ভালো আম কিনতে হলে কী কী চিনতে হবে

আম্রপালিছবি: লেখক

তোমরা তো আম খেতে ভালোবাসো, তাই না? গরমকালের পরম তৃপ্তি তো ওই আমের মধুর রসেই রয়েছে। এ জন্য তো গরমকালকে বলা হয় মধুকাল বা মধুঋতু। মধুর মতো মিষ্টি আমে রসনা তৃপ্ত করার এ সুযোগ সব সময় পাওয়া যায় না; কিন্তু কেউ কেউ আমের কথা শুনলেই আঁতকে ওঠে। বলেÑনা না, আম খেলেই বিপদ। কোন আমে কী আছে কে জানে?

সৃষ্টিকর্তা আমের মধ্যে দিয়ে দিয়েছেন ভিটামিন ও খনিজের মতো মূল্যবান পুষ্টি উপাদান, তা খেলে আবার বিপদ ঘটবে কেন? ছোট্ট নাতনিটাকেও আম খাওয়াতে গেলে বলে ফেলল—না, না দাদা, আম খাব না। আমের মধ্যে কেমিক্যাল আছে জানো না?

আমি তো হতবাক! ওই পুঁচকে মেয়েটার মাথায়ও এখন বিষের চিন্তা ঢুকে গেছে, সে–ও এখন বিষাক্ত কেমিক্যালের ভয়ে প্রিয় আম খেতে সাহস করছে না।

ভালো ভালো আমকে কারা এই আতঙ্কের পণ্যে পরিণত করছে? কেনই–বা করছে? সে অনেক কথা। আসল কথা হলো, তোমরা যারা আম খেতে ভালোবাসো, তারা নিশ্চয়ই ভালো আম খেতে চাও। সে দামটাম যা–ই হোক, তোমরা হয়তো এমন আম খেতে চাও, যে আম দেখতে ভালো, নাকের কাছে নিলে বেশ ঘ্রাণ পাওয়া যায়, পাকা আমের রংটাও বেশ সুন্দর, শাঁসে কোনো আঁশ নেই, আঁটি পাতলা ও শাঁস বেশি, স্বাদে চমৎকার, মিষ্টি আর রসালো।

ক্ষীরশাপাতি
ছবি: লেখক

সত্যিই আমরা যে কত সৌভাগ্যবান! এ দেশে আমের একসময় হাজারের বেশি জাত ছিল। যেসব জাতের প্রতিটির রং, রূপ, স্বাদ ও গন্ধ ছিল আলাদা। তাই একেক জাত একেকজনের কাছে বেশি প্রিয় হয়ে উঠত।

তোমাদের মতো আমি যখন কিশোর ছিলাম, তখন আমার প্রিয় আম ছিল ল্যাংড়া। দুধভাতের মধ্যে যখন ডিমের মতো দেখতে পাতলা খোসা ছাড়িয়ে সেই পাকা ল্যাংড়া আম চটকে মাখিয়ে খেতাম, মনে হতো যেন অমৃত খাচ্ছি। আর ঘ্রাণের কথা কী বলব! একবার আম চটকানোর পর হাতের তালুতে সেই সুমিষ্ট ঘ্রাণ লেগে থাকত অন্তত দুই দিন।

এখন আর ল্যাংড়া আম দেখে কৈশোরের মতো সেটি ভালো লাগে না। এখনকার ল্যাংড়া আমগুলো আগের চেয়ে অনেক বড় বড় দেখছি, তিন–চারটি আমে এক কেজি হয়ে যায়। কিন্তু খেতে গেলে আর আগের সেই স্বাদ পাই না, সেই কড়া ঘ্রাণটাও নেই; বরং মাঝেমধে৵ খেতে গেলে মনে হয় যেন ওটির শাঁসে মুখ মৃদু চুলকাচ্ছে। তাই পছন্দের শীর্ষস্থান থেকে এখন ল্যাংড়াকে নামিয়ে ধরেছি ক্ষীরশাপাতি আমকে।

বারি আম ৪
ছবি: লেখক

ক্ষীরশাপাতি আমের চেহারাটা খুব আকর্ষণীয় না হলেও স্বাদে চমৎকার, কেমন যেন ক্ষীর ক্ষীর ভাবের শাঁস আর তেমনই মিষ্টি। আকৃতিতে ল্যাংড়ার মতো ডিম্বাকার নয়, নাক বা থুতনির দিক সামান্য লম্বাটে, বোঁটা বা কাঁধের দিক চওড়া ও সুগোল। পাকলে খোসার রং হলদে বা কমলা হয় না, হলদে সবুজ থাকে। ল্যাংড়ার চেয়ে এর খোসা পুরু, তাতে কী? খোসা তো আর খাই না, খাই শাঁস। সাইজটাও বেশ।

