প্রথম লেখার আনন্দ

বাইরে ঝুমবৃষ্টি। বাড়ির ঠিক পাশেই পুকুর থেকে বৃষ্টি পড়ার ঝুপ ঝুপ শব্দ ভেসে আসছে। বিজলি বাতি নিভে গেছে আগেই। চারদিকে ভুতুড়ে সন্ধ্যা। হারিকেনের টিমটিমে আলোয় পড়তে বসেছে একটি তরুণ। ছুটিতে বাড়ি এসেছে। সামনেই পরীক্ষা। তাই সঙ্গে এনেছে ট্রাংক ভর্তি পাঠ্যপুস্তক, একগাদা রসায়ন বই। একটা খাতা টেনে নিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে তরুণটি ইংরেজিতে লিখল: দ্য ট্রাম ম্যাক্রোমলিকুল ওয়াজ ফার্স্ট সাজেস্টেট বাই স্টাওডিনজার। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার তারপরের লাইনটি রসায়ন ছেড়ে বেলাইনে চলে গেল। খাতায় লেখা হতে লাগল: বাস থেকে নেমে হকচকিয়ে গেলাম। বৃষ্টিতে ভেসে গেছে সব। রাস্তায় পানির স্রোতধারা। লোকজন চলাচল করছে না, লাইটপোস্টের বাতি নিভে আছে...

এভাবেই লাইনের পর লাইন লিখে গেলেন তরুণ। সেই বর্ষারাতেই লেখা হলো বাংলা ভাষার নামকরা উপন্যাস শঙ্খনীল কারাগার। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ তরুণটির নাম কী। তিনি আমাদের সবার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৬৭ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে পিরোজপুর শহরে বসে নিজের প্রথম উপন্যাসটি লিখেছিলেন তিনি। সে সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে ভর্তি হয়েছেন। তারপরের কাহিনি তো সবার জানা। আরও পরে উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে তাঁর প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে। ছাপা হয়েছিল ১৯৭২ সালে।

প্রায় কাছাকাছি সময়ে উপন্যাস লেখায় হাত দিয়েছিলেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। অবশ্য এর পেছনে সবচেয়ে বড় হাত ছিল তখনকার দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের। ষাটের দশকে দেশ পত্রিকায় পুজোসংখ্যায় একটি উপন্যাস ছাপানো হতো। কিন্তু ১৯৬৬ সালে সাগরময় ঘোষ তিনটি উপন্যাস ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। এদের একটি লিখবেন প্রবীণ, আরেকটি মধ্যবয়স্ক আর তৃতীয়টি লিখবেন তরুণ কোনো লেখক। সেবার তরুণ লেখক হিসেবে সুনীলকেই বেছে নেন দেশ সম্পাদক। এহেন প্রস্তাবে আক্ষরিক অর্থেই আকাশ থেকে পড়লেন সুনীল। কারণ, কবি হিসেবে তিনি বেশ নামকরা। টুকটাক গদ্য লিখছেন। কিন্তু কখনো গল্প বা উপন্যাস লেখেননি। সেই তিনিই কিনা লিখবেন আস্ত একটা উপন্যাস। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল তার। শুরুতে না না করলেন। কিন্তু সাগরময় ঘোষের কড়া ধমক খেয়ে লিখতে শুরু করলেন তিনি। কীভাবে শুরু করবেন কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলেন না। তখন লেখক জ্যাক কেরুয়ার একটা কথা মনে পড়ে যায় তাঁর। কেরুয়া একবার বলেছিলেন, তাঁকে উপন্যাসের প্লট খুঁজতে হয় না। নতুন উপন্যাস শুরুর আগে তিনি নিজের জীবনের কোনো একটা ঘটনা মনে করার চেষ্টা করেন। সেটি মনে পড়লে সেই ঘটনা থেকেই লেখা শুরু করেন। তারপর লেখাটা নিজের মনে যেদিকে খুশি যায়।

