আগামীর বিটিএস কে

২০১৩ সালের ১৩ জুন। কোরিয়ার সংগীতের জগতে একদল তরুণ যাত্রা শুরু করেন। নাম বিটিএস বা বাংতান সুনয়েনদান (Bangtan Sonyeondan)। অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ছিল তাঁদের শুরু, কিন্তু দ্রুতই তাঁরা কোরিয়ান পপ সংস্কৃতিকে পৃথিবীর মানচিত্রে এমনভাবে পরিচিত করে তোলেন, যা আগে কখনো হয়নি।

আরএমের র৵াপিং আর বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব, জিনের মেলোডিক ভোকাল, সুগা আর জে-হোপের শক্তিশালী র৵াপ ও প্রোডাকশন–অভিজ্ঞতা, জিমিনের নাচ, ভি-এর অভিনব ভয়েস টোন আর জাংকুকের অলরাউন্ড প্রতিভা—সব মিলিয়ে এই দল শুধু একটা ব্যান্ড নয়, বিশ্বসংস্কৃতির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

বিটিএস কোরিয়ান ভাষায় গান গেয়ে বিলবোর্ডের শীর্ষ স্থান দখল করেছে, জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছে, লাখো তরুণকে অনুপ্রাণিত করেছে ‘লাভ ইয়োরসেলফ’ (Love Yourself) বার্তা দিয়ে। কিন্তু ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে সামরিক দায়িত্ব আর একক কার্যক্রমে মনোযোগ দেওয়ার জন্য গ্রুপ হিসেবে তাঁদের কার্যক্রম থেমে হয়ে যায়। এই বিরতিতেই প্রশ্ন উঠতে থাকে, আগামীর বিটিএস কে?

আজকের এই লেখায় তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব সম্ভাবনাময় নতুন পাঁচটি দলের। যাদের গান কাছে টেনেছে লাখো মানুষকে।

টুমোরো বাই টুগেদার (TXT)

২০১৯ সালের ৪ মার্চ, বিগ হিট এন্টারটেইনমেন্ট হাজির হয় নতুন বয় ব্যান্ড নিয়ে। অনেকেই ভেবেছিলেন, এই পাঁচ তরুণ বিটিএসের ছায়া থেকে বের হতে পারবেন না। কিন্তু টুমোরো বাই টুগেদার বা সংক্ষেপে টিএক্সটি খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রমাণ করে দিয়েছে তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।

গানের পাশাপাশি নাচ, গল্প, কস্টিউম—এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তারা গড়ে তুলেছে নিজস্বতা। বিশেষ করে বিগ হিটের দীর্ঘ সময়ের অন্যতম ট্রেইনি ইয়নজুনকে (Yeonjun) অনেকেই ‘নেক্সট জেনারেশন পারফরমার’ হিসেবে দেখছেন।

প্রথম গান ‘ক্রাউন’ (Crown) মুক্তির পর থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে এই ব্যান্ড। গানের কোরিওগ্রাফি আর দৃশ্যায়নের ব্যবহার কে–পপ ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ করেছে নতুন আঙ্গিক। এ ছাড়া রঙিন কৈশোরের আবহ নিয়ে ‘ব্লু আওয়ার’ (Blue Hour), ‘সুগার রাশ রাইড’ (Sugar Rush Ride) ভক্তদের মনে জায়গা করে নেয়।

আরও পড়ুন

টিএক্সটির গল্প বলার ধরন অনেকটা বিটিএসের শুরুর দিকের কাজগুলোর মতো। কৈশোরের সমস্যাগুলোর মোকাবিলা, স্বপ্ন আর বাস্তবতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা আছে তাদের উপস্থাপনায়। তবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কল্পনার প্রাধান্য বিটিএসের চেয়ে বেশি। দ্য ক্যাওস চ্যাপ্টার (The Chaos Chapter) সিরিজ বা মিনিসোড ১: ব্লু আওয়ার (Minisode1: Blue Hour) অ্যালবামে দেখা যায় একই ধারাবাহিকতা।

টুমোরোর দ্য নেম চ্যাপ্টার: টেম্পটেশন (The Name Chapter: TEMPTATION) ২০২৩ সালে বিলবোর্ড ২০০ চার্টে ১ নম্বরে জায়গা করে নেয়।

স্ট্রে কিডস (Stray Kids)

২০১৮ সালে যখন জেওয়াইপি এন্টারটেইনমেন্ট নতুন দল জনসমক্ষে এনেছিল, অবাক হয়েছিল অনেকেই। স্ট্রে কিডস সাধারণ কে–পপের ছাঁচে তৈরি নয়। আত্মপ্রকাশের আগেই থ্রি-রাচা (3RACHA) নামের তিন সদস্যদের একটি সাব–গ্রুপের মাধ্যমে অনেক আগে থেকেই মিউজিক নিয়ে কাজ করছিল তারা।

আরও পড়ুন

আট সদস্যের এই দলের প্রত্যেকের পারফরম্যান্স প্রশংসিত হয়েছে। ‘গডস মেনু’ (Gods Menu), ‘থান্ডারাস’ (Thunderous), ‘ম্যানিয়াক’ (MANIAC) গান দিয়ে স্ট্রে কিডস শক্তিশালী র৵াপ ও কোরিওগ্রাফি নজর কেড়েছে ভক্তদের। অনেকটা বিটিএসের ‘ফায়ার’, ‘মাইক ড্রপ’ গানগুলোর মতো আবহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে স্ট্রে কিডস।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে একাধিকবার বিলবোর্ড ২০০ চার্টে শীর্ষ স্থান দখল করেছিল দলটি।

