সুপারহিরো

অলংকরণ: এস এম রাকিব

দুনিয়া বাঁচানোর দায়িত্ব যে আমার কাঁধে এসে পড়েছে, এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। ভেবেছিলাম এটা হয় মারভেল, না হয় ডিসির কাজ। কিন্তু ঘটনা তেমন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এটা আমার এবং শুধু আমারই কাজ। সব মিলিয়ে কী যে এক মহা মুসিবতে পড়েছি বলে বোঝানো যাবে না! দুনিয়ায় এত এত মানুষ, এত এত ঘটনা! সব মানুষের সব ঘটনার দায়িত্ব নেওয়ার আমি কে? আচ্ছা, আমাকে কি চিনতে পারছ? দাঁড়াও, প্রথমেই আমার পরিচয়টা দিয়ে দিই।

আমার নাম জোয়ার্দার জামশেদ। আমার বাবার নাম…

না, মা–বাবার নাম শোনার দরকার নেই। আমি থাকি নিকেতন আর মহাখালীর মাঝামাঝি একটা জায়গায়। মা–বাবা দুজনই দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এর পর থেকে আমি আর মিনি একলা একলা বাসা পাহারা দিই। মাঝেমধ্যে মামা-মামিরা আসে। অনেকগুলো খাবার দিয়ে ফ্রিজ ঠেসে বন্ধ করে চলে যায়। যাওয়ার আগে মামি আমার গাল দেয় টিপে। এই আদর জঘন্য লাগে! বলি, ‘কী করো, আমার বয়স এখন ২৫!’

মামা হো হো করে হাসে। বলে, ‘বললেই হলো ২৫? এই সেদিন তুই জন্মালি। চোখের সামনে ঘাড় শক্ত হলো তোর। আর বলে কিনা ২৫!’

মামার মাথাটা একটু একটু করে খারাপ হচ্ছে। মামি অন্তত তা–ই বলেছে। একদিন মামা আমার হাত কামড়ে ধরল। হঠাৎই। অযথাই। আমি তো বাবা গো–মা গো বলে চিৎকার। মামার ওপর না পারতে চড়াও হলাম। কিন্তু মামি তখনই কোথা থেকে যেন ছুটে এল। আমাকে রান্নাঘরে টেনে বলল, “আরে শোন! করছিস কী!”

কী করব মানে? মামা তো আমাকে খেয়ে ফেলছিল!

এই এক অভ্যাস হয়েছে তার। যখন-তখন হাত-পা খেয়ে ফেলছে। মাকড়সার স্বভাব।

তাহলে তো স্পাইডারম্যান হয়ে যাচ্ছে!

ধুরো। ওই সব তো গল্পবাজি। সিনেমা। ওই রকম কিছু হয় নাকি? আসলে তার মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, বুঝছিস না!

মামার মাথা খারাপ হয়ে গেলে আমার কী হবে, এটা নিয়ে চকিতে একটা দুশ্চিন্তা হয়। শুধু খাবারদাবার তো নয়; বাসাভাড়া থেকে শুরু করে আমার সব ধরনের খরচা এখন মামার কাঁধে। আমার শুকিয়ে যাওয়া মুখ দেখে মামি বলে উঠল, ‘আরে মরণ! তুই কি নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে বসেছিস নাকি? শোন, যদ্দিন আমি বেঁচে আছি, চিন্তা নেই। সমস্যা একটাই তোর মামার মাথা মনে হয় না খুব বেশি দিন টিকবে!’

করলও না। পরের তিন মাসে মামা বদ্ধ উন্মাদ। মামিকে দেখলেই বনমানুষের মতো বুকে ঘুষি মারতে মারতে চিৎকার। বললাম, এ তো টারজান রোগ।

মামি হেসে ফেলল, ‘নাম খারাপ দিসনি।’

মামা সারা দিন বসে থাকে বাসায়। কখনো কখনো শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। আমি গেলে তেড়ে মারতে আসে। দূর থেকে ইশারা করে বোঝায়, আমার হাত চিবিয়ে খেয়ে নেবে!

