হুমায়ূন আহমেদের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি কাঁদছেন
অভিনেতা ফারুক আহমেদ দীর্ঘদিন লেখক হুমায়ূন আহমেদের পরিচালিত বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ ফারুক আহমেদকে স্নেহ করতেন। ফারুক আহমেদ হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বিভিন্ন সময় স্মৃতিকথামূলক লেখা লিখেছেন। এই লেখাটি নেওয়া হয়েছে ফারুক আহমেদের বই 'আমার না বলা কথা' থেকে।
মোহন ভাইয়ের অফিস তখন কাকরাইলে। আমি আমার অফিসে কাজ করছি। এমন সময় ল্যান্ডফোনে কল আসল। জুয়েল রানা নুহাশ চলচ্চিত্রের অফিস থেকে।
ফোন করেছে, স্যার আপনাকে অফিসে ডেকেছেন।
কেন ডেকেছেন?
আমি জানি না। আসলে স্যারের কাছে জানতে পারবেন।
আমি দুপুরের পর হুমায়ূন ভাইয়ের অফিসে গেলাম। গিয়ে দেখি হুমায়ূন ভাই মন খারাপ করে চেয়ারে বসে আছেন।
আমি আস্তে আস্তে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে হুমায়ূন ভাই?
চট্টগ্রাম থেকে এক ভদ্রলোক ফোন করেছিলেন। তার ছেলের ব্লাড ক্যান্সার।
কিছু খেতে চায় না। কিন্তু আজ রবিবার নাটকে তোমার 'মতি' চরিত্রটি দেখলে সে ভাত খায়। তার ছেলের মতি চরিত্রটি পছন্দ। খাওয়ার সময় হলেই তিনি আজ রবিবারের নাটকের সিডি চালিয়ে মতি চরিত্রটি ছেলেকে দেখান। কথা বলতে বলতে হুমায়ূন ভাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। তার চোখে পানি। আমি বুঝতে পারলাম না কী বলব। বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলাম।
তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, তারা ঢাকায় এসে তোমার সাথে দেখা করতে চায়। অসুস্থ ছেলেটি তোমাকে দেখবে। যদি কিছুটা আনন্দ পায়। তোমার নম্বর পায়নি। আমার অফিসের নম্বরে ফোন দিয়েছিল।
ভাই অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় আসতে হবে কেন? আমি চট্টগ্রাম যাই।
গিয়ে ছেলেটার সাথে দেখা করে আসি?
না, তোমার যেতে হবে না। ছেলের বাবা ছেলেকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে ঢাকায় আসবেন। আমি বলেছিলাম তোমাকে পাঠানোর কথা। ছেলের বাবা যেতে নিষেধ করেছে। আমি ফোন দিয়ে জানি তারা কবে ঢাকায় আসবে। যেদিন ঢাকায় আসবে আমি তোমাকে ফোন দিয়ে জানাব। তুমি অফিসে চলে আসবে।
আচ্ছা ভাই।
হুমায়ূন ভাই ছেলেটির বাবাকে ফোন দিলেন। ফোন ধরল ছেলের বাবা।
ছেলের বাবা বললেন, আমার ছেলের অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ। রক্ত বদলাতে হবে। এই অবস্থায় ছেলেকে ঢাকায় নেয়া সম্ভব না। আমরা আপাতত এখানে চিকিৎসা করাব। কিছুটা সুস্থ হলে ছেলেকে নিয়ে ঢাকা আসব।
আমি হুমায়ূন ভাইকে বললাম,
আজকে তাহলে আসি। ছেলের বাবা ছেলেকে নিয়ে আসলে আমাকে কল দিলে আমি চলে আসব।
সেদিনের মতো আমি অফিস থেকে চলে এলাম। সপ্তাহখানেক পর আবার নুহাশ চলচ্চিত্রের অফিস থেকে ফোন। জুয়েল রানা বলল, ফারুক ভাই, হুমায়ূন স্যার আপনাকে অফিসে আসতে বলেছেন। জরুরি।
ভাবলাম চট্টগ্রাম থেকে সেই ভদ্রলোক হয়তো তার অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে ঢাকা এসেছেন। আমি মনে মনে ছেলেটার একটা অবয়ব কল্পনা করলাম। ছোট্ট একটা ছেলে, ক্যান্সারে দুর্বল। তার মা তাকে 'মতি'র নাম বলে ভাত খাওয়াচ্ছে। সে তার বাবার হাত ধরে ঢাকা এসেছে মতিকে দেখার জন্য।
অফিসে পৌঁছে দেখি হুমায়ূন ভাই ছাড়া অফিসে আর কেউ নেই।
ভাই লোকটি কি ছেলেকে নিয়ে ঢাকা এসেছে?
হুমায়ূন ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ছেলেটা মারা গেছে।
আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারলাম না। তীব্র মানসিক ধাক্কা খেলাম। হুমায়ূন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি কাঁদছেন। কিছু না বলেই আমি চোখ মুছতে মুছতে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। অসুস্থ ছেলেটি মতিকে সামনাসামনি কখনো দেখেনি। এই জীবনে দেখবেও না। কিন্তু তার প্রিয় মতি তাকে সারাজীবন মনে রাখবে।
ফারুক আহমেদ, অভিনেতা