ডিজনির জাদু!

জন লেসেটারের শুরুটা হয়েছিল কিন্তু ডিজনিতেই

মিকি মাউস, মিনি মাউস, ডোনাল্ড ডাক, প্লুটো থেকে শুরু হয়ে হালের বোল্ট; একটু হলেও অ্যানিমেশন দুনিয়ার খোঁজ রাখে, অথচ এদের চেনে না, এমন মানুষ বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওয়াল্ট ডিজনির নাম শুনেছ তো? ওই যে ছবিঅলা বই আঁকত, সেই মানুষটা। সিনডারেলা, স্লিপিং বিউটি, পোকাহনতাস, স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ফসসহ তাঁর আরও অনেক ছবির বই আমরা দেখেছি। তাঁরই অ্যানিমেশন ছবি বানানোর কারখানার নাম ওয়াল্ট ডিজনি অ্যানিমেশন স্টুডিও। আর শুরুতে যে নামগুলো বললাম, সেসব কার্টুন বানানোর মূল কারিগরও তিনি! ওয়াল্ট ডিজনি অ্যানিমেশন স্টুডিওর যাত্রা শুরু হয় ১৯২৩ সালের অক্টোবর মাসে, তারিখটা ছিল ১৬ অক্টোবর। সেই হিসাবে বয়স দাঁড়াল ৯০ বছর। এই বয়সে বুড়িয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু ওয়াল্ট ডিজনি অ্যানিমেশন স্টুডিও যেন এখনো কৈশোরেই আটকে আছে! আর তাই তো এখনো তারা সদর্পে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অ্যানিমেশনের জগৎ। এ পর্যন্ত এই স্টুডিও থেকে নির্মিত হয়েছে ৫৩টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের অ্যানিমেশন ছবি আর অসংখ্য শর্ট ফিল্ম। শুরুটা করেছিলেন ওয়াল্টার এলিয়াস ডিজনি এবং তার ভাই রয় ও. ডিজনি। এখন এই স্টুডিওর হাল ধরে আছেন এডউইন ক্যাটমাল ও জন লেসেটার। জন লেসেটার তাঁর কর্মজীবনের শুরুটা করেছিলেন এই ডিজনিতেই। কিন্তু কম্পিউটার অ্যানিমেশনকে উৎসাহিত করায় এখান থেকে তাঁকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর লেসেটার পিক্সার শুরু করেন। সেখান থেকে মুক্তি পায় টয় স্টোরি। ২০০৬ সালে পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিওকে কিনে নেয় ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি, প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে। এর ফলে জন লেসেটার একই সঙ্গে পিক্সার এবং ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওর প্রধান সৃজনশীল কর্মকর্তা হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন। ডিজনির বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে আছে স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ফস, ফ্যান্টাসিয়া, ১০১ ডালমেশিয়ানস, দ্য লায়ন কিং, দ্য লিটল মারমেইড, আলাদিন, মুলান, ট্যাঙ্গেলড, ফ্রোজেন। আর বিখ্যাত শর্ট ফিল্ম হলো ‘মিকি মাউস’ সিরিজ, পেপারম্যান, ট্যাঙ্গেলড এভার আফটার, সুপার রাইনো, গেট আ হর্স। এ ছাড়া চলতি বছরের নভেম্বরে মুক্তি পাবে মার্ভেল কমিকস-এর চরিত্র নিয়ে তৈরি ছবি বিগ হিরো সিক্স।

এই ছবি দেখে কি মনে হয় ডিজনি ইঁদুরকে ভয় পেতেন?

ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওর ছবিগুলো নানা কারণেই বিখ্যাত। তবে এ সাফল্যের মূলমন্ত্রটা লুকিয়ে আছে ছবিগুলোর অসাধারণ মানবীয় গল্পে, ছবি দেখতে দেখতে একসময় নিজেকে মনে হবে চরিত্রগুলোরই একজন! ছবিগুলো দেখার আসল মজাটা এখানেই। যেমন ধরা যাক মুলানের কথা। চীনের ছোট্ট একটা গ্রামের কিশোরী মেয়ে মুলান, বাবাকে যুদ্ধ থেকে বাঁচানোর জন্য যে কিনা নিজে ছেলে সেজে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় বাবার বদলে যুদ্ধে যোগ দিতে। শেষে নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে চীনের সম্রাটের দেখা পায়, যিনি তাকে দেশের সেরা সৈনিকের সম্মান দেন! আবার বামবি ছবিটার কথাও বলা যায়। ছোট্ট হরিণছানা বামবি সারাক্ষণ মায়ের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত আর খেলত। একদিন বামবিকে বাঁচাতে গিয়ে তার মা মারা পড়ে শিকারিদের হাতে। ছোট্ট বামবিকে বুকে তুলে নেয় তার বাবা হরিণরাজা। বামবির মিষ্টি হাসি আর দুষ্টুমিতে গম্ভীর বাবাও হাসতে শেখে। ছবির শেষে বামবিকে দেখা যায় হরিণদের রাজা হিসেবে, ঠিক যেমনটি ছিল তার বাবা। বলা যায় ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওর হালের ছবি ফ্রোজেন-এর কথা। সারাক্ষণ একই সঙ্গে থাকা দুই বোন অ্যানা আর এলসা ছোটবেলায় আলাদা হয়ে যায়। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার পর কি অ্যানা আর এলসার দেখা হবে? জানতে হলে দেখতে হবে ছবিটি! ওয়াল্ট ডিজনির ছবির আরেকটি মজার দিক হলো এর গান। নানা স্বাদের, অনন্যসাধারণ গানের জন্যও এই ছবিগুলো অনেক জনপ্রিয়, গানগুলোও জনপ্রিয়! সেই প্রথম ছবি স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ফস-এর ‘আই অ্যাম উইশিং’, সিনডারেলা ছবির ‘বিবিডি বাবিডি বু’ থেকে শুরু করে ফ্রোজেন ছবির ‘লেট ইট গো’; সব কটি গানই সমানভাবে প্রশংসা পাবে।

ডিজনি ওয়ার্ল্ড ঠাসা হরেক রকম বিনোদনে

ডিজনি স্টুডিওর সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বারব্যাঙ্কে, কাজ করেন ৮০০-র বেশি কর্মী। ‘মিকি মাউস’কে ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওর মাসকটই বলা যায়, কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানো তো? ওয়াল্ট ডিজনি কিন্তু নিজে ইঁদুরকে বড্ড ভয় পেতেন! ডিজনি অ্যানিমেশন নিয়ে দ্য ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানির আমেরিকা, প্যারিস, হংকং, সাংহাইসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আছে ১৪টি থিম পার্ক, যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় ডিজনির বিভিন্ন জনপ্রিয় আর মজার চরিত্র! ডিজনি কোম্পানির আরও আছে এবিসি, ইএসপিএনসহ কয়েকটি টেলিভিশন নেটওয়ার্ক, প্রকাশনা সংস্থা, পণ্যদ্রব্য। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সালভাদর দালির সঙ্গেও কাজ করেছিলেন ওয়াল্ট ডিজনি, ১৯৪৫ সালে ডেসটিনো নামের একটা শর্ট ফিল্মে। অ্যানিমেশন স্টুডিও হিসেবে ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওকে বলা যায় সবার গুরু। এই স্টুডিওর শুরুর দিকের ছবি বানানোর অনেক কৌশলকে অন্যরা আদর্শ হিসেবে ব্যবহার করত। প্রথম ছবি স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ফস-এ স্নো হোয়াইটের গালে অ্যানিমেটররা ব্যবহার করেছিলেন আসল মেকআপ, যাতে তাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করা যায়। এই বুদ্ধি আর কার মাথাতেই বা আসত! অ্যানিমেশন জগতে ওয়াল্ট ডিজনিকে তাই কিংবদন্তি বলা হয়। পিক্সার ও ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওর জনপ্রিয় ছবি ওয়াল-ই, কিন্তু অনেকেই হয়তো জানো না ‘ওয়াল-ই’ নামটি দেওয়া হয়েছে ওয়াল্টার এলিয়াস ডিজনির নাম থেকে!

(কিশোর আলোর জুন ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)