ওদিকে মামি যা কথা দিয়েছিল, তা অবশ্য দেখা গেল একেবারেই কথার কথা! মামা অসুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসায় খাবার আসার পরিমাণ কমে যেতে লাগল। একদিন অবস্থা হলো সুকান্তের মতো। ছাদে বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি। পূর্ণিমা না হলেও চাঁদের বেশ জেল্লা–জৌলুশ আছে এবং সে চাঁদ দেখে মনে হচ্ছে, খানিকটা সত্যি সত্যি ঝলসানো রুটি। এই মনে হওয়াটার দেরি নেই… হঠাৎই দেখলাম চাঁদটা গেল খসে। ঠিক যেন রুটিই। আর খসে পড়তে লাগল আমাদেরই ছাদের দিকে। ওমা! রুটির মতো চাঁদ গায়ের ওপর পড়লে কি বাঁচব? কিন্তু না… শেষ মুহূর্তে সেটা গিয়ে পড়ল ওই সাদা বাড়িতে!

এর মধ্যে সাদা বাড়ির গল্পটা বলে নেওয়া দরকার।

আমার বাসার পাশে আরও দুটো ফ্ল্যাট। তার পাশেই একটা খাল। খালের শরীর ভালো নয়। প্রায়ই গোঙায়। বর্ষাকালে শুধু অল্প অল্প কুলকুল ধ্বনি শোনা যায়। ওই খাল পার হলেই হঠাৎ একটা অতি উঁচু দেয়াল। দেয়ালটা মসৃণ; এতই যে হাত-পা পরের কথা... চোখ পর্যন্ত পিছলে যায়। ওই দেয়াল পার হলে জংলামতো জায়গা। ঢাকার ভেতর এ রকম অদ্ভুত জংলা জায়গা সচরাচর চোখে পড়ে না। আরও চোখে পড়ে না এ রকম জংলা একটা জায়গার ভেতর নিস্তরঙ্গ সাদা একটা বাড়ি। ২৫ বছর ধরে দেখছি, এই বাড়িতে কেউ আসেনি এবং এখান থেকে কেউ বাইরেও যায়নি। প্রাণের কোনো অস্তিত্ব এখানে এত বছরেও পাওয়া যায়নি। আম্মুকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই বাড়ি কাদের?

আম্মু উত্তরে বলেছিল অদ্ভুত কথা, ‘নিজেই একদিন জানতে পারবি।’

তা পরে আর জানতে চাওয়ার ইচ্ছা হয়নি; কোনোভাবে জানতেও পারিনি। অথচ আস্ত একটা চাঁদকে আমি ওই বাড়িতে ঢুকে যেতে দেখে খানিকক্ষণ বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। সত্যি ঘটনা, নাকি একেবারেই চোখের ভুল? মামার মতো কি তাহলে আমিও পাগল হয়ে যাচ্ছি? আব্বু সংস্কৃত শ্লোক বলত, নরানং মাতুলক্রম! এর মানে সম্ভবত এই, মানুষ মামাদের মতো। আমার মাথা তাহলে কত ভাগ বাকি আছে নষ্ট হতে?

কত ভাগ যে বাকি, তা ঠিক ঠাহর করা গেল না। কিন্তু নিজেকে আবিষ্কার করলাম খালের পাড়ে। সাদা বাড়ির বাইরের দেয়ালের সামনে। অস্তিত্বসংকটকারী অবস্থান, বলাই বাহুল্য। আমি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছি। এটা পেরিয়ে ওদিকে চাঁদকে দেখতে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আমি হাঁটতে শুরু করলাম দেয়ালের পাশ ধরে। এটাকেই কি বলে ‘চাঁদে পাওয়া’?

প্রায় ১০ মিনিট হাঁটার পর দেখলাম, দেয়ালের গায়ে নালার ফুটো। ওটা দিয়ে বিড়াল গলাতে পারে। মিনিকে ডাক দিয়ে গলিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু চাঁদ দেখতে আমাকে ভেতরে ঢোকানো যায় না। কিন্তু ও কী! নালাটার কাছে ভালো করে দেখতেই বুঝলাম, নালাটাকে ওপরে যতটা দেখা যায়; নিচের দিকেও আছে ঠিক ততটাই। মানে, আমি যদি এক লাফে নিচ থেকে চেষ্টা করি, ভেতরে ঢুকতে পারব!

