হাসি মজা ডট কম

মোটা দাগে পৃথিবীতে দুই প্রজাতির মানুষকে আলাদা করা যায়। এক প্রজাতি সবকিছুতেই শিক্ষা খোঁজে। তারা সবকিছু থেকেই কিছু না কিছু শিখতে চায়। সে কারণে মজার কোনো বই পড়ে বা সিনেমা দেখে সাধারণত তাদের ভুরু কুঁচকে ওঠে। এসব ছাইপাঁশ পড়া বা দেখা স্রেফ সময় নষ্ট বলেই তাদের ধারণা। এটা এক দিক দিয়ে ভালোই বলতে হবে। আরেক প্রজাতি আছে, যারা শিক্ষার চেয়ে আনন্দকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। আনন্দের মাঝে শেখার যদি কিছু থাকে, তবে সেটি বাড়তি পাওনা বলেই তাদের বিশ্বাস। আজকে এক থেকে দেড় ডজন সিনেমার কথা বলব শুধু এই দ্বিতীয় প্রজাতির জন্য। তাই যারা এসব মুভি থেকে কিছু শিখতে চাও, তাদের এ লেখাটা না পড়াই ভালো। কারণ, এখন আমরা খুশির ফোয়ারা ছোটা হাসি মজা ডট কম নামের মজার এক দেশে যাত্রা করব। সবাই সিটবেল্ট বেঁধে বসো!

যাত্রার শুরুতেই ১০০ বছর আগের এক ঘটনা বলি। বাংলার শিশু-কিশোরদের জন্য নতুন বৈচিত্র্যময় এক উইন্ডো, মানে জানালা খুলেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। বিল গেটসের উইন্ডোজ বাজারে ছাড়ার অনেক অনেক আগের ঘটনা সেটি। সালটি ছিল ১৯১৩। আর সেই ম্যাগাজিনরূপী জানালার নাম সন্দেশ। তুমুল জনপ্রিয় আর মজার সেই পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল গুপী গাইন নামের এক রূপকথা। পত্রিকাটির মতোই গল্পটিও জনপ্রিয় হয়েছিল শিশু-কিশোরদের কাছে। প্রায় ৫০ বছর পর, উপেন্দ্রকিশোরের নাতি সত্যজিৎ রায় তখন সন্দেশ পত্রিকার হাল ধরেছেন। পাশাপাশি চলচ্চিত্র বানিয়ে বেশ নাম কামিয়েছেন। এ রকমই একদিন সত্যজিতের ১৩ বছরের ছেলে সন্দীপ বায়না ধরলেন, গুপী গাইন নিয়ে ছবি বানাতে হবে। ছেলের আবদার রাখতে গুপী গাইন বাঘা বাইন নাম দিয়ে গল্পটি রিলবন্দী করলেন সত্যজিৎ। তার পরের কাহিনি তো ইতিহাস। বিপুল জনপ্রিয়তার পাশাপাশি অনেক আগেই ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে ছবিটি।

গুপী আর বাঘা দুই গ্রামের বাসিন্দা। কেউ কাউকে চেনে না। তবে দুজনেই প্রচণ্ড গানপাগল। কিন্তু তা হলে কী হবে, গানের গ-ও জানে না তারা। তাদের গান সাধনায় গ্রামের সবার কানের বারোটা বেজে যায়। বাধ্য হয়ে আমলকী আর হরীতকী গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় গুপী আর বাঘাকে। পথে এক বনের ধারে দুজনের দেখা হয় এই দুই সংগীতজ্ঞের (মানে সংগীত অজ্ঞের)। ঘটনাক্রমে এক ভূতের রাজার সঙ্গে দেখা হয় তাদের। দুজনের প্রতি খুশি হয়ে তিনটি বর দেন ভূতের রাজা। তাতে রাতারাতি কোকিলকণ্ঠের অধিকারী হয় গুপী আর বাঘা। তাদের গান শুনে যেকোনো মানুষ তবদা লেগে মুহূর্তেই স্ট্যাচু হয়ে যায়। পাশাপাশি খাবারের অভাবও দূর হয় তাদের। বিশেষ এক জাদুর জুতা দিয়ে ইচ্ছেমতো যেকোনো জায়গায় চলে যেতে পারে তারা। এরপর শুরু হয় আজব সব কাণ্ডের। তাতে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। তাই পেটপুরে যারা হাসতে চাও, তাদের জন্য ছবিটি অবশ্য দর্শনীয়। গুপী আর বাঘাকে নিয়ে ১৯৮০ সালে হীরক রাজার দেশে নামে একটি সিকুয়েল বানিয়েছিলেন সত্যজিৎ। এটিও মজার মুভির তালিকায় রাখা যায়।

