সাইকেলের সিনেমা

সাইকেল! শব্দটা শুনলেই তোমার নিশ্চয় চুলে হাওয়া লাগিয়ে ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে শাঁ শাঁ করে ছুটে যেতে ইচ্ছা হয় পথঘাটে ধুলা উড়িয়ে।

মা-বাবা-মামার কাছ থেকে ‘এবার পরীক্ষায় প্রথম হলে সাইকেল কিনে দেব’, কথাটা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়া বন্ধুবান্ধবের অভাব নিশ্চয় তোমার নেই। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবিষ্কার হওয়া এই দ্বিচক্রযান নিয়ে দেশে দেশে গল্প-কল্প-জল্পনার অভাব নেই। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে ফরাসি, জার্মান, স্কটিশ, ইংরেজ থেকে শুরু করে আমেরিকান—সবাই দাবি করে যে সাইকেলের প্রথম আবিষ্কারক তারাই। ব্যাপারটা বেশ মজার, তাই না? মজাদার এই সাইকেল নিয়ে নাটক-সিনেমাও হয়েছে অনেক। সাইকেল নিয়ে বানানো সেসব সিনেমার খবর জানাতেই এ লেখা।

প্রথমেই চলো ঘুরে আসা যাক সৌদি আরবের রিয়াদ শহর থেকে, সময়টা ২০০০ সাল। ১০ বছর বয়সী ওয়াজদা মায়ের সঙ্গে এখানেই বাস করে। ওয়াজদা স্কুলে যাওয়ার পথে এক দোকানে রোজই একটা সবুজ সাইকেল দেখে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে স্বপ্নালু চোখে, তার অনেক ইচ্ছা যে সে এই সাইকেলের মালিক হবে। এরপর সাইকেল চালানো শিখে রেস লাগাবে তার পড়শি বন্ধু আবদুল্লাহর সঙ্গে। কিন্তু রিয়াদের মতো রক্ষণশীল শহরে মেয়েদের সাইকেল চালানোটা খুবই বাঁকা চোখে দেখা হয় বলে ওয়াজদার মা সাইকেল কিনে দিতে সাফ মানা করে দেন। আর সাইকেলের যা দাম, সেটা ওয়াজদার মতো ছোট্ট মেয়ের পক্ষে কেনা সম্ভব নয়।

মা মানা করে দিয়েছে, নিজের কাছেও সাইকেল কেনার টাকা নেই, এ জন্য তো আর ওয়াজদার সাইকেল চালানোর স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যেতে পারে না। সাইকেল কেনার টাকা জোগাড়ের জন্য তাই ওয়াজদা নিজেই ব্রেসলেট বানিয়ে স্কুলে বিক্রি শুরু করে, এর পাশাপাশি ক্যাসেট প্লেয়ারের ক্যাসেট বিক্রি করেও তার হাতে অর্থ আসতে শুরু করে।

এভাবে বেশ ভালোই চলছিল, কিন্তু সাইকেল কেনার জন্য তার চুপিচুপি ফাঁদা এই ব্যবসার ব্যাপারটা ধরা পড়ে যায় স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার কাছে। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে ওয়াজদার ব্যবসায় পড়ে যায় কারফিউ।

বেচারি ছোট্ট ওয়াজদা তখন পড়ে যায় বিপাকে। তার সাইকেল কেনার স্বপ্ন কি তাহলে আর কখনো পূরণ হবে না! আবদুল্লাহকে রেসে হারানোটাও কি আর হয়ে উঠবে না!

