নাগরিক এক ম্যাজিশিয়ানের জন্মদিনে

১৯৯৪ সাল আমার জন্য শুনতে চাওয়ার দিন, পাওয়ারও। কৈশোরকাল পার হয়ে গেছি তত দিনে। এইচএসসি হয় হয়। নিজেকে তো বটেই ঢাকা শহরকেও নতুন করে আবিষ্কার করছি। ক্লাস নাইনে আব্বা একটা হিরো সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন, তাতে চড়ে কোথায় কোথায় চলে যাই। উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরে বেড়ানোর মজা তুলনাহীন।

এমন এক আনন্দযজ্ঞ যখন আমার, তখন একদিন সাদা প্রচ্ছদে কেমন এক উদাসীন চেহারার, দেখে মনে হয় চোখে-মুখে এখনো ঘুম লেগে আছে এক গায়কের ক্যাসেট হাতে পেলাম। শুনতে কি চাও?—গায়কের নাম অঞ্জন দত্ত। তত দিনে আমি সুমন শুনছি, বলা ভালো বুঁদ হয়ে আছি। বাংলাদেশি ব্যান্ডের গানে তো মজে ছিলাম অনেক দিন, সুমনের গান নিশ্চিত করেই একটা পালাবদলের দোলা দিয়ে গেল মনে। সেই পালে এক মিষ্টি ঝড় তুলে দিল অঞ্জনের গান। 

১০ বছর বয়সের সেই ছোট্ট ‘আলিবাবা’, সারা দিন কাজ করেও যার নিস্তার নেই; রাতের বেলায় চাচার পিঠ মালিশ করে দিতে হয়...পাড়ায় ঢুকলেই মার খাওয়ার ভয়, তবু রঞ্জনার সেই আলাভোলা কিশোর প্রেমিক...বাপি আর মা ছুটির দিনে সিনেমা দেখতে গিয়েছে, ছোট্ট শিশুটি বাসায় একা একা, তাকে টিভি দেখতে না বলা, সেই সূত্রধর যে চোখের সামনে মেলে ধরছে আকাশ, তারা আর মেঘে ভেসে বেড়ানো অলীক ভাল্লুক...অফিসের সাদামাটা কেরানী হরিপদর একহারা বর্ণনা অথবা সব ছাপিয়ে বেলা বোসকে ফোন করে জানানো সুখবর, ‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছ, এটা কি ২৪৪১১৩৯’!

আহা, কী সব অকৈতব দিন। সঙ্গে অঞ্জনের গান। আজ কিশোর আলোর পাঠকদের জন্য লিখতে বসে ভাবছি কী ছিল সেই গানে, কেন এত মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলাম!

দৃশ্যকল্পগল্পলিরিকের বিষয়বৈচিত্র্য

অঞ্জন নিজেকে নির্মাতা আর অভিনেতা পরিচয়ে অগ্রাধিকার দিলেও শ্রোতাদের কাছে তিনি মূলত গায়ক আর গীতিকার। ষাটের দশকে আমেরিকাতে বব ডিলান, পিট সিগার, কিছু পরে সাইমন-গারফাঙ্কেল, ডন ম্যাকলিনসহ অনেক প্রতিভাবান তরুণ গান লিখে, সুর করে নিজেরাই গেয়ে যেই ধারা শুরু করেছিলেন, কলকাতাতে নব্বইয়ের দশকে প্রথমে সুমন, তার পরপরই অঞ্জন আর নচিকেতার মাধ্যমেই সেই একই ধারা সমকালীন গানের দৃশ্যপট আমূল পাল্টে দিল। সে এক বিশাল ধাক্কা! নিয়মের বাইরে যেতে অনিচ্ছুক সংগীতজ্ঞ বা সমালোচকদের জন্য এড়ানো সত্যি মুশকিল ছিল। বাংলা গানে ভালোবাসার বাণী চিরন্তন। কিন্তু ভালোবাসার বাইরেও যে অজস্র বিষয় আমাদের চারপাশেই ছড়িয়ে আছে—এমন করে এক অ্যালবামে আর কেই–বা তুলে এনেছিল বা তোলার সাহস দেখিয়েছিল?

অঞ্জনের গান তাই নাগরিক গানের অন্যতম পথিকৃৎ। অঞ্জন দত্ত বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে কিন্তু বারবারই তাঁর গানের প্রেরণা হিসেবে কবির সুমনের নাম করেছেন, কথা বলেছেন, পাশে হেঁটেছেন।

গানে এবং বিনয়ে অঞ্জন সুন্দর। রাখঢাক ছাড়া কথাতেও বটে!

