রূপকথার রুপালি পর্দা

মনে করো তুমি এক মহা ফাঁকিবাজ রাজপুত্তুর, পড়াশোনা তোমার ভালো লাগে না (এই লাইন পড়েই নিশ্চয় মিটিমিটি হাসি দিয়ে তুমি বলছ, এটা মনে করার কী আছে, আমি তো ফাঁকিবাজই)! সারাক্ষণ লাফিয়ে, নেচে, বাঁদরামি আর দুষ্টুমি করে সময় কাটাতেই তোমার ভালো লাগে। কিন্তু হঠাৎ একদিন তোমার সব বাঁদরামি-দুষ্টুমিকে কপাৎ করে ধরে নিয়ে দূর পাহাড়ের কোনো এক গোপন গুহাতে বন্দী করে ফেলল পড়ালেখা নামের দুষ্টু দৈত্য। এরপর থেকে তোমার জীবন ছারখার। নিজের দুষ্টুমি হারিয়ে বই–খাতাতে মুখ গুঁজে তুমি ত্যক্ত-বিরক্ত। এভাবে আর কত দিন সহ্য করা যায়? একদিন তাই তলোয়ার হাতে ঘোড়া হাঁকিয়ে তুমি হানা দিলে দূর পাহাড়ের পড়ালেখা দৈত্যের গুহায়। দৈত্যের কাছ থেকে যে করেই হোক নিজের বাঁদরামি-দুষ্টুমিকে উদ্ধার করা চাই-ই চাই। ঠিক যেমনটা রূপকথার গল্পে পাওয়া যায়, তেমনভাবেই!

রূপকথার এ রকম অভিযানের অসংখ্য গল্প নিশ্চয় তুমি আগেভাগেই শুনেছ। মিটিমিটি সন্ধ্যায় বুড়ো দাদুর পাশে বসে ঠাকুরমার ঝুলির গল্প হোক, হ্যান্স অ্যান্ডারসন কিংবা গ্রিম ব্রাদার্সের বই পড়ে হোক আর আরব্য রজনীর গল্প শুনে হোক, রূপকথার গল্প সম্পর্কে বেশ ভালো একটা আকর্ষণ নিশ্চয় তোমার আছে। বহুকাল ধরে লোকের মুখে চলমান রূপকথার গল্পগুলো বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসে গত ষাট-সত্তর বছরে আরও বেশি ঝলমলে হয়ে ধরা দিয়েছে রুপালি পর্দায়। ওয়াল্ট ডিজনি, ওয়ার্নার ব্রাদার্স, স্টুডিও জিবলি কিংবা ড্রিমওয়ার্কসের হাত ধরে হোক, রূপকথার স্বপ্নালু জগৎটা ঝাঁ–চকচকে হয়ে সিনেমাপাড়া দাপাচ্ছে বহুকাল ধরেই। আপাতদৃষ্টে সিনেমার হালহকিকত ঘাঁটতে গেলে দেখা যায়, রূপকথার গল্প ছাড়া পুরো সিনেমাজগৎ অনেকটাই অপূর্ণ।

রুপালি পর্দা কাঁপানো কিছু রূপকথার সিনেমার গল্পই আজ শোনাব তোমাদের। তা কার গল্প দিয়ে শুরু করা যায়? সিনড্রেলা? নাহ্‌, তার গল্প শুনতে শুনতে কান পচে গেছে। তাহলে স্নো হোয়াইট? বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট? লিটল মারমেইড? স্লিপিং বিউটি? নেভারল্যান্ডের পিটার প্যান?

উঁহু! সবার গল্পই জানা তোমার? তাহলেএএএএএএ?