ঢুকলাম।

একটা বড় খোকসাগাছ। গাছভরা কাঁটা। ওপরে উঠতে গিয়ে আমার ঘাড়ের কাছটা ভরে গেল কাঁটায়। ব্যথায় খানিকক্ষণ উফ্‌–আহ্‌ করলাম। তারপর দেখলাম, ইটবিছানো রাস্তা। রাস্তাটা একটা ঢেউ খেলে চলে গেছে বাড়িটার দিকে। রাস্তা যখন গেছে, আমিই বা আর এখানে থেকে কী করব! গেলাম আমিও। জানালায় নীল রঙের গ্রিল। কপাটের কাচগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে বা আগে থেকে এমন ঝাপসাই ছিল। দুটো জানালা পেরোলে দরজা। রং কাঁঠালি। আমি হাত দিলাম...যাহ! খুলে গেল। ভেতরটা গুম অন্ধকার। পায়ে পায়ে এগোতেই খটাস করে দরজাটা আটকে গেল! জ্বলে উঠল একসঙ্গে শ খানেক লাইট। একটা গমগমে কণ্ঠ—স্বাগত জামশেদ! জোয়ার্দার জামশেদ!

আলোয় ধাঁধিয়ে যাওয়ার জন্য হোক কিংবা হঠাৎ করেই এ রকম একটা ঘটনা ঘটার জন্যই হোক… আমি ধপাস করে পড়ে গেলাম। পড়েই জ্ঞানটা হারালাম। হারানোর আগে বুঝলাম, মেঝেটা সাপের শরীরের মতো ঠান্ডা।

চোখ মেলে দেখলাম ছাদের ওপর ঝলসানো চাঁদটা জ্বলজ্বল করছে। ঘরের ভেতরেই। পরক্ষণেই বুঝলাম এটা আসলে চাঁদ নয়। আলোর ফোকাস। ফোকাসটা এমনভাবে বানানো হয়েছে যে মনে হচ্ছে চাঁদ। ছাদ থেকে কি তাহলে আমি এটাই দেখেছিলাম?

পাশ ফেরার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। তবে বুঝতে পারলাম আমাকে প্রায় আঁটসাঁট করে বেল্ট দিয়ে বেঁধে রাখা হয় ডেন্টিস্টদের চেয়ারের মতো একটা কিছুতে। শুধু অল্প করে ঘাড়টা নাড়াতে পারলাম। দেখলাম ডান দিকটা ভরে আছে শত শত স্ক্রিনে। এটা কী জায়গারে বাবা?

‘আমাদের ওয়ার্কস্টেশন।’

গমগম করা আওয়াজটা আবার ফিরে এল। তবে এবার শুধু আওয়াজ নয়; সামনে এসে দাঁড়াতে দেখা গেল মানুষটাকে—একহারা গড়ন। চিমসে ধরনের মুখ। জুলফিগুলো বড় বড় এবং কাঁচাপাকা। স্যুট-টাই পরে আছে। আবার বলে উঠল কথা। আবারও সেই গমগমে আওয়াজ—২৫ বছর ধরে আমরা তোমার অপেক্ষা করেছি জামশেদ।

‘তাই নাকি? তা কী ধরনের অপেক্ষা? ফুল নিয়া নাকি ফল নিয়া?’

‘তোমার কি মনে হচ্ছে আমি তোমার সঙ্গে রসিকতা করছি?’

‘আরে ভাই, এই দুনিয়ায় আমার জন্য অপেক্ষা করার কেউ নাই, আপনি ক্যান করবেন? আপনি আমার কে হন?’

‘মেন্টর বলতে পারো। গুরুও। আমি রওশন।’

‘ধন্যবাদ। আমি আজেবাজে জিনিস খাই না। আমার গুরু ধরার রোগও নাই। এইবার আমাকে ছাড়েন। বাসায় যাই। মিনিকে খেতে দেওয়া দরকার। অনেকক্ষণ আমাকে না দেখলে এমনিতেই সে কান্নাকাটি করে।’

‘শুধু মিনির কান্নাকাটি না, তোমাকে দুনিয়ার সবার কান্নাকাটির খেয়াল রাখতে হবে।’

‘তাই নাকি? এবার রসিকতাটা কে করছে? ভাই শোনেন, বাঁধন খোলেন আমার…আপনাদের বাড়িতে চোরের মতো ঢুকেছি, এটা সত্যি। কিন্তু আমি সত্যি সত্যি চোর না। আমি পাশের ফ্ল্যাটেই থাকি…’

‘জানি আমরা। ওই ফ্ল্যাটে যেন তোমার মা–বাবা উঠতে পারেন, তার সব ব্যবস্থা আমরাই তো করেছি। এবং করেছি শুধুমাত্র তোমার জন্য।’

‘আপনি আমার মা–বাবাকে চেনেন?’

‘তোমার দাদা-দাদিকেও। তোমার দাদা ছিলেন নির্ভীক মানুষ। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। আমাদের কথাও তিনি জানতেন।’

‘আপনাদের কথা জানতেন মানে?’