দুই রকমের ক্ষীরশাপাতি আম চাঁপাইনবাবগঞ্জে আছে—ক্ষীরশাপাতি আর খুদি ক্ষীরশা। ক্ষীরশাপাতি আম খুদি ক্ষীরশার চেয়ে আকারে বড়। আমার কাছে খুদি ক্ষীরশা আমই যেন ক্ষীরশাপাতির চেয়ে একটু বেশি মিষ্টি মনে হয়। ক্ষীরশা জাতটার আবার সাতক্ষীরায় নাম হিমসাগর। তবে কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে ক্ষীরশা আর হিমসাগরের মধ্যে। আমার কাছে মনে হয়, স্বাদটা প্রায় একই রকমের হলেও ঘ্রাণে পার্থক্যটা ধরা পড়ে। হিমসাগরের ঘ্রাণ ক্ষীরশার চেয়ে বেশি, পাকা আমের ঘ্রাণটাও বেশ মিষ্টি।

তবে স্বাদে সবচেয়ে বেশি মিষ্টি ও মজার আম হলো আম্রপালি। লম্বাটে গড়ন, মসৃণ ও পাতলা খোসা, ফালি করে কেটে খাওয়ার কমলা শাঁসের এক মধুর আম হলো আম্রপালি। ছোট, মাঝারি, বড়Ñবিভিন্ন আকারের আম্রপালি বাজারে দেখা যায়। কখনো কখনো এর চারটি আমে হয় এক কেজি, কখনো আবার কেজিতে হয় ৮ থেকে ১০টি। বড়গুলোর চেয়ে ছোটগুলোকেই আমার কাছে বেশি মিষ্টি মনে হয়।

ভালো আম কিনতে বা খেতে হলে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখবে তোমরা। প্রত্যেকেরই পছন্দ আলাদা। তাই সবাই যে একই আম পছন্দ করবে বা খাবে, তা না। আমরা সেসব আমকেই ভালো আম বলব, যেগুলো প্রথমত খেতে সুস্বাদু, শাঁস আঁশবিহীন ও রসালো, মিষ্টি, রোগ ও পোকামুক্ত এমনকি ক্ষতিকর যেকোনো রাসায়নিক দ্রব্যমুক্ত। আবার সেসব আমের চেহারাও সুন্দর, ঘ্রাণটা  বাড়তি আকর্ষণ, চেহারা ও ঘ্রাণ খাওয়ার সময় আলাদা রুচি আনে। সব মিলিয়ে আসে পরিতৃপ্তি, মানে আম খাওয়ার পরিপূর্ণ তৃপ্তি।

ব্যানানা ম্যাঙ্গো
ছবি: লেখক

আগে তুমি ঠিক করে তোমার পছন্দের জাতগুলোর একটি তালিকা করে ফেলো। তুমি ক্ষীরশা না ল্যাংড়া খেতে চাও? নাকি আম্রপালি? আমি দেখেছি, অনেক বাচ্চাই আম্রপালি আম খেতে বেশি পছন্দ করে। টক–মিষ্টি স্বাদ বলে অনেকেই আশ্বিনা ও ফজলি খেতে পছন্দ করে না। তবে আমাদের মতো বুড়োদের জন্য কিন্তু ওই আমটাই পছন্দের, বিশেষ করে যাঁদের ডায়াবেটিস আছে, তাঁরা আম্রপালি মুখে তুলতে চান না।

তোমার আম খাওয়ার পছন্দের জাতটি ঠিক করতে তোমাকে কিন্তু কোন জাতের আম খেতে কেমন তা জানতে বা স্বাদ পরখ করতে হবে। এ জন্য আমি একবার একটি কাজ করেছিলাম। চাঁপাইনবাবগঞ্জে অনেক বছর আগে একটি জাতীয় আম প্রদর্শনী হয়েছিল। সে প্রদর্শনীর কাজের সঙ্গে জড়িত থাকায় এক দিনেই প্রায় ৮০টি জাতের আমের স্বাদ পরখ করার সুযোগ হয়েছিল। আর সেসব স্বাদের কথা আমি আমার খেরোখাতায় টুকেও রেখেছিলাম।

