অ্যানিমেকথন

অ্যানিমের কাহিনি হয় একটু পরিণত আর পুরোটাই থাকে অনিশ্চয়তায় ভরপুর

জানি, তোমাদের মধ্যে অ্যানিমে ভক্ত অনেক। আর আমিও তোমাদের মতোই অ্যানিমে পাগল। তবে এত দিন অ্যানিমে শুধু দেখেই গেছি। তো এবার একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে দেখলাম অ্যানিমে শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক নেহাত কম হয়নি। কারও মতে অ্যানিমেশন আর কারও মতে ফ্রেঞ্চ শব্দ ‘ডেসিমে আনিমে’ থেকে অ্যানিমে শব্দটির উত্পত্তি। স্বাভাবিকভাবে জাপান থেকে নির্মিত অ্যানিমেটেড টিভি সিরিজ ও মুভিকে ডাকা হয় অ্যানিমে নামে। অ্যানিমের জন্ম ১৯১৭ সালে হলেও সত্যিকারভাবে অ্যানিমের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬০ সালে কিংবদন্তি কার্টুনিস্ট ওসামু তেজুকার হাত ধরে। অনেকে অ্যানিমে আর কার্টুন এই দুটি জিনিসকে গুলিয়ে ফেলে। অবশ্য এটা মনে করাই স্বাভাবিক। কারণ এই দুটি বস্তুই তৈরি হয় টুডি বা ত্রিডি অ্যানিমেশনের মাধ্যমে। কিন্তু তারা কোনোভাবেই এক নয়। কার্টুন তৈরি করা হয় মূলত বাচ্চাদের কথা মাথায় রেখে। তাই গল্প যথাসম্ভব সরল হয়। ভায়োলেন্স, প্রেম, বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব ইত্যাদিকে যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়া হয়। গল্পের শেষ হয় ‘হ্যাপি এন্ডিং’ দিয়ে। এ কারণে বাচ্চাদের মধ্যে কার্টুন খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু সমস্যা হয় যখন সেই বাচ্চাটি কৈশোরে পৌঁছায়। এই একই ধরনের কাহিনি, গল্পের ওপর সে আকর্ষণ হারাতে থাকে। সে চায় আরও ম্যাচিওর কিছু, এমন কিছু যা তার পছন্দের সঙ্গে মেলে। আর সেই জায়গাটাকেই টার্গেট করে অ্যানিমে। অ্যানিমেতে কাহিনিকে যথাসম্ভব একটু পরিণত করা হয়। বিভিন্নজনের পছন্দের কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন ধরনের কাহিনি তৈরি করা হয়। এই ধরনগুলোর মধ্যে আছে খেলা, ম্যাজিক, অ্যাকশন, হরর, রোমান্টিক, ড্রামা, কমেডি, থ্রিলার, সামুরাই, সায়েন্স ফিকশন ইত্যাদি।

অ্যানিমের মূল শক্তি হচ্ছে এর কাহিনির অভিনবত্ব। বাস্তব বা অবাস্তব যাই হোক না কেন, অ্যানিমের কাহিনিগুলো খুব যত্ন নিয়ে তৈরি করা হয়। কাহিনিতে যথাসম্ভব থাকে নতুনত্ব। ‘ডেথ নোট’ নামের অ্যানিমের কথাই ধরা যাক। একজন চৌকস ছাত্রের হাতে যদি একটা নোটবুক আসে যেখানে কারও নাম লেখা হলে সে মারা যাবে, তাহলে কী ঘটতে পারে? অ্যানিমেতে কাহিনি ও চরিত্রগুলোকে একটু সময় নিয়ে তৈরি করা হয়, যেন দর্শকেরা এর সঙ্গে পুরোপুরি একাত্ম হতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় শক্তিশালী সংলাপ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে দর্শককে ধরে রাখে কাহিনির অনিশ্চয়তা। কার্টুনে যে রকম নিশ্চয়তা থাকে যে সত্যের জয় হবে, অ্যানিমেতে সে রকম কোনো নিশ্চয়তা নেই। খুব যত্ন নিয়ে তৈরি করা একটা চরিত্র হঠাত্ করে মারা যেতে পারে। গল্পের প্রধান চরিত্র শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলে গল্প শেষ হওয়ার আগে পর্দা থেকে দর্শকের চোখ সরানোর কোনো জো থাকে না। এ ছাড়া অ্যানিমেতে পুরোপুরি ভালো মানুষ বা পুরোপুরি খারাপ মানুষ বলে কোনো কথা নেই। এখানে প্রত্যেককেই মনে হয় দোষ-গুণ মেশানো এক-একজন মানুষ হিসেবে, শুধু আদর্শের ভিন্নতা একজনকে বানিয়েছে নায়ক, আরেকজনকে ভিলেন।

অ্যানিমে সম্পর্কে অনেকের মধ্যে অনেক ভুল ধারণা আছে। একটা খুব ভুল ধারণা হচ্ছে, অনেকে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্মিত অ্যানিমেশন মুভিকে অ্যানিমে বলে ডাকে। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা এবং এগুলোকে কোনোভাবেই অ্যানিমে বলে ডাকা হয় না। অ্যানিমে সম্পর্কে আরও দুটি ভুল ধারণা হচ্ছে, অ্যানিমে কেবল জাপানি কমিক (মাঙ্গা) থেকে তৈরি হয় এবং অ্যানিমের আর্ট স্টাইল একই রকম (বড় চোখ, রঙিন চুল ইত্যাদি)। একটা সময় যদিও সব অ্যানিমে জাপানি কমিক থেকে তৈরি হতো কিন্তু এখন বিভিন্ন ছোটগল্প বা উপন্যাস থেকেও অ্যানিমে তৈরি করা হয়। আর আর্ট স্টাইল পুরোপুরি নির্ভর করে আর্টিস্টদের ওপর। এখন অনেক আর্টিস্টই তাঁর নিজের মতো করে চরিত্র তৈরি করেন, যেখানে ঐতিহ্যবাহী জাপানিজ আর্ট থেকে শুরু করে পাশ্চাত্যের স্টাইলের মিশ্রণ খুঁজে পাওয়া যায়। গত কয়েক বছরের অ্যানিমে ইন্ডাস্ট্রির সাফল্যের পেছনে এই আঁকার ধরনের বৈচিত্র্যের একটি বড় গুরুত্ব আছে।

আসলে অ্যানিমের উত্পত্তি হয়েছিল জাপানি দর্শকের বিনোদনের খোরাক জোগাতে। কিন্তু আজ পুরো বিশ্ব আক্রান্ত অ্যানিমে-জ্বরে। এখনকার সময়ের কিশোরেরা সুপারম্যান বা এক্সম্যান হওয়ার অলীক স্বপ্নে বিভোর থাকে না। তাদের আইডল হয় নারুতো, যে কিনা তার দুর্বলতা ও প্রতিকূলতা পেছনে ফেলে সত্যি করতে চায় তার স্বপ্নকে, ক্যাপ্টেন টুবাসা যে জাপান ফুটবল টিমকে চায় বিশ্বকাপ জেতাতে, কিংবা ইচিগো যে কিনা বন্ধুর জন্য এক অসীম শক্তিশালী বাহিনীকে নিজের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলতে পারে অনায়াসে। স্বপ্ন দেখার, উদ্দীপ্ত করার এই ক্ষমতাই অ্যানিমেকে তৈরি করেছে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী মিডিয়ায়।

(কিশোর আলোর জানুয়ারি ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)