সারাহ ইসলামের কিডনি প্রতিস্থাপন যেভাবে হলো, জানালেন ডাক্তার। বললেন, নবদিগন্তের সূচনা

বাংলাদেশের প্রথম ‘ব্রেন ডেথ’ ব্যক্তির কাছ থেকে নেওয়া কিডনি অন্য রোগীর দেহে প্রতিস্থাপনের ঘটনা ঘটে ১৯ জানুয়ারি। ঐতিহাসিক এই অস্ত্রোপচারে নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল। দুদিন পর ২১ জানুয়ারি বিকেলে কিশোর আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত কিশোর আলোর মাসিক সভায় তিনি উপস্থিত হন। সেখানে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। উপস্থিত কিশোর-কিশোরীদের শোনান সারাহর সাহসের গল্প। তাঁর বক্তব্যের ঈষৎ সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল
ছবি: আব্দুল ইলা

সারাহ ইসলাম যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছে, এটা শুধু বাংলাদেশে নয়; পৃথিবীর মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ ঘটনা। আমার জীবনেরও শ্রেষ্ঠ ঘটনা। এ ঘটনা একদিকে যেমন আমার সৌভাগ্য, তেমনি দুর্ভাগ্যও। কারণ, ওর মতো এত একটা লক্ষ্মী মেয়েকে আমরা হারিয়েছি। জীবন–মরণ তো সবার আছে, কিন্তু মারা যাওয়ার মুহূর্তে ওর মতো ছোট্ট একটা মেয়ে যে দুঃসাহসের পরিচয় দিল, তা অভাবনীয়। কারণটা বলি। বাংলাদেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অভাবে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। বিদেশেও চলে যায় অনেকে। এ সমস্যার সমাধান ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্ট। ৩০ বছর ধরে আমরা এর জন্য যুদ্ধ করছিলাম। অবশেষে তা আলোর মুখ দেখল। বলা যায়, নবদিগন্তের সূচনা হলো সারাহর মাধ্যমে।

আইসিউতে ভর্তি থাকা অনেক রোগীর মস্তিষ্ক একটা সময় আর কাজ করে না। হৃৎপিণ্ড, ফুসফুসকে সচল রাখা হয় কৃত্রিমভাবে বা লাইফ সাপোর্টের মাধ্যমে। এ সাপোর্ট অপসারণ করামাত্রই তার মৃত্যু ঘটে। ব্রেন ডেথ পর্যায়ের রোগীরা আদতে প্রায় মৃতই। এ পর্যায় থেকে কেউ ফিরে আসে না। তবু, লাইফ সাপোর্ট অপসারণের জন্য তার স্বজনদের সম্মতি প্রয়োজন। কেউ কেউ সম্মত হন। অনেকেই অবশ্য মেনে নিতে চান না। যে কারণে বিদেশে টানা পাঁচ-দশ বছরও রোগীকে সাপোর্ট দিয়ে রাখার নজির রয়েছে।

এ ব্রেন ডেথ ব্যক্তির দান করা অঙ্গ অন্যের দেহে প্রতিস্থাপন করাই হচ্ছে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্ট। মরণোত্তর অঙ্গদানের সঙ্গে একে মেলানো যাবে না। কেননা ব্রেন ডেথ ব্যক্তির দেহে রক্ত সরবরাহ, পালস, ইউরিন ফরমেশন সচল থাকে। তাই কিডনি, লিভারসহ আটটি অঙ্গ অন্যদের দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। মরণোত্তরের ক্ষেত্রে কেবল ত্বক, হাড় ও কর্নিয়া গ্রহণ করা সম্ভব হয়।