কেরুয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সুনীল প্রথম লাইনটি লিখতেও নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা মনে করলেন। কয়েক দিন আগে তাঁর এক বন্ধুর ভাই সকালে এসে ঘুম ভাঙিয়েছিলেন। কারণ তাঁর দাদা সে রাতে বাড়ি ফেরেনি। সুনীলের কাছে তিনি এসেছিলেন সেই দাদার খবর নিতে। সে কথা মাথায় রেখে তিনি লিখলেন, ‘সকালবেলা পরিতোষ এসে বলল, এসব কী শুরু করেছেন আপনারা।’ এভাবে একের পর এক লাইন জুড়ে দেড় মাসে শেষ করলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ। এরপর সাগরবাবুর তাড়ায় তিনি একে একে লিখতে থাকেন অরণ্যের দিনরাত্রিসহ নামকরা সব উপন্যাস।

সাগরবাবুর তাড়া খেয়েই উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও। সেটি ১৯৬৭ সালের কথা। আবারও দেশ পত্রিকার পুজোসংখ্যার প্রস্তুতি চলছে। শীর্ষেন্দুকে ডেকে দেশ সম্পাদক বললেন, সামনের পুজোসংখ্যায় শীর্ষেন্দু এবং বরেন গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে একজন উপন্যাস লিখবে। কে লিখবে তা-ও দুজনে কথা বলে ঠিক করে নিতে বললেন সাগরময় ঘোষ। বাড়ির কিছু ঝামেলার কারণে সেবার উপন্যাস লিখতে অস্বীকার করে বসেন বরেন গঙ্গোপাধ্যায়। পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে শীর্ষেন্দুর ঘাড়ে। তখন শীর্ষেন্দুর গুটিকয়েক গল্প কেবল প্রকাশিত হয়েছে পত্রপত্রিকায়। কিন্তু উপন্যাস লেখার ইচ্ছা বা সাহস তখনো হয়নি। সাগরদার গালাগালির ভয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও উপন্যাস লিখতে শুরু করেন শীর্ষেন্দু।

তখন তিনি থাকতেন কলকাতার পূর্ণ দাস রোডের এক মেসবাড়িতে। একটা চেয়ার-টেবিল কেনারও সামর্থ্য ছিল না তাঁর। খেয়ে না-খেয়ে কোনো রকমে মাথা গুঁজে থাকেন। সেই মেসের বিছানাতেই হামাগুড়ি দিয়ে বালিশকে টেবিল বানিয়ে লিখতে শুরু করলেন জীবনের প্রথম উপন্যাস। দু-চার লাইন লেখেন, থামেন, ভাবেন, তারপর আবার লিখে যান। এভাবে মাস দুয়েকের চেষ্টায় কোনো রকমে লিখে ফেললেন ঘুণপোকা

এদিকে বাংলার হাসির সম্রাট শিবরাম চক্রবর্তীর লেখালেখির শুরুটা কিন্তু বেশ মজার। শিবরামের তখন একেবারেই কচি বয়স। বই পড়তে বেশ ভালোবাসতেন। আর পড়তে গিয়েই একবার লেখার প্রবল ইচ্ছা ভুড়ভুড়ি কেটে উঠতে লাগল। সেই জ্বালা সহ্য করতে না পেরে তিনি একটা কবিতা লিখে ফেললেন। কবিতাটা বাসি হওয়ার আগে পাঠিয়ে দিলেন সে সময়ের নামকরা পত্রিকা প্রবাসীতে।

শিবরাম চক্রবর্তী

সে সময় এর সম্পাদক ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। তিনি কবিতাটি শিবরামের কাছে ফেরত পাঠালেন। সঙ্গে উপদেশ ভরা এক চিঠি। তাতে লেখা ছিল, ‘সংগীত, কবিত্ব আর ল্যাজ কারও ভেতরে থাকলে, তা আটকে রাখা যায় না। তোমার মধ্যে যদি সেটি থাকে, তাহলে প্রকাশ পাবেই। যথাকালে দেখা দেবেই। অযথা জোর করে অসময়ে তাকে টানাটানি করে বার করার কোন দরকার নেই।’

