দ্য টেস্ট: অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের নতুন উপাখ্যান

ক্রিকেটের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী দল কোনটি? ক্রিকেট সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান রাখা ব্যক্তিটিও সবার আগে অস্ট্রেলিয়ার নাম বলবেন। টানা তিনবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, টেস্টে সবচেয়ে বেশি দিন ১ নম্বরে থাকার কৃতিত্বের সঙ্গে প্রতিপক্ষকে ছেলেখেলা করে হারানোর সামর্থ্য আর কোনো দলেরই নেই। কিন্তু সেই অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটেই ঘটল দুর্ভাগ্যজনক কেলেঙ্কারি। ২০১৮ সালে বল টেম্পারিং–কাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন অজি অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ, সহ–অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার এবং ওপেনিং ব্যাটসম্যান ক্যামেরন ব্যানক্রফট। ক্রিকেট–বিশ্ব তো বটেই, খোদ অস্ট্রেলিয়ার বোর্ডও মেনে নিতে পারেনি এ ঘটনা। অভিযুক্ত স্মিথ-ওয়ার্নারকে পেতে হয় সব ধরনের ক্রিকেট থেকে ১২ মাসের নিষেধাজ্ঞা, ক্যামেরন ব্যানক্রফটকে দেওয়া হয় ৯ মাসের নিষেধাজ্ঞা।

অস্ট্রেলিয়ার মতো অভিজাত ক্রিকেট দলের এই কাণ্ড মেনে নেওয়ার মতো নয়। তাই পদত্যাগ করেন দলের কোচ ড্যারেন লেম্যানও। চোখের পলকেই শক্তিধর অজি দল দিশেহারা হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে এতগুলো নেতৃস্থানীয় জায়গা ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠতে থাকে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। সমালোচকদের সঙ্গে ভক্তরাও যেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের সূর্যাস্ত দেখে ফেলেন।

ঠিক এই পটভূমি নিয়েই একটি ডকু-ওয়েব সিরিজ নির্মাণ করেছে আমাজন প্রাইম ভিডিও, যার নাম দ্য টেস্ট: আ নিউ এরা ফর অস্ট্রেলিয়া’স টিম। সাইক্লোনের তোপে পড়া নাবিকবিহীন ভাঙা জাহাজের মতো অস্ট্রেলিয়া দলের হাল ধরতে দলে ফিরিয়ে আনা হয় উইকেটকিপার টিম পেইনকে, যিনি নিজের সেরা সময়েও দলে নিয়মিত জায়গা পেতেন না। কোচ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি ওপেনিং ব্যাটসম্যান জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে। ওপেনার ওয়ার্নার-ব্যানক্রফট এবং ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যান স্টিভ স্মিথের জায়গা পূরণ করতে দলে আসে কয়েকটি নতুন মুখ। কিন্তু হুট করে প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়দের জায়গা নেওয়া কি এতই সহজ? টিম পেইনের অধিনায়কত্ব কি পারবে স্টিভ স্মিথের বুদ্ধিদীপ্ততাকে ছাপিয়ে যেতে? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে দেখতে হবে আট পর্বের এই ওয়েব সিরিজ।

ওয়েব সিরিজটির বিষয়বস্তু ক্রিকেট হলেও আদতে এটি যেকোনো দর্শকের জন্যই উপভোগ্য। কেননা পরিচালক সিরিজটি তৈরি করেছেন খুব সহজ গল্পের কোনো চলচ্চিত্রের মতো করে। চরিত্রেরা কেউ কাল্পনিক নয়, কাহিনি-দৃশ্যপটও মনগড়া নয়, তবু এর রোমাঞ্চকর আবহ নাড়া দেয় দর্শকদের। বিখ্যাত অ্যাশেজ সিরিজে ভেঙে পড়া অস্ট্রেলিয়া দলের মাথা তুলে দাঁড়ানোর লড়াই চলচ্চিত্রের চেয়ে কোনো অংশেই কম নাটকীয় নয়।

