ঈদের সময় সব বোন মিলে আমার জন্য ড্রেস ডিজাইন করত

ছোটবেলায় বেশির ভাগ ঈদ কেটেছে খুলনার খালিশপুরে। আমরা তখন দৌলতপুর জুট মিল এলাকায় থাকতাম। ঈদের সময়টা থাকা হতো ওখানেই। চাকরি থেকে আব্বার অবসরের পর আমরা থাকতাম খালিশপুরের হাউজিং এলাকায়। তখন ঈদটা ওখানেই কাটত। ঈদের সময় সব বোন মিলে আমার জন্য ড্রেস ডিজাইন করত। তারপর দরজির দোকানে গিয়ে ড্রেস সেলাই করা হতো। সবচেয়ে মজা লাগত এ ব্যাপারটা।

দৌলতপুর জুট মিলে আমরা যেখানে থাকতাম, ওখানে আমরাসহ ৩৬টি পরিবার থাকত। ঈদের সময় সব বাসায় ঘোরাঘুরি করতাম। কী যে আনন্দ হতো! আব্বার সব বন্ধু, মানে আমার চাচারা নামাজের পর বাসায় আসতেন। আসত আমাদের ভাইবোনের বন্ধুরাও। হইহুল্লোড করে দারুণ কাটত সময়টা।

ছোটবেলার ঈদে আরেকটা মজার ব্যাপার ছিল—টাকা জমিয়ে জুট মিলের গেটে স্প্রাইট ও ফ্যান্টার স্টল দেওয়া। নিজেরা তো বিক্রি করতামই, আবার নিজেদের টাকা জমিয়ে স্প্রাইট, ফ্যান্টা খাওয়াই যেন একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নদীর পাড়ঘেঁষা এলাকায় আমরা সবাই মিলে বেড়ে উঠেছি। অনেকগুলো পরিবার। কী অসাধারণ মিলমিশ। একেকজন একেক জায়গার হলেও ঈদে পারিবারিক একটা আবহ থাকত।

ঈদকার্ড নিয়েও ঘটত মজার ঘটনা। একটু বড় হচ্ছিলাম যখন, জুট মিল এলাকার বড় ভাইয়েরা যারা আমাকে পছন্দ করত, তারা আমার ছোট বোনের মাধ্যমে ঈদকার্ড পাঠাত আমাকে, চকলেটসহ। খুবই মজা লাগত এগুলো। আমার মনে আছে, ঈদকার্ড লিখে বন্ধুদের দেওয়ার চল ছিল। তারপর অনেক বন্ধু ঈদের আগে বা পরে পরে মিল এলাকা ছেড়ে চলে যেত, তাদের ঈদকার্ড পোস্ট করতাম। ভিউকার্ডও ছিল। হাতে আঁকতাম। ঈদের সময় ঈদকার্ড আসলে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ছিল।

ঈদের দিন সকাল থেকে উৎসব উৎসব একটা ব্যাপার ছিল। ঘুম থেকে উঠতাম খুব সকালে। আগের দিন রাতে ফুলটুলও চুরি করতাম। এদিকে ভোরবেলা ভাইয়াদের নামাজের জন্য ডাকতেন আব্বা। তারা ঘুম থেকে ওঠা নিয়ে কী যে বিরক্ত হতো। এগুলো দেখেও খুব মজা লাগত। ঈদের দিন সকালে আম্মার হাতে মাষকলাইয়ের ডালের খিচুড়িটা খুব স্পেশাল। সব সময় ঈদের সকালেই খেতাম এটা। ঈদের সকালটাই ম্যাজিকের মতো লাগত। নতুন জামা পরা, ঈদের আগে নতুন জামা লুকিয়ে রাখা—সবই অন্য রকম লাগত। আমি অবশ্য কখনোই ঈদের জামা লুকাতাম না, উল্টো সবাইকে দেখিয়ে দিতাম। রাতের বেলা সবাই একসঙ্গে বসে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ দেখতাম।

ঈদ আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে উদার হতে হয়, ওয়েলকামিং হতে হয়, কীভাবে সহজভাবে মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়, জীবনকে কীভাবে উৎসবমুখর করতে হয়। ধনী-গরিব–ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে এক হয়ে সবাই একসঙ্গে চলতে হয়—এগুলোই আমাকে শিখিয়েছে ঈদ।