কথায় বলে, কল্পনার সীমা নাকি আকাশের সমান! যেখানে দৃষ্টি পৌঁছে, কিন্তু হাতের নাগাল পাওয়া যায় না, সেখানে কল্পনা ছাড়া আর উপায়ই বা কী? তাই তো, দূর আকাশের চাঁদ আমাদের আপন হয় চাঁদের বুড়ির বেশে। আর তারাগুলোকে আমরা ভাবি ভিনগ্রহের কোনো বন্ধুর আবাস। এখন তো রহস্যময় মহাকাশের অনেক কিছুই আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু তবু আরও অনেকটাই আমাদের জানার বাইরে এখনো। সেই অজানাগুলোকেই মনের চোখে কল্পনায় ভর করে নির্মিত হয়েছে অনেক ছবি।
মহাকাশ ভ্রমণ নিয়ে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রথম চলচ্চিত্রটির নাম হচ্ছে লা ভয়াজ ল্যান্স লা লুন, ইংরেজিতে আ ট্রিপ টু দ্য মুন। ১৯০২ সালে ফ্রান্সে নির্মিত এই নির্বাক ছবির কাহিনি হচ্ছে চন্দ্রাভিযানে যাওয়া একদল নভোচারীকে নিয়ে, যাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয় চাঁদের অধিবাসী সেলেনিটসদের। বিশাল এক কামানের গোলায় মানুষকে বেঁধে মানুষের মুখের মতো দেখতে একটি চাঁদের দিকে ছোড়া হয়। অবশ্য এই ধারণাটা মোটেও বিজ্ঞানসম্মত নয়। তারপরও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিনির্ভর চলচ্চিত্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করা ছবি হচ্ছে এটি। মহাকাশ ভ্রমণ নিয়ে আরও একটি বিখ্যাত ছবি হচ্ছে অ্যাপোলো ১৩। একদম কল্পনা নয়, এ ছবিটির কাহিনি পুরোপুরি সত্যি ঘটনার ওপর ভিত্তি করে। তৃতীয়বারের মতো চাঁদের বুকে অভিযান করার জন্য পাঠানো হয়েছিল জিম লোভেল আর তাঁর দলকে। কিন্তু দুর্ঘটনাক্রমে তাঁদের নভোযানটি বিধ্বস্ত হয়। এরপর কীভাবে তাঁরা আবার পৃথিবীতে ফিরে এলেন, তারই রোমাঞ্চকর বর্ণনা উঠে এসেছে ১৯৯৫ সালের এই চলচ্চিত্রে।
হালের প্রযুক্তি অনেক এগিয়ে যাওয়ায় এখন এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করা তুলনামূলক একটু সুবিধাজনক। যেমন বলা যায়, ২০১৩ সালের গ্র্যাভিটির কথা। নভোযান ধ্বংস হওয়ার পর এক নভোচারী মহাকাশে টিকে থাকার লড়াইয়ে নামেন। কোনো রসদ ছাড়াই খুঁজতে থাকেন পৃথিবীতে ফেরার পথ। যদিও গল্পে কিছু সমস্যা ছিল, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের কাছে চলচ্চিত্রটি জনপ্রিয় এর অসাধারণ ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট ও সাউন্ড ইফেক্টের কারণে। আরও আছে গত বছরই বের হওয়া ছবি দ্য মার্শিয়ান। মঙ্গল গ্রহের অধিবাসীদের বলা হয় মার্শিয়ান। কিন্তু, এই ছবির মার্শিয়ান মার্ক ঠিক শখ করে মঙ্গল গ্রহে থাকতে চায়নি। ভয়ংকর ঝড়ে পৃথিবীতে ফিরতে বাধ্য হয় মঙ্গল গ্রহ অভিযানে থাকা একদল নভোচারী। মৃত ভেবে ফেলে আসে আহত আর অচেতন মার্ককে। সেখান থেকে একা জীবনের শুরু তাঁর, সেটাতেই আছে নানা বাঁক, নানা রোমাঞ্চ আর সংগ্রামের কাহিনি। সাইফাইনির্ভর চলচ্চিত্রগুলো শুধু যে মানুষকে আনন্দই দেয়, তাও কিন্তু নয়। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির ভিত গড়ে দিয়েছে এমন অনেক চলচ্চিত্র। যেমন বলা যায় স্টার ট্রেক সিরিজের কথা। এখানে দেখানো বিভিন্ন প্রযুক্তি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত হয়েছে আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের অনেক কিছু। স্টার ট্রেকে ব্যবহূত কমিউনিকেটরই মোবাইল ফোন আবিষ্কারের পেছনে মূল অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। এ ছাড়া এই ছবিতে দেখানো হয়েছিল সহজে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়ার হাইপার ড্রাইভ প্রযুক্তি, যা নিয়ে অনেক বিজ্ঞানীই এখন কাজ করছেন। তবে মহাকাশ ভ্রমণ নিয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বিখ্যাত আর অদ্ভুত উদ্ভাবনী দিয়ে ভরপুর চলচ্চিত্র হচ্ছে ২০০১: আ স্পেস অডিসি। আর্থার সি ক্লার্কের ছোটগল্পের ওপর ভিত্তি করে ১৯৬৮ সালে ছবিটি বানিয়েছিলেন বিখ্যাত পরিচালক স্ট্যানলি কুবরিব। একদল নভোচারী যাত্রা শুরু করে রহস্যময় একটি অভিযানে। এ অভিযানে তাঁদের নভোযানের কম্পিউটার অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। চাঁদে খুঁজে পাওয়া যায় বিচিত্র এক কালো বস্তু, যার মাধ্যমে অতীত আর ভবিষ্যতের যোগাযোগ ঘটানো যায়। একে বলা হয় বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি নিয়ে বানানো সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত চলচ্চিত্র।
এ ছাড়া দেখতে পারো মুন, যেখানে একজন নিঃসঙ্গ অভিযাত্রী তিন বছর চাঁদে থেকে বাড়ি ফেরার সময় মুখোমুখি হন রহস্যময় কিছু ঘটনার। আরও আছে সানশাইন, সূর্যকে বাঁচানোর জন্য একদল বিজ্ঞানীর রোমাঞ্চকর অভিযান। ইটি, স্টার ওয়ারস, ইন্টারস্টেলার, অ্যাভাটার, সোলারিস, সেরেনিটি, এলিয়েন, ওয়াল-ই, মহাকাশ নিয়ে দেখার মতো আছে এমন আরও অনেক ছবিই। এর পাশাপাশি দেখতে পারো মহাকাশ নিয়ে নির্মিত ২০১৪ সালের ১০ পর্বের প্রামাণ্যচিত্র কসমস-আ স্পেসটাইম ওডিসি। প্রামাণ্যচিত্র শুনতে একটু খটোমটো লাগলেও, একেবারে গল্পের ঢঙে এখানে বলা হয়েছে মহাকাশের বিভিন্ন আশ্চর্য তথ্য। ১৯৮০ সালেও কসমস শিরোনামে আরেকটি বিখ্যাত প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছিলেন কার্ল সাগান। সেটিও চাইলে দেখে নিতে পারো।
বুঝতেই পারছ, মহাকাশ নিয়ে নির্মিত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিনির্ভর চলচ্চিত্রের মধ্যে অনেকগুলোই এখন আর শুধু কল্পনা নয়, আমাদের হাতের মুঠোয়। এটিই আসলে এই ছবিগুলোর সাফল্য, মানুষকে বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহিত করা, নতুন কিছু আবিষ্কারের রসদ জোগানো। এবার তোমার পালা! দেখা যাক, স্টার ট্রেকের হাইপার ড্রাইভ নাকি ইন্টারস্টেলারের ওয়ার্ম হোল; কোনটা তোমার হাত ধরে মহাকাশে যাত্রা করে!