আরাজান গুটি নামে একটি আম দেখে লোভ সামলাতে না পেরে একফালি খেয়েছিলাম। কেননা, সেই একটি আমের ওজনই ছিল ১ কেজি ৮০০ গ্রাম। যত বড় দেখতে, ততটাই বিস্বাদ। এখন তো ব্রুনাই কিং নামে এ দেশে যে জাতের আম পাওয়া যাচ্ছে, তার একটি আমের ওজনই প্রায় চার কেজি! এর স্বাদও ভালো না, দেখনাই আম।

লক্ষ্মণভোগ
ছবি: লেখক

বাণিজ্যিক জাতগুলোর মধ্যে সুন্দরী একটি আম পেয়েছিলাম লক্ষ্মণভোগ। হলদে রং, বোঁটার কাছে লালচে আভা; কিন্তু স্বাদটা পানসে মিষ্টি আর হলদে শাঁসের আঁশ। খেতে খেতে শেষে সেটির প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। সে যা–ই হোক, যে জাত বা জাতগুলো তোমার পছন্দ হবে, একটি মৌসুমে সেগুলো কিনে অন্তত স্বাদটা যাচাই করে দেখতে পারো। তারপর সিদ্ধান্ত নিতে পারো যে কোন জাতের আম তোমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের।

যে জাতটি তুমি পছন্দ করবে, তা কখন ওঠে বা পাকে, সে সময়টা মনে রাখা দরকার। কেননা, আমের ভালোত্ব তার পাকার সময়ের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। অসময়ে অনেকে ক্ষীরশাপাতি বাত্তি আম গাছ থেকে পেড়ে পাকানোর কেমিক্যাল দিয়ে পাকা আমের চেহারা তৈরি করে বাজারে নিয়ে আসেন। সেগুলোর স্বাদ ভালো হয় না, খাওয়াও ক্ষতিকর।

আমাদের সৌভাগ্য যে বিভিন্ন জাতের কল্যাণে এখন আমরা বছরে প্রায় ছয় মাস ধরে পাকা আম খেতে পারি। ল্যাংড়া, ফজলি, ক্ষীরশাপাতি, হিমসাগর, বারি–৪ আম, আশ্বিনা ও আম্রপালির মতো এ দেশে আমের অন্তত কুড়িটি বাণিজ্যিক জাত রয়েছে। বৈশাখে পাকে গোপালভোগ আম, জ্যৈষ্ঠে তো প্রায় সব জাতের আমই পাকে। এগুলোর মধ্যে প্রথমে আসে ক্ষীরশা ও ল্যাংড়া, তারপর আসে হাঁড়িভাঙা। আষাঢ়ে আসে আম্রপালি, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, বারি–৪ আম ইত্যাদি। শ্রাবণে ওঠে ফজলি। ভাদ্রে ভাদুড়ি ও আশ্বিনা। আশ্বিনে পাওয়া যায় আশ্বিনা, ঝিনুক ও নীলাম্বরী আম। এ ছাড়া বছরের বিভিন্ন সময়ে মাঝেমধে৵ পাওয়া যায় থাইল্যান্ডের জাত কাটিমন ও বাংলাদেশের জাত বারি–১১ আম।

ল্যাংড়া
ছবি: লেখক

সরকার কোন জাতের আম কখন পাকে, সে অনুযায়ী পরিপক্ব বা ম্যাচিউর আম পাড়ার একটি পঞ্জিকা করে দিয়েছে। যদিও সে সময়ের কিছুটা হেরফের হয় আবহাওয়ার কারণে হয়। তবে তার কাছাকাছি সময়ে যদি বাজার থেকে সেসব জাতের আম কেনা যায়, তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে সে আমগুলো পরিপক্ব। পরিপক্ব আম মানেই ভালো আম।

সময় মেনে ভালো জাতের আম কিনতে বাজারে তো গেলে, তার মানে কিন্তু সেটিই যে ভালো আম, সেটি কি নিশ্চিত? সব জাতের পাকা আমেরই রং ও চেহারায় একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য থাকে। আম্রপালি আমের রং কখনো সম্পূর্ণ হলদে হয় না, ক্ষীরশা বা ল্যাংড়া আমেরও না, এমনকি আশ্বিনা আমের রং হয় কালচে সবুজ, ল্যাংড়া আমের রং হয় হলদে সবুজ; কিন্তু রাইপেনিং হরমোন বা পাকানোর কিছু রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে পাকানোর ফলে এসব আম তার স্বাভাবিক রং হারিয়ে আকর্ষণীয় সুষম হলুদ রং তৈরি করে। তাই কেবল চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়ে আম কেনা ঠিক হবে না।