আরও পড়ুন

তো, একটা মানুষ যদি ‘উইল’ করে যায় অথবা তার আত্মীয়রা চাইলে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্ট করা যায়। দেহ তো শুধু আত্মার বাহক। মৃত্যুর পর এর আর কোনো মূল্য থাকে না। শেষমেশ দাফন করা বা পুড়িয়ে ফেলা হয়। কারণ, পচন শুরু হয় ছয় ঘণ্টা পর থেকে। এ অবস্থায় কেউ তার অঙ্গগুলো দান করে গেলে আটজন মানুষের জীবন দেওয়া সম্ভব। এটা বিশাল একটা ব্যাপার। প্রতিটি ধর্মই এর অনুকূলে বলে গেছে। মুসলিম দেশগুলোও অঙ্গদান প্রসঙ্গে ঐকমত্যে এসেছে। সারাহর ঘটনায় দেখলাম কেউ কেউ বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠরা পক্ষেই রায় দিয়েছেন। আশা করি, সামনের দিনগুলোতে আমরা সবাইকে এ ঐকমত্যের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারব।

প্রতিটি ধর্মের মর্মবাণী হলো মানবতা আর সারাহ সেই মর্মবাণীকে স্পর্শ করেছে। ৩০ বছর ধরে আমরা চাইছিলাম অন্তত একটা ট্রান্সপ্লান্টেশন যেন করতে পারি। তাহলেই একটা মহতী আন্দোলনের সূচনা হবে। অঙ্গদানের অভাবে আমাদের রোগীরা প্রাণ হারাচ্ছেন। দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে চলে যাচ্ছে। গত ছয় মাস আমরা পাঁচ-ছয়টি আইসিউতে তৎপরতা চালাচ্ছিলাম। তিনটি জায়গা থেকে ইতিবাচক সংবাদ আসতে পারত। আমরা ট্রান্সপ্লান্টের সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন করে রেখেছিলাম। কিন্তু আত্মীয়দের অনাগ্রহসহ নানান কারণে এগোনো যায়নি। সপ্তাহ তিনেক আগে আরেকজনের সন্ধান পেয়েছিলাম। আমাদের ভিসি স্যার পর্যন্ত তাঁকে কাউন্সেলিং করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।

সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য

সারাহ ছিল দুরারোগ্য জেনেটিক ডিজিজ টিউবেরাস স্ক্লেরোসিসে আক্রান্ত। রোগটি খুব ভয়ংকর। এর কোনো চিকিৎসা নেই। ২০ বছর বয়সী এই মেয়েটা জীবনের ১৯ বছরই কষ্ট ভোগ করেছে। শেষ পাঁচ বছর যন্ত্রণা আরও তীব্র হয়। বাধ্য হয়ে সে মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারের জন্য আসে। আমরা বুঝতে পারি, সারাহ ব্রেন ডেথ হতে যাচ্ছে। ওর মাকে আমরা তা জানাই। তিনি খুবই ইতিবাচকভাবে এগিয়ে আসেন। তিনি জানান যে সারাহ তাঁকে বলেছে, ‘মা, আমার মৃত্যু হয়ে গেলে তুমি আমার সবকিছু দান করে দিয়ো। সুযোগ থাকলে আমার ব্রেইনটাকেও। ওটা নিয়ে গবেষণা হোক।’ এর চেয়ে হৃদয়স্পর্শী আর কী হতে পারে? আমরা তাই ট্রান্সপ্লান্টের প্রস্তুতি নিলাম। সারাহকে ব্রেন ডেথ ঘোষণা করা হলে পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য তার মা মৌখিক সম্মতি দিলেন। আমরা পাঁচজন রোগীকে ভর্তি করলাম। আমি বলব, সারাহর মা অত্যন্ত মহীয়সী একজন নারী। এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো বুকের পাটা সবার থাকে না। একমাত্র বিশাল হৃদয়ের মানুষেরাই নিজের সন্তানের দেহকে কাটাছেঁড়া করতে দিতে পারেন।

তারপর আমাদের এক-দেড় শ লোকের টিম কাজে নেমে পড়ে। যে কারোর দেহে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা যায় না। ক্রস ম্যাচিং করতে হয়। সে প্রক্রিয়া চলতে থাকল। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় একটা সেন্টার থেকে খবর এল। জানাল, পাঁচজনের দুজনের ক্রস ম্যাচ পজিটিভ। হবে না। আমরা হতোদ্যম হয়ে পড়লাম। শেষ পর্যন্ত এসে হবে না!