ওই সময়েই আমি অল্পস্বল্প লিখতে শুরু করেছি। ক্রীড়াজগতের পাঠকের পাতা, নিজস্ব ডায়েরি, অনেক শোনা গান আর ছন্দ খুঁজে মাথা ঠোকা আমার সম্বল।  সুমন, অঞ্জনের গান আমার লেখালেখির জন্য একটা নতুন জানালার সন্ধান দিল। অনেক পরে এসে আমি যখন গীতিকার হব ভেবে ছকে বাঁধার ঠিক অপর প্রান্তে জীবনকে এনে দাঁড় করিয়েছিলাম, তখন এবং তার অনেক পরেও অঞ্জনের গান আমাকে সাহস জুগিয়েছিল। নাগরিক গানের নতুন একটা পথ দেখিয়েছিল।

যে পথে হাঁটলে বিমূর্ত ও মূর্ত—দুই প্রান্তের শব্দ খোঁজাই নতুন আবিষ্কারের আনন্দ এনে দেয়।

অঞ্জনের দ্বিতীয় অ্যালবাম এল ’৯৫–তে। নাম পুরোনো গিটার। অঞ্জনের গান বড় হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে আমিও। পুরোনো গিটার–এ সংগীত আয়োজনে একটু পরিবর্তন নিয়ে এলেন অঞ্জন। তা–ও কী অদ্ভুত বিষাদমাখা! আহা! বব ডিলান আর জন লেননের কথা উঠে এল স্যাক্সোফোন আর গিটারে মিলেমিশে একাকার হয়ে...

‘জন লেননের সোচ্চার ভালোবাসা

বব ডিলানের অভিমান

হুট করে ভালো লেগে ভালোবেসে কাউকে

তাড়াহুড়ো করে লেখা গান’ 

কিন্তু দুটি মানুষের ভালোবাসা আর সংসারের দ্বন্দ্বমুখরতা, গল্পের পাতা থেকে উঠে আসা স্যামসন, কিংবা ক্যালসিয়াম গানের সেই অভিভাবকদের বেঁধে দেওয়া নানা শাসনের বেড়াজালে বন্দী হওয়া ভ্যাবাচেকা খাওয়া শিশুকে ছাপিয়ে আমার কানে ধরা দিল— 

‘আমি বৃষ্টি দেখেছি,

বৃষ্টির ছবি এঁকেছি 

আমি রোদের পুড়ে 

ঘুরে ঘুরে 

অনেক কেঁদেছি।’

তরতাজা সময়গুলো বুঝি হারিয়ে যাওয়ার জন্যই আসে!

অঞ্জন দত্তের গান কি কোনো নির্দিষ্ট জনরায় ফেলা যায়?

অঞ্জনের কথা, সুর আর গায়কি মূলত বাংলা ফোক আর ব্লুজের মধ্যে ঘোরাফেরা করে প্রবলভাবে। শব্দ আর বিষয়ের বৈচিত্র্যে তা বিবিধ হয়ে ওঠে আমাদের কানে। অঞ্জনের গানে পশ্চিমা ফোকের প্রভাব অনস্বীকার্য। আমরা যখন ক্যাসেট কিনে গান শুনতাম (বেশি দিন আগের কথা কিন্তু নয়, অথচ এখনই কেমন রূপকথার গল্পের মতো শোনায়) তখন তো কলকাতা থেকে সচরাচর আসল ক্যাসেট হাতে পেতাম না, যা পেতাম তা হলো পাইরেটেড কপি। –সেই ক্যাসেটের গায়ে শুধু গানের নাম আর গায়কের নাম লেখা থাকত। অনেক পরে পিটার সারস্টেড–এর ‘হোয়ার ডু ইউ গো টু মাই লাভলি’ শুনে চমকে উঠেছিলাম! আরে, এ তো অঞ্জনের ‘মালা’! পিটারের গানটার কথা আর সুরের অনুবাদ অঞ্জনের ‘মালা’। অনন্যসাধারণ অনুবাদ। শব্দে আর ছন্দের গাঁথুনিতে যেন একটা নাটক দেখি গান শুনতে শুনতে। নাকি সিনেমা?