আমাদের হাতে এসব কেমিক্যালের উপস্থিতি যাচাই করার কোনো কৌশল বা যন্ত্র আপাতত নেই। তাই নিজের চোখে দেখা আর অভিজ্ঞতাই এ ক্ষেত্রে আমাদের ভরসা। সদ্য পাড়া আমের বোঁটা থেকে কষ ঝরে, বোঁটার কাছটা প্রায় সমান হয়ে ওঠে, আবাত্তি আমের বোঁটার কাছে গর্ত থাকে, অবশ্য অনেক দিনের হলে সেসব কষ শুকিয়ে যায়। এটাও যাচাই করা যেতে পারে যে আমটি পরিপুষ্ট ও সুপক্ব কি না।

হাঁড়িভাঙ্গা
ছবি: লেখক

আবার খুব বেশি পাকা আম কেনাও ঠিক হবে না। এগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, শাঁস অতি পাকার ফলে বেশি নরম হলে আসল স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। কোনো কোনো জাতের আম টিপ দিলে বোঝা যায় তা কতটা পেকেছে। আম্রপালি ও হাঁড়িভাঙা এমনকি ক্ষীরশা আমের বেলায় কিন্তু আম ভালোভাবে পাকার পর টিপ দিলে খুব নরম লাগে না। নরম লাগলেই এসব আম কেনা যাবে না। হাঁড়িভাঙা আম তো নয়ই। কেননা, এ আম ভালোভাবে পাকলেও খোসা শক্ত ও হালকা সবুজ থাকে; কিন্তু আঁটির কাছের শাঁস নরম ভ্যাদভেদে ও ঝাঁজালো হয়ে যায়। আম্রপালিও বেশি পাকলে এর গোলা বা শাঁস উগ্র স্বাদের হয়ে যায়। আশ্বিনা আম আবার বেশি দিন থাকলে আরও ভালো, পাকা আম হলেও সহজে পচে না; বরং খোসা শুকিয়ে কুঁচকাতে থাকে আর সদ্য পাকা আমের টক স্বাদ মিষ্টি হতে থাকে। ফজলি আম অবশ্য পরিণত পাকা অবস্থাতেই স্বাদ ভালো পাওয়া যায়, বেশি পাকলে তা ঝাঁঝালো হয়ে যায় ও শাঁস থেকে টক টক গন্ধ আসে।

ভালোভাবে পাকা আম চেনার অবশ্য আরও কিছু লক্ষণ আছে। ভালোভাবে পাকা আমের খোসা ও শাঁসের রং হয় সুন্দর, জাতভেদে পাকা আম থেকে মিষ্টি ঘ্রাণ বের হয়। সেসব আম কেটে খেলে ভালো স্বাদ লাগে। গাছে আম ভালোভাবে পরিপুষ্ট না হলে সেসব আম ভালোভাবে পাকে না। গাছে পরিপক্ব হলে আমের বোঁটার কাছের কাঁধ মোটামুটি সমান হয়ে যায়, আমের পার্শ্বদেশ পরিপুষ্ট হয়। অর্থাৎ আমের বৃদ্ধি যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখনই ধরে নেওয়া হয় আম পাড়লে তা ভালোভাবে পাকে।

হিমসাগর
ছবি: লেখক

এ ছাড়া আমের খোসার ওপর সাদা পাউডারের মতো আবরণ পড়বে, খোসার গাঢ় সবুজ রং বদলে হালকা সবুজ হয়ে যায়, এরপর জাতভেদে হলদে বা হলুদাভ হয়। কোন কোন জাতের আমে হালকা হলুদ বা কমলা হলুদ রঙের ছোপ দেখা দেয়। গাছে সে সময় দু–একটি আমে পাক ধরে। আর একটি ব্যাপার কি জানো? কাঁচা আম পানিতে ভাসে, পাকা আম ডুবে যায়। তবে কোনো কোনো জাতের পরিপক্ব আমও পানিতে ডুবে যায় অর্থাৎ পরিপক্ব আমের আপেক্ষিক গুরুত্ব ১.০০–এর চেয়ে বেশি হয় (যেমন ল্যাংড়া ও চোষা)।

সারকথা হলো ভালো আম খেতে চাইলে সে আমটি হতে হবে ভালো জাতের, ভালোভাবে পাকা (কোনো রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে পাকানো না), স্বাদে ভালো, রোগ-পোকার আক্রমণ ও পচনমুক্ত।