বিদেশি হরর মুভি দেখলেই মনে হয়, মানুষের ক্ষতি করা ছাড়া ভূতদের আর কোনো কাজ নেই। কিন্তু বাংলা ভাষায় বানানো বেশ কয়েকটি মুভি দেখলে ভূতদের সম্পর্কে ধারণা পাল্টে যায়। গুপী গাইন বাঘা বাইন-এ তো এ রকম এক ভূতরাজার কথা জেনেছ। এ ছাড়া শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি নিয়ে বানানো ছায়াময় ছবিটির কথাও বলা যেতে পারে। শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের বইগুলো সম্পর্কে যারা পড়েছ, তাদের আর তার গল্পের ঢং নিয়ে নতুন করে ঢং করার কিছু নেই। ছায়াময় ছবিতে আছে গ্রামের এক ধনী আর লোভী সুদখোর ব্যবসায়ী গগন শাবু। অলংকার নামের এক দস্যি ছেলে। ছায়াময় নামের এক উপকারী ভূত। ভণ্ড এক সাধু। আরও একগুচ্ছ মজার চরিত্র। আর আছে মাটিচাপা গুপ্তধন। এসব নিয়েই জমজমাট এক কাহিনি। দম ফাটানো এ হাসির ছবির পাশাপাশি উপকারী ভূত নিয়ে ভারতের কলকাতায় নির্মিত আরেকটি ছবি ভূতের ভবিষ্যৎও দেখতে পারো।

দম ফাটানো হাসির তালিকায় বিদেশি ছবির মধ্যে আছে বেবিজ ডে আউট কিংবা ‘হোম অ্যালোন’ সিরিজ। অবশ্য এ মুভিগুলো নিয়ে তোমাদের কিছু বলা আর মায়ের কাছে মাসির বাড়ির কথা বলা একই কথা। কারণ, অনেকেই হয়তো এরই মধ্যে এ মুভিগুলো অনেকবার দেখে ফেলেছ। তার চেয়ে হলিউডের কমেডি সম্রাট রবিন উইলিয়ামের কিছু ছবির কথা বলি। প্রথমেই বলতে হয় জুমানজির কথা। দুর্দান্ত অ্যাডভেঞ্চার আর টানটান উত্তেজনায় ভরপুর এ ছবিটির সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, হাসতে হাসতে জান কারবার হয়ে যায়। রবিন উইলিয়ামের মজার ছবির মধ্যে আরও রয়েছে হুক, মিসেস ডাউটফায়ার, দ্য ফ্লাবার। অ্যাডভেঞ্চার আর কমেডি যারা একসঙ্গে পেতে চাও, তাদের জন্য আরেকটি দর্শনীয় ছবি স্টিফেন স্পিলবার্গ প্রযোজিত গুনিজ। ছবিতে ঘটনাক্রমে একদল ছেলেমেয়ে কুখ্যাত এক জলদস্যুর গুপ্তধনের নকশা হাতে পায়। সেটি উদ্ধারে শুরু হয় রোমহর্ষক আর মজার সব ঘটনা।