এমনধারা চিঠি পেয়ে শিবরাম জমে গেলেন। লজ্জা-অপমান নাকি রাগ-অভিমানে অনেক দিন লেখালেখি থেকে দূরে রইলেন। তবে একবার এক কাবুলিওয়ালার কাছে টাকা ধার নিয়েছিলেন। অনেক দিন ধার শোধ না করায় কাবুলিওয়ালা রেগেমেগে তার ওপর চড়াও হলেন। কিন্তু তিনি তো তখন বেকার। টাকা পাবেন কোথায়? ঋণ শোধ করতে শেষমেশ তিনি আবারও হাতে কলম তুলে নিলেন। এভাবেই জীবনভর একে একে মজার মজার সব গল্প লিখে গেছেন শিবরাম চক্রবর্তী।

শেষ করি নামকরা লেখক আর তাঁর উপন্যাস প্রকাশের কথা শুনিয়ে। গত শতকের বিশের দশকের শেষ দিকের ঘটনা। শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মামা উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। কলকাতা থেকে আইন পাস করে তিনি প্র্যাকটিস শুরু করেছেন ভাগলপুরে। আইন ব্যবসা করলেও সাহিত্য ছিল তাঁর কাছে নেশার মতো। প্রতি বিকেলেই নিজের বাড়িতে সাহিত্য আড্ডা বসাতেন স্থানীয়দের নিয়ে। সেই আড্ডায় নিয়মিত আসতেন এক বাঙালি যুবক। পরনে হাঁটু ছুঁই-ছুঁই খাটো ধুতি, গায়ে ইস্ত্রিবিহীন মার্কিন কাপড়ের পাঞ্জাবি। গেঁয়ো লোকটির এক হাতে থাকত একটা হারিকেন, আরেক হাতে একটা লাঠি। লোকটি প্রতিদিন আড্ডার এক কোণে সবার পেছনে লুকিয়ে থাকেন। কোনো কথা বলেন না। নিঃশব্দে আসেন, আড্ডা শেষে নিঃশব্দে চলে যান। এভাবেই কয়েক মাস কেটে গেল।

একদিন গ্রীষ্মের এক বিকেলে কালবৈশাখীর ঝড় উঠল। মুহূর্তেই বাইরে নেমে এল গাঢ় অন্ধকার। ধূলি উড়িয়ে, গাছের ডালপালা মুড়িয়ে ঝোড়ো বাতাস বইতে লাগল শনশন করে। আড্ডা হবে না ভেবে মন খারাপ হলো উপেন গাঙ্গুলির। কিন্তু বৈঠকখানার দরজা খুলতেই অবাক হয়ে এক ছায়ামূর্তিকে এগিয়ে আসতে দেখলেন। তার হাতে হারিকেন আর লাঠি। কাছে আসতেই বোঝা গেল, সেই লাজুক যুবকটি। ইতস্তত করে ঘরে ঢুকে যুবকটি হাতের হারিকেন, লাঠি, ছাতা এক কোণে রাখলেন। তারপর চুপটি গিয়ে বসলেন পেছনের সেই জায়গাটিতেই। আড্ডায় আর কেউ নেই দেখে অগত্যা সেই যুবকের সঙ্গেই আলাপ জমানোর চেষ্টা করলেন উপেনবাবু।