এনহাইপেন (ENHYPEN)

এনহাইপেন কে–পপের জগতে কোনো এন্টারটেইনমেন্ট কোম্পানির ছায়ায় বড় হয়নি। তাদের গল্পটা শুরু হয় রিয়েলিটি শো ‘আই-ল্যান্ড’ (I-LAND) থেকে। নাটকীয়তায় ঠাসা এই যাত্রা শেষে ২০২০ সালে বিলিফট ল্যাব (Belift Lab) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে এনহাইপেন।

সাত সদস্যের এই দলের নাম ‘ENHYPEN’ হওয়ার কারণটা আসলে ‘হাইফেন’ চিহ্নের মতোই। হাইফেন যেভাবে যুক্ত করে, সেভাবেই ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য একসঙ্গে নিয়ে নতুন এক পরিচয় গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন ব্যান্ডটির সদস্যরা। আত্মপ্রকাশের পরপরই তাঁদের ‘গিভেন-টেকেন’ (Given-Taken), ‘ড্রাংক-ডেজড’ (Drunk-Dazed), আর ‘ফিভার’ (Fever) গানগুলো হইচই ফেলে দেয় কে–পপের দুনিয়ায়। কোরিওগ্রাফি, থিম, আলোর কাজগুলো বেশ প্রশংসা কুড়ায় দর্শকমহলে। মজার ব্যাপার হলো, দক্ষতার সঙ্গে পুরো দলের পারফরম্যান্স চোখে পড়ার মতো।

আরও পড়ুন

বিশ্বব্যাপী কনসার্ট করছে এনহাইপেন, জায়গা করে নিচ্ছে বিভিন্ন চার্টে, মোটের ওপর বেশ বড় ভক্তকুল তৈরি হয়েছে তাদের। সংযোগ, আবিষ্কার আর বেড়ে ওঠার প্রত্যয় নিয়ে বড় হওয়া দলটিকে নিয়ে অনেকেই আশাবাদী।

এটিজ (ATEEZ)

২০১৮ সালে কেকিউ এন্টারটেইনমেন্ট থেকে আত্মপ্রকাশ করে আট সদস্যের ব্যান্ড এটিজ। শুরু থেকেই কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী পরিবেশনা হওয়ায় কোরিয়ান গণমাধ্যম তাদের ‘পারফরম্যান্স কিংস’ উপাধি দিয়েছিল।

থিয়েট্রিক্যাল স্টাইল, দৃশ্যায়ন আর রহস্যময় ন্যারেটিভ কে–পপ পেরিয়ে যেন ‘সিনেমাটিক ইউনিভার্স’-এ নিয়ে গেছে তাদের পারফরম্যান্স। ‘সে মাই নেইম’ (Say My Name), ‘ওয়েভ’ (Wave), ‘ওয়ান্ডারল্যান্ড’ (Wonderland) কিংবা ‘গেরিলা’ (Guerrilla) গানগুলোতে মিউজিকের পাশাপাশি চিত্রনাট্যও সাড়া ফেলেছে।

শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতেই নয়, ইউরোপ ও আমেরিকায় বড় ধরনের ভক্তমহল তৈরি হয়েছে এটিজের। ২০২৪ সালে কোচেলাতে পারফর্ম করেছিল দলটি।

আরও পড়ুন

নিউজিনস (NewJeans)

কে–পপের দুনিয়ায় মেয়েদের দল নিউজিনসের শুরুটা হয় ২০২২ সালে। তাদের স্টাইল, কনসেপ্ট ও সাউন্ড কে–পপের প্রচলিত ‘হাই বিট’ আর চকচকে গ্ল্যামারকে পাশ কাটিয়ে সফট, মেলোডিক ধারাগুলোকে প্রাধান্য দিয়েছে।

দলটির ‘অ্যাটেনশন’ (Attention), ‘হাইপ বয়’ (Hype Boy), ‘কুকি’ (Cookie), ‘ডিটো’ (Ditto) গানগুলো নতুন ঘরানা সৃষ্টি করেছিল। ভোকাল টোন এবং কোরিওগ্রাফি সহজ, স্বাভাবিক অথচ আবেগঘন হওয়ার কারণে অনেকের কাছে BTS-এর ‘স্প্রিং ডে’ (Spring Day) বা ‘বাটারফ্লাই’ (Butterfly) গানের মতো লেগেছিল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক ভক্ত দলটির। ২০২৩ সালে নিউজিনসের ‘ডিটো’ গানটি বিলবোর্ড তালিকায় ১০০–তে জায়গা করে নেয়।

বিটিএস নিঃসন্দেহে কোরিয়ান পপের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। কিন্তু তাদের সময়, পরিস্থিতি ও প্ল্যাটফর্ম—সবকিছু ছিল ভিন্ন পটভূমি। এখন কে–পপের দুনিয়া অনেক বড়, অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক, অনেক বেশি বৈচিত্র্যময়। বিটিএস ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী প্রভাব গড়ে তুলেছিল। নতুন গ্রুপগুলোকে একেবারে শুরু থেকে আন্তর্জাতিক চাহিদা আর ভক্ত–সংস্কৃতির চাপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে।

‘আগামীর বিটিএস কে?’ এই সরল প্রশ্নের সহজ কোনো উত্তর নেই। সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে উঠে আসা নতুন ব্যান্ডগুলো তো আছেই, স্বয়ং বিটিএসের পথচলা এখনো কতটুকু বাকি, সেটাও দেখার বাকি আছে।

আরও পড়ুন