অথবা ভালোবাসি তোমায় অ্যালবামের ‘ঘর’। এই গানটা আমার খুব প্রিয় সিঙ্গার-সংরাইটার জুটি সাইমন-গারফাঙ্কেলের ‘হোমওয়ার্ড বাউন্ড’–এর বাংলা সংস্করণ।

১৯৯৯ সালে অঞ্জনের ষষ্ঠ সলো অ্যালবাম হাতে পাই। হ্যালো বাংলাদেশ নামে। ‘মনে আছে কি সেই টেলিফোনের গান’—অঞ্জন আমাদের মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস পান বেলা বোসের কথা। তত দিনে আমার জীবনও একটা বিস্তর ওলট-পালট হয়ে গেছে। গীতিকার হওয়ার প্রবল স্বপ্নে আমি রীতিমতো ঘোরগ্রস্ত। আরও নিবিড়ভাবে গানের লিরিকে মন দিয়েছি। হ্যালো বাংলাদেশও মন জয় করে নিতে সময় নেয় না। এই অ্যালবামেই আমাদের কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ প্রয়াত লাকী আখান্দকে নিয়ে গান রচনা করেন অঞ্জন। কিন্তু তার পরপরেই অঞ্জন গানে একটু বিরতি নেন। প্রায় অর্ধযুগ পর অঞ্জনের অ্যালবাম আসে ঊনষাট। ঠিক ৫৯ বছর বয়সেই।

এর মাঝে কিআর পাঠকদের জন্য আলাদা করে কয়েকটা অ্যালবামের কথা না বললে লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কবির সুমনের সঙ্গে জুটি বেঁধে অনেক দিন পর আর গানে গানে ভালোবাসা। গান আর অর্ণব, জয়িতার কথোপকথন। মনে আছে, আমি একসময় ঘুমাতে যাওয়ার আগে ক্যাসেট প্লেয়ারে এই অ্যালবাম চালিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতাম। মাথার ভেতর ঢুকে গিয়েছিল অর্ণব চরিত্রটা।

রং পেনসিল। একদম কিশোর-কিশোরীদের জন্য অ্যালবাম। রঙিন এক এক গান। আর একটা গান ছিল খুব মজার। সুমনের সংগীতায়োজনে ছোট-বড় মিলে। অঞ্জন-নচিকেতা-সুমন মিলে একটা গান গেয়েছিলেন সেই অ্যালবামে। ‘হজমি খেলে হজম হবে/ এই ভেবে কেউ হজমি খায়/ খেতে  ভীষণ ভাল্লাগে তাই/ পেটুক খালি হজমি চায়...’, ্ এটা না শুনলে মিস করবে।

১৯৫৩ সালের ১৯ জানুয়ারিতে জন্ম। কলকাতায়। কিন্তু বোর্ডিং স্কুলের সুবাদে বেড়ে ওঠা দার্জিলিংয়ের মনোহর প্রাকৃতিক রূপের মণিকাঞ্চনে। এ কারণেই বুঝি অঞ্জনের গানে কলকাতার নাগরিক দৃশ্যপটের সঙ্গে সঙ্গে বারবার উঠে আসে দার্জিলিংয়ের কথা। কাঞ্চনজঙ্ঘার কথা। কেউ গান গায় অ্যালবামের সেই পাহাড়ি বিষাদ সুর—

‘একটু ভালো করে বাঁচব বলে

আর একটু বেশি রোজগার

ছাড়লাম ঘর আমি ছাড়লাম ভালোবাসা

আমার নীলচে পাহাড়

পারল না তোমাদের ওই কোলকাতা

আমাকে ভুলিয়ে দিতে

পাহাড়ি রাস্তার ধারের বস্তির

আমার কাঞ্চনকে...’

রমা। মেরি অ্যান। স্যামসন। রঞ্জনা। বেলা বোস। আলিবাবা—একেকটা চরিত্র, একেকটা গল্প। সব গল্পের ভেতর অঞ্জন দত্ত আছেন। অন্য ধারার গানের এক অপরূপ বোহেমিয়ান চরিত্র হয়ে। কালো চশমায় ঢাকা এক অসাধারণ সংরাইটার-সিঙ্গারের অবয়বে।

এই খুব মূর্ত নাগরিক গান আমাকে বিহ্বল করে নিয়ে যায় বিমূর্তের কাছে। অঞ্জনকে তাই আমার মাঝেমধ্যেই কাফকার মতো মনে হয়। অঞ্জনের গান আমাদের অনেক কিছুই বলে, নাকি আসলে কিছুই বলে না! অঞ্জন খুব দৃশ্যমান, নাকি অদৃশ্য এক ম্যাজিশিয়ান? কথা-সুরের ম্যাজিকে আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন দশকের পর দশক? আমাদের সবার নিজস্ব কৈশোরকাল সময়কে থামিয়ে স্থির হয়ে আছে অঞ্জনের গীতিকবিতায়, সুরে আর গিটারে!

শুভ জন্মদিন, প্রিয় অঞ্জন দত্ত। বাংলাদেশের এক নাগরিক গীতিকারের কুর্নিশ আর ভালোবাসা আপনার জন্য। সব সময়।