আগ্রহ রয়েছে জাহিদের। তবে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলা। এ কাজ করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরে জাহিদ হাসানের এই প্রত্যয় হয়েছে যে আমাদের শিশু-কিশোরদের মেধা বিশ্বমানের। কাজেই তাদের সাফল্যের ব্যাপারে তিনি খুবই আশাবাদী।

কম্পাসের কথা এখনো ভোলেননি তিনি। এখনো ভাবেন, ছোট্ট কম্পাস যেভাবে তাঁকে আগ্রহী করে তুলেছে বিজ্ঞানে, তেমনি নতুনদের বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলার জন্য কাজ করে যাবেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পরে কণাবিজ্ঞানে যুক্ত হয়ে যাওয়া বাংলার বিজ্ঞানী জাহিদ হাসান।

কিশোর আলোর পড়ুয়াদের  জন্য জাহিদের পরামর্শ, ‘তুমি পারবে—নিজের ওপর এই বিশ্বাস স্থাপন করো। কিসে তুমি আনন্দ পাও, কোনটা তোমার ভালো লাগে, সেটা খুঁজে বের করো। নিজের একটা লক্ষ্য ঠিক করে সেটার জন্য এগিয়ে যাও। পদে পদে বাধা আসবে, কিন্তু তোমার আশপাশের লোকের জ্ঞান-অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে          সামনে এগিয়ে যাও। তোমার মতো যাদের লক্ষ্য, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করো। কঠিন পরিশ্রম করো। তবে সেই সঙ্গে ভারসাম্যটাও ঠিক রেখো, যাতে তোমার জীবন  অর্থপূর্ণ হয়।  তাহলেই একদিন  তুমি তোমার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।’