হুমায়ূন আহমেদের ভয়

অলংকরণ: আরাফাত করিম

নুহাশ যখন ছোট, তাকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলা খেলতেন হুমায়ূন আহমেদ, আমাদের হুমায়ূন ভাই। ভয় দেখিয়ে মজা পেতেন হুমায়ূন আহমেদ, ভূতের ভয়। অন্যকে ভয় দেখানোর সময় নিজেও ভয় পেতেন তিনি। এতে তাঁর মজা বেড়ে যেত আরও। রাবারের তৈরি বিভিন্ন ধরনের মুখোশ, টিকটিকি, তেলাপোকা জাতীয় ছোট ছোট খেলনা ছিল তাঁর। একসঙ্গে অনেকে বসে চা পান করছে, কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে কারও চায়ের কাপে একটা রাবারের তেলাপোকা রেখে দিতেন হুমায়ূন ভাই। সেই ব্যক্তি চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে যখন ওই তেলাপোকা দেখে লাফ দিয়ে উঠত, হাত থেকে পড়ে যেত চায়ের কাপ—হুমায়ূন আহমেদ এসব মজা করতেন নিয়মিতই। মুখে খেলনা তেলাপোকা রাখতেন, নুহাশকে হঠাৎ জিব বের করে মুখের তেলাপোকা দেখাতেন। এসব তাঁর খুব প্রিয় আনন্দ ছিল। গত শতাব্দীর শেষ দশকের কথা বলছিলাম। তখন এসব খেলনা বাংলাদেশে সচরাচর দেখা যেত না।

একবার টাঙ্গাইলের সফিপুরে একটি বিদ্যালয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠান বা পাঠাগার উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। আমরা তিনজন—হুমায়ূন আহমেদ, আমি আর মোজাম্মেল ভাই। মোজাম্মেল ভাই বেশ মোটাসোটা ছিলেন, শরীরের রং ছিল গাঢ়। আমাদের তিনজনেরই ওই পথে প্রথম যাত্রা। সন্ধ্যার আগ দিয়ে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে এগোচ্ছি। হঠাৎ হুমায়ূন ভাই ব্যাগ থেকে একটা মুখোশ বের করলেন। খুব বেঢপ আকারের এবড়োখেবড়ো মুখাবয়বের গলা ঢাকা, কান লম্বা, বিকট দর্শন নাকওয়ালা চুলবিহীন মুখোশ। মোজাম্মেল ভাইকে পরিয়ে দেওয়া হলো। গাড়িতে বসে আছে দশাসই শরীরের গাঢ় বর্ণের বিকট দর্শন মুখাবয়বের একজন মানুষ। আশপাশের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সেই বিকট দর্শন প্রাণীর দিকে। গাড়ি কোথাও দাঁড় করিয়ে কোনো লোককে ডাকলে সে কাছে এসেই প্রথমে এক লাফ দিয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। এ রকম মজা করতে করতেই সন্ধ্যার পর সেই বিদ্যালয়ে গিয়ে হাজির হলাম আমরা।