আরও পড়ুন

আরেকটা সেন্টারকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমাদের রেজাল্ট কী? ওরা অপেক্ষা করতে বলল। প্রতিটা প্রহর, প্রতিটা মুহূর্ত আমরা তখন উৎকণ্ঠায় পার করছি। ফোন এল ৯টা ১ মিনিটে। ‘স্যার দুইটার সাথে নেগেটিভ।’ সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। অপারেশনের প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম সঙ্গে সঙ্গে। একজন ভর্তি হলেন এই বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে। অন্যজন কিডনি ফাউন্ডেশনে। সারাহর মা সম্মতিপত্রে সই করলেন। 

এখানে আমাদের মূল কাজটা ছিল ‘অপারেশন’ করে সারাহর কিডনি দুইটা নিয়ে আসা। প্রক্রিয়াটা খুব জটিল। এমন অপারেশন আমার জীবনে প্রথম। আগে কোথাও দেখিনি। তত্ত্বীয় জ্ঞান ছিল কেবল। কিন্তু কার্যক্রম শুরু করা মাত্র একটা আচ্ছন্নতা যেন আমাকে ঘিরে ধরল। মনে হচ্ছিল এই অপারেশনটা আমি হাজার হাজার বার করেছি। অথচ প্রক্রিয়াটা আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। নিশ্চয়ই একটা স্বর্গীয় ব্যাপার এখানে ছিল। তা না হলে আমার মধ্যে এ রকম ‘স্পিরিট’ কীভাবে আসে? কখনোই অপারেশন করতে গিয়ে আমি আবেগপ্রবণ হইনি। কিন্তু সারাহর দেহের যে জায়গাটা কাটা হবে, তা পরিষ্কার করতে গিয়ে আমার কান্না চলে এসেছিল। ভাবছিলাম, এ রকম একটা ছোট্ট মেয়ে এভাবে তার অঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে, তার চেয়ে বড় কত মানুষ কিছুই দিল না।

আরও পড়ুন

তারপর দুটো কিডনির একটা আমাদের এখানে রাখলাম। আর অন্যটা বিশেষ পরিবহনব্যবস্থার মাধ্যমে ৪৫ মিনিটের মধ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হলো কিডনি ফাউন্ডেশনে। এরপর আমি অংশ নিলাম দ্বিতীয় অপারেশনে। সেটা এত ভালো হয়েছে যে কল্পনা করা যাবে না। এত দিন আমরা অনেক ট্রান্সপ্লান্ট করেছি। কিন্তু সেটা ছিল জীবিত মানুষের থেকে নেওয়া। যাহোক, রোগী দুজনের কিডনি কাজ করতে শুরু করেছে। পাশাপাশি আরেকটা টিম সারাহর দেহ থেকে কর্নিয়া নিয়ে নেয়। পরদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ও সন্ধানী আই হসপিটালে সেগুলোর অপারেশন হয়। যে দুজনকে চোখ দেওয়া হয়েছে, তারা খুবই ভালো আছে। ওদের চোখের ব্যান্ডেজ খুলে দেওয়া হয়েছে গতকাল। ইতিমধ্যে তারা দেখতে শুরু করেছে। তিন সপ্তাহ পর পূর্ণ পৃথিবী দেখতে পাবে।