‘আমরা একটা গোপন সংগঠন জামশেদ। পৃথিবীর সভ্যতার যত বয়স, আমাদেরও তত। তোমার দাদা প্রতি মাসে আমাদের চাঁদা দিয়েছেন। তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে এখনো একটা অর্থ আমাদের অ্যাকাউন্টে যুক্ত হয়। কারণ, তিনি মারা যাওয়ার পর তুমি আমাদের এই সংগঠনের সদস্য।’

‘সর্বনাশ!’

‘কিসের সর্বনাশ?’

‘ভেবেছিলাম, শুধু মামা পাগল হয়েছেন...এখন তো দেখছি আমার আশপাশের সবাই পাগল হয়ে যাচ্ছে।’

‘গর্দভ! তোমার মামা কেন পাগল হয়েছে, তুমি জানো?’

‘আপনি জানেন, আপনি কেন পাগল হয়েছেন?’

লোকটা গেল ভয়ানক রেগে। কেমন করেই যেন কাঁপছে তার হাত-পা-শরীর। কারও দিকে তাকিয়ে কী যেন এক ইশারা করল। সঙ্গে সঙ্গে ওই চেয়ার থেকে একটা সিরিঞ্জ বেরিয়ে এল অদ্ভুত দ্রুততায়। ফুস করে কোনো একটা তরল ঢুকল আমার কোমরের কাছে। একটা পলক ফেলার সময় পেলাম না; দুইটা পলকই পড়ে গেল। আমি আবার সংজ্ঞাহীন।

কুলকুল শব্দ হচ্ছে। চোখ খুলে দেখি ঝরনা। এই অদ্ভুত বাড়ির ভেতর ঝরনা কোথা থেকে এল—এ রকম প্রশ্ন মাথায় আসতে না আসতেই দেখলাম ঝরনার পাশেই বসে আছে একটা মেয়ে। কাটা কাটা চোখ–মুখ। আমি তাকাতেই হাসল। বলল, ‘কেমন আছেন?’

যাহ! আসলে কী হচ্ছে, কেউ কি বলবে?

মেয়েটা এগিয়ে এল পায়ে-পায়ে। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘উঠে আসুন।’

উঠে বসলাম। পিঠে একটু ব্যথা আছে বোঝা গেল। মেয়েটা বলল, ‘আমার নাম ফারিয়া। আপনি?’

নাম বললাম। ফারিয়া বলল, ‘অবাক করা কথা—আপনিও তাহলে সুপারহিরো?’

‘মানে আপনিও?’

‘এরা আগে থেকে সব ঠিকঠাক করে রাখে। এদের একটা সংগঠন নাকি আছে। বহু পুরোনো। এরা সুপারহিরো বানায়। তারপর দুনিয়ার কাছে বিক্রি করে দেয়।’

‘কী বলেন এই সব!’

‘আমার নানু এদের সঙ্গে নাকি জড়িত ছিল। আমি যখন মায়ের পেটে, তখন কী একটা ব্যাপার করেছে...তাতে নাকি আমার ওড়ার ক্ষমতা তৈরি হওয়ার কথা।’

‘আপনি উড়তে পারেন?’

ফারিয়া মাথা নাড়িয়ে হাসল। তারপর বলল, ‘দেখবেন?’

ওমা! কথার শেষ নেই, ফারিয়ার পিঠে ফটাস-ফটাস করে দুটো ডানা বেরিয়ে এল। ঝলমলে সবুজ রঙের। যেন বড়সড় টিয়ে পাখি। তারপরই হঠাৎ করে ফুড়ড়ড়ড়...যাহ্! একেবারে ওপরে। তিনটা চক্কর কাটল। আর আমার একেবারে মাথার কাছে নামল। ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘কেমন?’

আমার মুখ হাঁ। চোখ বিস্ফোরিত। গলা শুকিয়ে কাঠ। এমন কিছু এই জীবনে দেখব কে ভেবেছিল। শুধু বললাম, ‘দারুণ তো!’

কিন্তু ফারিয়ার মুখটা মলিন হয়ে এল হঠাৎই। বলল, আসলে কিন্তু দারুণ না অতটা। এরা আমাকে এ রকম বানাবে বলে আমার আব্বু-আম্মুকে মেরে ফেলেছে। তারা কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিল। সমুদ্রে নেমে আর ফেরেনি!

‘কী সর্বনাশ! আমার আব্বু-আম্মু তো সড়ক দুর্ঘটনায়...’