তবে এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয় ১০ বছর বয়সী ওয়াজদা, সেসব সমস্যার সঙ্গে সংগ্রাম করে একদিন ঠিকই সে তার সাধের সাইকেলের কাছে পৌঁছে যায়। কীভাবে ছোট্ট ওয়াজদা এ অসাধ্য সাধন করে, সেটা জানতে হলে তোমাদের দেখে নিতে হবে ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হাইফা আল মনসুর পরিচালিত সিনেমা ওয়াজদা

টিনটিনের নাম নিতে গেলে যেমন স্নোয়িকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তেমনি সাইকেল নিয়ে সিনেমার কথা উঠলে দ্য বাইসাইকেল থিফ সিনেমার কথা ভুলে যাওয়া ঘোরতর অপরাধ হয়ে দাঁড়াবে।

লুইজি বার্তোলিনির উপন্যাস দ্য বাইসাইকেল থিফ–এর ওপর ভিত্তি করে ভিত্তোরিও ডি সিকারের পরিচালনায় ১৯৪৮ সালে মুক্তি পায় এই কালজয়ী সিনেমা। সিনেমাশিল্পের ইতিহাসে এই সিনেমা বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা একটি সিনেমা।

এই সিনেমার গল্প সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী ইতালির। বিশ্বযুদ্ধে হেরে গিয়ে ইতালির অবস্থা তখন তোমার পড়ালেখার দুর্বলতার থেকেও দুর্বল! সে সময় ইতালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থা তোমার হোমওয়ার্কের নম্বরের থেকেও করুণ। চারদিকে হাহাকার আর বেকারত্ব। কাজের সন্ধানে মানুষের সে কি আহাজারি!

অ্যান্টোনিও রিকি নামের এক লোকও আর সবার মতো একটা চাকরির সন্ধানে দিশেহারা। বউ আর দুই বাচ্চা নিয়ে তার সংসার। ভাগ্যগুণে অ্যান্টোনিও বিভিন্ন জায়গায় পোস্টার লাগানোর একটা চাকরি পেয়ে যান। কিন্তু সেখানেও থাকে শর্ত। চাকরিটা করার জন্য অ্যান্টোনিওর নিজস্ব সাইকেল থাকা লাগবে।

ঘরে ঠিকমতো খাবার জোগাড়েরই পয়সা নেই আর সাইকেল আসবে কোথা থেকে? অ্যান্টোনিও পড়লেন মহাসমস্যায়। সমস্যার সমাধান হলো বিয়েতে পাওয়া দামি চাদরগুলো বিক্রি করে। সেই টাকায় সাইকেল কেনার পর ৬-৭ বছর বয়সী বড় ছেলে ব্রুনোর সে কি আনন্দ! কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা কাটে না তবু! কাজে নামার প্রথম দিনেই চুরি যায় এত কষ্টে কেনা সাইকেলটা!

ব্রুনোদের জীবনে একপশলা রোদ ছুড়ে ফেলেই যেন ভাগ্যবিধাতার শীতল চোখের দিকে তাকিয়ে ডুবে যায় একটু ভালো থাকার শেষ সূর্যটাও।

সাইকেল চুরি যাওয়ায় অ্যান্টোনিও পড়েন মহাবিপদে। সাইকেল ছাড়া অনেক কষ্টে জোগাড় হওয়া একমাত্র চাকরিটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে যে! তখন বউ–বাচ্চাকে নিয়ে তো তার পথে বসতে হবে!

তাই বাপ-ছেলে মিলে নেমে পড়ে চুরি যাওয়া সাইকেল উদ্ধারের ক্ষীণ আশাকে মনে রেখে।

রোমের প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি গলিতে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে ওঠে বাবা-ছেলে। কিন্তু চুরি যাওয়া সাইকেল কি আর সহজে মেলে?

সাইকেলের ডানায় ভর করে আবেগের মিশেলে বোনা এক অনবদ্য অনুভূতি এই সিনেমা, দেরি না করে চটপট দেখে নিতে পারো।

এই দুই সিনেমার পাশাপাশি আরও দেখে নিতে পারো বেইজিং বাইসাইকেল (২০০১), প্রিমিয়াম রাস (২০১২), পি-উয়িস বিগ অ্যাডভেঞ্চার (১৯৮৫), নাসু: সামার ইন আন্দালুসিয়া (২০০৩), দ্য কিড উইথ আ বাইক (২০১২)।