কথায় কথায় জানতে পারলেন, যুবকটি এখানে এক জমিদারের নায়েবের কাজ করেন। তা-ও প্রায় চার-পাঁচ মাইল দূরে। সেখান থেকে প্রতিদিন গভীর জঙ্গল আর জলকাদা মাড়িয়ে এই আড্ডায় যোগ দিতে আসেন তিনি। সাপখোপ আর জন্তু-জানোয়ারের ভয়েই হাতে লাঠি রাখেন। কিন্তু এই আড্ডায় কেন আসেন জিজ্ঞেস করতেই যুবকটি মিনমিন করে জানালেন, তিনিও টুকটাক সাহিত্যচর্চা করেন। তাই এই আড্ডায় আসা। একটা উপন্যাস লিখেছেন। উপন্যাসের কথা শুনে উপেনবাবুর চোখ কপালে উঠল। কারণ বাঙালির চিরায়ত স্বভাবমতো তরুণ বা যুবা বয়সে কেউ কবিতা লিখবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। তাই বলে আস্ত উপন্যাস। বস্তাপচা কিছু একটা লিখেছেন ভেবে তাচ্ছিল্য করতেও ছাড়লেন না। তবে কী লিখেছেন, সেটাও জানার কৌতূহল হলো তাঁর। আবার গেঁয়ো এক যুবককে একটু শিখিয়ে-পড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছেও হলো। তাই পরদিন সেটি আনতে বললেন যুবকটিকে। ভাবলেন, কেটেকুটে সাইজ করে লোকটাকে উপন্যাস লেখা শেখাবেন।

উপন্যাসটি পরদিন সসংকোচ উপেনবাবুর হাতে তুলে দিলেন যুবকটি। কিন্তু দিন যায় মাস যায় পাণ্ডুলিপির কথা আর বলেন না উপেনবাবু। যুবকটিও লজ্জায় কিছু জিজ্ঞেস করেন না। এভাবে দুই মাস কেটে গেল। হঠাৎ একদিন আড্ডা শেষে যুবকটিকে দেখা করতে বললেন উপেনবাবু। যুবকটির মনে সংশয়। কী জানি কী বলেন। কারণ, কলকাতায় থাকতে উপন্যাসটি প্রবাসী পত্রিকায় দিয়েছিলেন। কিন্তু পাণ্ডুলিপি ফেরত দিয়েছিল তারা।

আড্ডা শেষে একে একে সবাই চলে গেল। এবার যুবকটিকে সামনে বসিয়ে উপেনবাবু বললেন, ‘আমি আগাগোড়া পড়েছি। আপনার হবে। হবে কেন? হয়েছে?’ এ কথা শুনে বিমল আনন্দে উদ্ভাসিত হলো যুবকটির মুখ। আবেগরুদ্ধ গলায় প্রবাসী পত্রিকা থেকে প্রত্যাখ্যানের কথা জানালেন তিনি। তবে উপন্যাসটি নিজে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করবেন বলে সান্ত্বনা দেন উপেনবাবু।

এ ঘটনার কয়েক মাস পর কলকাতায় ফিরে বিচিত্রা নামের এক পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন উপেনবাবু। সেখানেই ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতে লাগল সেই যুবকের উপন্যাস। নাম পথের পাঁচালী। বুঝতেই পারছ সেই লাজুক, গেঁয়ো যুবকটির নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিচিত্রায় প্রকাশের পরই সাহিত্যমহলে বেশ সাড়া পড়ে যায়। একে বই হিসেবে প্রকাশের দায়িত্ব নেন শনিবারের চিঠি পত্রিকার সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। সে জন্য নগদ ৯০ টাকা আগাম পেয়েছিলেন তিনি। এভাবেই বাংলার সাহিত্যজগৎ জয় করেছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষে বলে রাখি, ১৯২৫ সালে পথের পাঁচালী লিখতে শুরু করেছিলেন বিভূতিভূষণ। শেষ হয়েছিল ১৯২৮ সালে।

সূত্র : বলপয়েন্ট/হুমায়ূন আহমেদ, অর্ধেক জীবন/সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, উপন্যাস সমগ্র ১, ২, ৩/শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সম্পাদকের বৈঠক/সাগরময় ঘোষ