একটা ছোট্ট মেয়ে চারটা মানুষকে জীবন দিয়ে গেল। একদিকে এটা বিশাল মহতী ব্যাপার। অন্যদিকে সারাহ যে আন্দোলনটা শুরু করে দিয়ে গেল, তা অভূতপূর্ব। বাংলাদেশের মধ্যে, মানুষের মধ্যে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পুরো ঘটনা শোনার পরে ভীষণ অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তিনি সারাহর মা এবং পুরো টিমকে দেখতে চেয়েছেন। আমরাও সারাহ ও তাঁর মায়ের প্রতি সম্মান জানিয়ে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছি

সারাহর উৎসর্গের কাছে এগুলো আসলে কিছুই না। ওর কাছে আমরা ঋণী। আমাদের কাজটা ও সহজ করে দিয়ে গেছে। এখন আরও দুজন ব্রেন ডেথ রেডি। যেকোনো মুহূর্তে আমরা সম্মতি পেয়ে যেতে পারি; যেখানে আমরা ৩০ বছর চেষ্টা করেও পারছিলাম না। সামনে আমরা প্রচারে যাব। বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা, সমাজকর্মী, গণমাধ্যম, বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে কর্মশালা করব। একটা গণ-আন্দোলনে যাব আমরা। তাতে মানুষের মধ্যে যে কুসংস্কার আছে, সেটা দূর হয়ে যাবে। অর্থাৎ, সারাহ আমাদের এমন পথ দেখিয়ে গেছে, যা থেকে পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। আমরা এগিয়ে যাব ইনশা আল্লাহ।

কিশোর আলোর সভায় সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য। অক্টোবর ২০১৭
ছবি: কিশোর আলো

অন্তত ২ শতাংশ অঙ্গপ্রত্যঙ্গও যদি পাওয়া যায়, উপকৃত হবে হাজার হাজার মানুষ। সবার অঙ্গ তো আর নেওয়া যায় না। ধরা যাক, আমার কিডনি দুটো নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আমার ছেলে, ভাই, বোন, চাচা কারোর সঙ্গে মিলছে না। এ ধরনের মানুষের খুব কষ্ট। ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টের মাধ্যমে সবচেয়ে উপকৃত হবে এরাই। সব ধরনের তথ্য নিয়ে একটা জাতীয় রেজিস্ট্রি থাকবে। দেখা গেল, ‘ও’ গ্রুপের একজনের ব্রেন ডেথ হয়েছে। ওদিকে ও গ্রুপের আরেকজন প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় আছেন। তখন আমরা ফোন করলেই তিনি চলে আসবেন। মানে এই উপকারটা হবে।

সারাহর মাধ্যমে এ পদ্ধতিটা শুরু হলো। স্বাধীন বাংলাদেশে তো বটেই, তখনকার পূর্ব পাকিস্তান; এমনকি ব্রিটিশ উপনিবেশের সময়েও এ ধরনের অপারেশন হয়নি। পুরো পিরিয়ডে এটাই প্রথমবার। এ কারণে এটা এত গুরুত্ব বহন করে। সারাহকে আমরা ভুলতে পারব না। পরবর্তী প্রজন্মও তাকে মনে রাখবে।

সবচেয়ে গর্বের বিষয়, সারাহ এই কিশোর আলোরই স্বেচ্ছাসেবক ছিল। এটা তো কিশোর আলোর জন্য বিশাল একটা ব্যাপার। সারাহ এখানকারই সদস্য ছিল, এখানকারই মানুষ ছিল। এই যে আজ আমার নাম হয়েছে, আমার এত ছবি উঠছে, ইন্টারভিউ দিতে দিতে পাগল হয়ে যাচ্ছি; কার জন্য? সারাহর জন্য। সারাহ আমাদের দিয়ে গেছে। মানুষকে দিয়ে গেছে। সে শুধু দিয়েই গেছে।

সারাহ ও তার মা আমাদের জন্য অনুকরণীয়, পাথেয়। তাঁরাই প্রকৃত বীর। তাঁদের স্যালুট।

অনুলিখন: মোহাম্মাদ উল্লাহ জাফরী