তাহলে চলো জোয়ির গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। জোয়ি তোমাদের বয়সী ছোট্ট একটা মেয়ে। থাকে এমন এক অদ্ভুত দুনিয়ায়, যেখানকার প্রতিটি জায়গা দ্বীপের মতো বিভক্ত এবং মেঘের মতো ভাসমান। ডাকাত, কৃষক আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লোকের এই দুনিয়ার মানুষদের জীবন কাটে ক্ষুধার্ত আর ভয়ংকর ড্রাগনদের হাত থেকে জীবিত থাকার ব্যস্ততাতেই। অদ্ভুত এই জগতেই ড্রাগন শিকারের কাজ করে লিয়ান-চু এবং গুইডো। যদিও তারা নামেই ড্রাগনশিকারি, আদতে তাদের একান্ত ব্যক্তিগত স্বপ্ন হলো, দূরের কোনো ভাসমান দ্বীপে ভেড়া পালন করে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন পার করা। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্নের খড়ে আগুন ধরে ছোট্ট মেয়ে জোয়ির সঙ্গে সাক্ষাতে। জোয়ির কারণেই তাদের জড়িয়ে পড়তে হয় দুনিয়াখাদক এক ড্রাগন শিকারের অভিযানে, যে কিনা বিশ বছর পরপর এসে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় লোকালয়ে। এ এক অদ্ভুত অভিযানের সিনেমা, যা দেখতে দেখতে কখনো কখনো শিউরে উঠবে তুমি, কখনো গুইডোর পোষা পিচ্চি ড্রাগন হেকটরের কাণ্ডকারখানায় হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেতে বাধ্য।

জোয়ি, গুইডো, লিয়ান-চু আর হেকটরের এই অভিযানের গল্প নিয়ে টেলিভিশন সিরিজ বানিয়েছিলেন ফরাসি অ্যানিমেটর ও কমিকবুক রাইটার আর্থার কোয়াক; যা মুক্তি পায় ২০০৬ সালে। দুই বছর পর গুইলিউম ইভার্নেল ও আর্থার কোয়াকের যৌথ পরিচালনায় ড্রাগন হান্টারস নামে সিনেমা মুক্তি পায়। রূপকথার অদ্ভুত মজার এক জগৎ দেখতে চাইলে দ্রুত দেখে ফেলতে পারো সিনেমাটি।

ওজের জাদুকরের সেই গল্প জানা আছে তোমাদের? আমেরিকান লেখক লেম্যান ফ্র্যাঙ্ক বোম লিখলেন এই ওজের জাদুকরের গল্প, আজ থেকে প্রায় ১২০ বছর আগে। এরপর তো নানা দেশে নানাভাবে কত কতই না সিনেমা বানানো হয়েছে এই ওজকে নিয়ে! ওজের এই গল্পের মূল চরিত্র ছোট্ট মেয়ে ডরোথি, কুকুর টোটো, চাচি অ্যান আর চাচা হেনরির সঙ্গে থাকত আমেরিকার কানসাসে। একদিনের প্রচণ্ড এক ঝড় ডরোথি আর টোটোকে উড়িয়ে নিয়ে গেল অদ্ভুত এক দেশে, যেখানে থাকে মানচকিনরা। এই দেশের কিছুই চেনে না ছোট্ট ডরোথি, আবার সে দেশের কেউ বলতে পারে না ছোট্ট ডরোথির কানসাসের বাড়ি ফেরার পথের ঠিকানা। তাহলে কি ছোট্ট ডরোথি অজানা–অচেনা অদ্ভুত এই রাজ্যে চিরতরে হারিয়ে যাবে? কোনো উপায় কি নেই তার বাড়ি ফেরার? মানচকিনরা জানায়, একটা উপায় আছে, তার চেয়ে বলা ভালো এই একটা উপায়ই আছে, শুধু পান্নানগরের জাদুকর ওজই পারে ডরোথিকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। আর কোনো উপায় না পেয়ে ছোট্ট ডরোথি এদেশ–ওদেশ হয়ে পাড়ি জমায় ওজের জাদুকরের দেশের দিকে। যেতে যেতে কত কত দুর্দান্ত সব অভিযানেই না সে জড়িয়ে পড়ে। ডরোথির সেসব দারুণ মজার অভিযান সম্পর্কে জানতে হলে তোমাকে দেখে নিতে হবে ১৯৩৯ সালে মুক্তি পাওয়া দ্য উইজার্ড অব ওজ সিনেমাটি। এ ছাড়া ২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া ওজ দ্য গ্রেট অ্যান্ড পাওয়ারফুল সিনেমাটিও দেখে নিতে পারো।