এ রকম আরও কয়েকটি ছবির তালিকায় আছে চীনা অভিনেতা জ্যাকি চ্যানের দ্য স্পাই নেক্সট ডোরঅ্যাকসিডেন্টাল স্পাই। এ দুটি ছবিতেই গুপ্তচরের ভূমিকায় দেখা যাবে জ্যাকি চ্যানকে। একজন গুপ্তচর বাড়ির কাছের প্রতিবেশী। আরেকজন দুর্ঘটনাক্রমে গুপ্তচর বনে যান। রোমাঞ্চকর কাহিনি, কুংফু-কারাতের পাশাপাশি হাসির খোরাকেরও কোনো অভাব নেই ছবি দুটিতে। এ ছাড়া ফরাসি লেখক জুল ভার্নের জনপ্রিয় অভিযানের কাহিনির দূরবর্তী ছায়া অবলম্বনে নির্মিত জ্যাকি চ্যানের অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেজ ছবিটি দেখেও মজা পাবে।

যারা ফ্যান্টাসির ভক্ত, তারা দেখতে পারো ডক্টর সসের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত দ্য ক্যাট ইন দ্য হ্যাট, হর্টন হেয়ারস এ হু!। রোয়াল্ড ডালের কাহিনি নিয়ে বানানো ফ্যান্টাসটিস মিস্টার ফক্স, চার্লি অ্যান্ড দ্য চকোলেট ফ্যাক্টরি। পাশাপাশি অ্যানিমেশন ছবি ডেসপেক্যাবিল মি, মিট দ্য রবিনসন, দ্য মাপেটস, ডাম্বো (১৯৪১), ট্যাঙ্গেলড, পুশ ইন বুটস, রাটাটুলি, ওয়াল-ই, ক্রুডস। প্রতিটিই ভিন্ন স্বাদের হলেও মজা অফুরন্ত। তালিকায় রাখতে পারো তিন গায়ক কাঠবিড়ালির কাহিনি নিয়ে বানানো অ্যালভিন অ্যান্ড দ্য চিপমাঙ্কস আর এক কিশোরের মজার সব কাণ্ডকীর্তির কাহিনি দ্য ডায়রি অব আ উইম্পি কিড সিরিজের ছবিগুলো।

এ ছাড়া ছোট্ট এক ইঁদুরের কাছে মানুষের নাজেহাল হওয়ার গল্প মাউস হান্ট, দাঁতের পরির গল্প টুথ ফেইরি, প্রাণীদের ভাষা বুঝতে পারা এক ডাক্তারের মজার কাহিনি ডক্টর ড্যুলিটল আর বিশাল এক খেলনা দোকানের কাহিনি নিয়ে বানানো মিস্টার ম্যাগোরিয়ামস ওয়ান্ডার ইম্পোরিয়াম দেখেও মজা পাবে। অন্যদিকে একদল ছেলেমেয়ের নানা মজার কাণ্ডকীর্তি নিয়ে নির্মিত দ্য লিটল রাস্ক্যালস, ফরাসি ছবি লিটল নিকোলাস কিংবা ইরানি ছবি দ্য সংস অব স্প্যারো দেখে ফেলতে পারো চোখ বন্ধ (!) করে।

আমাদের মিছিমিছি যাত্রা আজকের মতো এখানেই শেষ। সবই বলে দিলাম, এবার পছন্দমতো ছবি বাছাই করে দলবল নিয়ে বসে যাও বন্ধুরা মিলে। একা একা কি হাসতে ভালো লাগে! ভালো কথা, যারা গম্ভীর প্রকৃতির দর্শক, মানে ওই প্রথম প্রজাতি আরকি, ওদের মন খারাপ করতে নিষেধ কোরো। ওদের জানিয়ে দিয়ো, পরের কোনো এক অবসরে শিক্ষণীয় কয়েক ডজন ছবির তালিকা দিয়ে দেব।