আরও পড়ুন
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ফরিদ আহমেদ

আগেই বলেছি, হুমায়ূন আহমেদ ভয় দেখিয়ে যেমন মজা পেতেন, তেমনি নিজেও ভয় পেতেন খুব। যদিও তা প্রকাশ করতেন না। সম্ভবত ভূতের ভয়ও ছিল তাঁর। কোথাও বেড়াতে গেলে একা এক রুমে থাকতেন না। একা বিছানায় ঘুমাতেন না। এই তিনজন মিলে ভারত ভ্রমণে গিয়েছিলাম। প্রায় ১০ থেকে ১২ দিনের সফর ছিল। সুযোগ থাকলেও কখনো একা ঘুমাতেন না হুমায়ূন ভাই। কখনো মোজাম্মেল ভাই, কখনো আমার সঙ্গে বিছানা শেয়ার করতেন। অসুখ-বিসুখেও বেশ ভয় পেতেন। পরিচিত কারও অসুখে খুব উদ্বিগ্ন হতেন। তবে কাছে গিয়ে দেখার আগ্রহ ছিল কম। একটু নার্ভাসও হয়ে যেতেন বলে মনে হয়। আমার একবার বেশ বড়সড় জন্ডিস হলো। বিলিরুবিনের মাত্রা খুব উচ্চ। তখন আমাদের একটা ঘরোয়া আড্ডা ছিল। প্রায় প্রতিদিনই আড্ডা বসত। প্রথম দিকে আড্ডা শুরু হয় হুমায়ূন ভাইয়ের বাসায়, কিন্তু পরবর্তী সময় তা ঘুরতে থাকে। নিয়মিত আড্ডাটা হুমায়ূন ভাইয়ের বাসায় না হলেও হতো আর্কিটেক্ট ফজলুল করিমের বাসায়। মাঝেমধ্যে আমার বাসা, ডা. আবদুল করিমের বাসা, ইঞ্জিনিয়ার মনির ভাইয়ের বাসা—এভাবে উদ্‌যাপন চলত। ইঞ্জিনিয়ার মনির ভাই আড্ডায় নিয়মিত থাকতেন না। পরের দিকে নিয়মিত হয়েছিল নায়ক জাহিদ হাসান, ইফতেখারুল ইসলাম। সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী এবং অভিনেতা সালেহ আহমেদ, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান অনিয়মিত বা মাঝেমধ্যে আমন্ত্রিত আড্ডারত্ন ছিলেন। আমি অসুস্থ, বেশ কিছুদিন আড্ডায় যাই না, হুমায়ূন ভাইয়ের ভালো লাগছে না। আবার আমার বাসায়ও আসছেন না। তখন জন্ডিসকে অনেকে খুব ভয় পেত। ১৯৯৬ সালের কথা বলছি। এখনকার করোনার মতো না হলেও কাছাকাছি ছোঁয়াচে ভাবা হতো জন্ডিসকে। জন্ডিস রোগী থেকে রোগ ছড়ায়, তাকে একা রাখতে হবে। কোনো ওষুধ নেই, শুধু বিশ্রাম আর ভিটামিন সি-জাতীয় তরল পান করতে হবে। ডাব, কমলা, পেঁপে ইত্যাদি পথ্য। আমার বেলায়ও সে রকমই চলছিল। বাইরের মানুষ বাসায় আসা প্রায় বন্ধ।

এক রাতে বিশাল দলসহ হুমায়ূন আহমেদ উপস্থিত হলেন আমার আজিমপুরের বাসায়। আমি তখন একেবারে শয্যাশায়ী, বিছানা থেকে নড়াচড়া নিষেধ, নড়াচড়ায় নাকি বিলিরুবিন বেড়ে যায়। আর বিলিরুবিন বাড়া মানেই লিভার ড্যামেজ হওয়া, জন্ডিস রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটা। যা-ই হোক, হুমায়ূন ভাই থাকতে না পেরে জন্ডিসভীতি দূরে রেখে চলে এসেছেন আড্ডার অনেককে নিয়েই। ছোঁয়াচে রোগীর কাছে যাওয়া যাবে না, তাতে কী হয়েছে? ড্রয়িংরুমের মেঝেতে দল নিয়ে আড্ডায় বসে পড়লেন। আমার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর হলো। সামনের রুমে আমার আসা নিষেধ। দরজার ওপার থেকে উঁকি দিয়ে আমাকে দেখেন আর মজার মজার গল্প শোনান। প্রায় ঘণ্টাখানেক সঙ্গীসাথি নিয়ে আড্ডা দিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় আবার উঁকি দিয়ে দেখে গেলেন। ভালোবাসার কাছে হার মানল হুমায়ূন আহমেদের রোগভীতি!

আরও পড়ুন