অথই সাগরের অতলে বাস করে এরিয়েল। সাগরের স্বচ্ছ নীলাভ পানিতে ঢেউয়ের তালে তালে নেচে–গেয়ে আর সমুদ্রের শঙ্খ তুলে মনমাতানো সুরে বাজিয়েই সময় কাটত এরিয়েলের। তার নাচের তালে মুগ্ধ হয়ে মাছগুলোও তাল মেলাত তার সঙ্গে। একদিন এক জাহাজডুবিতে মাটির দেশের এক রাজকুমার অথই জলে হাবুডুবু খেয়ে ডুবতে বসে। এরিয়েল উদ্ধার করে জীবন বাঁচায় সেই রাজকুমারের। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গেছ যে দ্য লিটল মারমেইডের গল্প শোনাচ্ছিলাম। মৎস্যকন্যা এই এরিয়েলের গল্প তোমাদের তো জানাই আছে। কিন্তু পনিওর গল্পটা কি জানা আছে তোমাদের? পনিওর গল্পটা এই এরিয়েলের গল্পেরই স্টুডিও জিবলি ভার্সন। অ্যানিমেশন ভক্তদের কাছে স্টুডিও জিবলি নামটি বেশ আরাধ্যের। স্টুডিও জিবলির প্রতিষ্ঠাতা হায়াও মিয়াজাকি সম্ভবত ওয়াল্ট ডিজনির পর অ্যানিমেশনজগতের সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ। তার বানানো সিনেমার অদ্ভুত সুন্দর গল্প আর রঙের বিন্যাস অ্যানিমেশন–ভক্তদের বছরের পর বছর ধরে মুগ্ধ করে আসছে।

এই হায়াও মিয়াজাকিই হ্যান্স অ্যান্ডারসনের বিশ্ববিখ্যাত রূপকথার গল্প ‘দ্য লিটিল মারমেইড’–এর ছায়া অবলম্বনে ২০০৮ সালে বানান পনিও নামের অ্যানিমেশন সিনেমাটি। আদতে লিটল মারমেইড থেকে গল্প ধার করা হলেও পনিওর গল্পেও আছে কিছু নিজস্বতা। ছোট মৎস্যকন্যার গল্প যাদের ভালো লেগেছে, পনিওর গল্পটাও তাদের ভালো লাগবে। পনিও ছাড়াও স্টুডিও জিবলির মাই নেবার ততোরো (১৯৮৮) এবং স্পিরিটেড অ্যাওয়ে (২০০১) দেখে নিতে পারো।

এর বাইরেও যেসব রূপকথার সিনেমা তোমাদের মুগ্ধতায় ভাসানোর জন্য ঝুলি পেতে বসে আছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডর্ফস (১৯৩৭), পিনোকিও (১৯৪০), সিনড্রেলা (১৯৫০), স্লিপিং বিউটি (১৯৫৯), বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট (১৯৯১), থাম্বলিনা (১৯৯৪), দ্য প্রিন্সেস অ্যান্ড দ্য ফ্রগ (২০০৯), ট্যাঙ্গলড (২০১০), ফ্রোজেন (২০১৩)।

এ ছাড়া এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড, শ্রেক, পিটার প্যান, টিঙ্কার বেল, ম্যালিফিসেন্ট, জ্যাক দ্য জায়ান্ট স্লেয়ার, হ্যান্সেল অ্যান্ড গ্রেটেল, প্রিন্স অব ইজিপ্ট, দ্য প্রিন্সেস ব্রাইড, দ্য সোয়ান প্রিন্সেস সিনেমাগুলোও দেখে নিতে পারো।

বছরের পর বছর ধরে সবাইকে মুগ্ধ করে আসা রূপকথার গল্পগুলো শুনতে যেমন ভালো লাগে, তেমনি রুপালি পর্দায়ও সেগুলো অন্য রকম আবহ তৈরি করে। তাই ঝটপট দেখে নিতে পারো রূপকথার এসব সিনেমা।