সিরিজটি তৈরির জন্য একদল মানুষ সর্বক্ষণ থেকেছেন অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে। ক্রিকেট মাঠ তো বটেই, ড্রেসিংরুম, প্র্যাকটিস সেশন, এমনকি দল নির্বাচনের মতো গোপনীয় বৈঠকেও ক্যামেরা নিয়ে সঙ্গে ছিলেন তাঁরা। ফলে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের নানা অজানা তথ্য, ঐতিহ্য সহজেই উঠে এসেছে দর্শকদের কাছে। জানা যায়, অধিনায়ক-কোচদের রণকৌশলের নমুনা সম্পর্কেও।

বলা হয়, ক্রিকেট অধিনায়কের খেলা। কিন্তু মাঠের বাইরে কোচের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কৌশলের খসড়া বের হয় তাঁর মাথা থেকেই। তাই কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গার অস্ট্রেলিয়ার জন্য পর্দার আড়ালের নায়ক। প্রায় ঝরে পড়া টিম পেইনকে নিয়ে, মূল ব্যাটসম্যানদের অনুপস্থিতিতে যেভাবে তিনি দলকে নিয়ে অ্যাশেজ-বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চ সামলেছেন, তা প্রশংসনীয়। ক্রিকেট মাঠে আমরা পরিকল্পনার প্রতিফলনটুকু দেখিমাত্র। কিন্তু এর পেছনের গল্প দর্শককে অবাক করে। আর যখন সেই পরিকল্পনা কাজে দেয়, সফলতা আনে, তখন যেন পাজল মেলানোর মতো তৃপ্তি আসে।

অস্ট্রেলিয়া দলের মাথা তুলে দাঁড়ানোর লড়াই চলচ্চিত্রের চেয়ে কোনো অংশেই কম নাটকীয় নয়

টিম পেইন বর্তমান ক্রিকেটে কম আলোচিত অধিনায়কদের মধ্যে একজন। অন্তত অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপ্টেনরা যেভাবে প্রায়ই খবরের শিরোনামে থাকেন, টিম পেইনকে সেভাবে পাওয়া যায় কম। ক্রিকেটে নিজের ভবিষ্যৎ শেষ ভেবে অবসরের সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। মাঠ থেকে অবসর নিয়ে কোকাবুরা কোম্পানিতে কাজ করবেন এবং বিগ ব্যাশে খেলবেন—এটাই ছিল তাঁর প্রাথমিক পরিকল্পনা। কিন্তু ভাগ্যের মোড় কখনো অনুমান করা যায়? ওই সময়ই টিম পেইনকে অধিনায়ক করে দলে ফিরিয়ে আনল অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড। ক্যারিয়ারের অন্তিম সময়ে পৌঁছে যাওয়া বুড়ো পেইন আর কতটুকুই–বা দিতে পারবেন অজিদের? প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে সব প্রশ্নের জবাব দিলেন তিনি। প্রায় আনকোরা, অগোছালো দলকে বাঁধলেন এক সুতায়। এরপর যেন ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি-জিতি নাহি লাজ’ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে খেলতে লাগলেন। কখনো জেতেন, কখনো হারেন। কিন্তু সবকিছুই করেন দলবদ্ধ হয়ে।

রীতিমতো অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে থাকা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দলের সঙ্গে তৈরি করা এই ডকুমেন্টারি সিরিজ থ্রিলারের মতোই উত্তেজনাপূর্ণ। কেননা সিনেমার মতো ফ্রেমে সত্যিকারের ক্রিকেটকে নাটকীয় আবহ সংগীতের সঙ্গে দেখতে থাকলে বিখ্যাত পরিচালকের থ্রিলার সিনেমাই মনে হয়। তাতে ক্রিকেট না জানা ব্যক্তিটিকেও চুম্বকের মতো আটকে থাকতে হয় কেবল পরের পর্বে কী হলো, তা জানার জন্য।

লজ্জাজনক সময় থেকে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের পুনরুত্থান ক্রিকেট নিয়ে তৈরি হওয়া এযাবৎকালের সবচেয়ে ভালো সিরিজ বললে ভুল হয় না। গল্প বলার ধরন থেকে আবহ সংগীত—সবকিছুই মোহের মতো পর্দায় আটকে রাখে। তাই সময় পেলে দেখে ফেলতে পারো আমাজন প্রাইম ভিডিওতে মুক্তি পাওয়া ওয়েব সিরিজটি। ক্রিকেট–ভক্ত না হলেও সুন্দর সময় কাটবে, আর ক্রিকেট–ভক্ত হলে তো কথাই নেই!