‘এরা আমার একমাত্র ছায়া আমার আংকেলকে পাগল করে দিয়েছে...’

‘আর আমার মামাকে...’

‘আসলে এদের কাছে আমরা বন্দী। সুপারহিরোটিরো আসলে ভুয়া কথা। এরা আমাদের দিয়ে নিজেদের কাজ করিয়ে নিতে চায়।’

‘কিন্তু আমরা করলে তো?’

‘না করে এখন আর উপায় কী?’

সাত দিন পেরিয়ে গেছে। আমি আর ফারিয়া এখনো আটকে আছি। কিন্তু আর আটকে থাকতে হবে না বলেই মনে হচ্ছে। আজ সন্ধ্যায় ওরা আমাদের রক্তে কিছু একটা মিশিয়ে দেবে। তারপর থেকে ওরা যা বলবে, আমরা তা–ই শুনব। ফারিয়া বলল, ‘আজকেই শুধু আমরা স্বাধীন! চলো নিজেদের জন্য শেষবারের মতো উড়ি।’

‘কিন্তু আমি তো উড়তে পারি না।’

‘তাহলে তুমি কিসের সুপারহিরো? তোমার পাওয়ার কী?’

‘আমি তো জানি না।’

‘নিশ্চয় তোমার কোনো পাওয়ার আছে। তুমি যখন মায়ের পেটে ছিলে, নিশ্চয় তখন তোমার সঙ্গে ওরা কিছু একটা করেছে...যাতে তুমি এমন কিছু পারো, যা সাধারণ মানুষ পারে না।’

‘কিন্তু কী সেটা?’

আর তখনই আমার মিনির কথা মনে পড়ল। ‘মিনি মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে পেত না! কেন পেত না?’

ফারিয়াও বলে উঠল, ‘তাই তো! কেন পেত না?’

আমি বললাম, ‘তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো কখন পেত না!’

খুব করে ভাবতে শুরু করলাম। একবার আর্জেন্টিনা হেরে গেল বিশ্বকাপে। খুব মেজাজ খারাপ হলো। মনে হলো টিভিটাকে আছাড় মেরে ফেলে দিই। ফেলতেও যাচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ মিনি ম্যাও ম্যাও করে চিৎকার করেছিল। আমি যতই বলি, আরে এই তো আমি, কী হয়েছে...! মিনি ততই ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়।

আরেকবার বাংলাদেশ এশিয়া কাপের ফাইনালে হেরে গেল। এমন কষ্ট পেলাম। মিনি সেদিনও আমাকে দেখতে পায়নি...স্পষ্ট মনে আছে। ফারিয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে আশ্চর্য চোখে। ওদিকে ধাপধুপ শব্দ শোনা যাচ্ছে। সংগঠনের লোকগুলো চলে আসছে। এরপরই তারা আমাদের শরীরে কিছু একটা দিয়ে দেবে...আমাদের স্বাধীনতা শেষ করে দেবে, তারপর থেকে আমরা কথা বলব তাদের কথামতো, আমাদের নিজস্ব কোনো মত থাকবে না...আমি ব্যাকুল হয়ে ফারিয়াকে বললাম, ‘ফারিয়া বলো, আমি কি তাহলে অদৃশ্য হতে পারি? এটাই আমার সুপারপাওয়ার? কিন্তু কখন আমি অদৃশ্য হই, কখন?’

ফারিয়া ঠাস করে একটা চড় মারল আমার গালে। পুরো শরীর ঝনঝনিয়ে উঠল। চোখে দেখলাম তারা। কী বেয়াদব মেয়ে একটা! কী এমন বলেছি তাকে যে আমাকে চড় মারবে? ইচ্ছা হলো তাকে ধরে হাল্কের মতো আছড়ে ফেলে ওই ঝরনার দিকে...কিন্তু ততক্ষণে সংগঠনের লোকগুলো চলে এসেছে। তারা ঝটপট ধরে ফেলেছে ফারিয়াকে। কিন্তু তাদের মধ্যে অদ্ভুত একটা কথা। বলছে, ‘৫৬ নম্বরটা কই? ৫৬ নম্বর...জামশেদ জোয়ার্দার...কই সে...কই!’

ঝরনার পাশ দিয়ে একটা ছোট্ট ফাটল আছে। তার ফাঁক দিয়ে আকাশের চাঁদ দেখা যায়। আমি সেদিকে রওনা দিলাম। আমি সুপারহিরো নই...হলে ফারিয়াকে বাঁচাতে আমি ঠিকই যেতাম!