অর্থনীতির ব্যাপার স্যাপার

অর্থনীতি কী? সংজ্ঞা নিয়ে ভারী ভারী কথার চেয়ে বরং গল্পটা বলি:

অর্থনীতিতে তখন খারাপ সময় চলছে। এক পর্যটক বেড়াতে এসেছেন নতুন এক শহরে। পর্যটক লোকটি ভালো এবং পছন্দের একটা রুম খঁুজলেন শহরটিতে। গেলেন শহরের একমাত্র হোটেলটিতে। হোটেল মালিককে এক হাজার টাকার একটি নোট দিয়ে বললেন, এটা অগ্রিম। আগে রুমে যাবেন, দেখবেন এবং রুম পছন্দ হলে তবেই থাকবেন। এই বলে তিনি রুম দেখতে চলে গেলেন।

হোটেল মালিক দ্রুত এক হাজার টাকার নোটটি শার্টের পকেটে পুরে চলে গেলেন উল্টোদিকের বাজারে। সেখানে ধারে তিনি মাংস কিনেছিলেন হোটেলের জন্য। সেই টাকাটা এবার দিয়ে দিলেন মাংসের দোকানিকে।

দোকান মালিক এবার টাকাটা পকেটে নিয়ে দ্রুত চলে গেলেন পাশের কসাইয়ের দোকানে। সেখান থেকেই তো তিনি বাকিতে মাংস এনেছিলেন। নোটটি দিলেন কসাইকে  

কসাই লোকটি এক হাজার টাকার নোটটি পকেটে নিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেলেন। চলে গেলেন শহরের ধনী ব্যবসায়ী বন্ধুটির বাসায়। বিপদে টাকা ধার করেছিলেন, ফেরত দিলেন।

ধনী ব্যবসায়ীও এক হাজার টাকার নোটটি নিয়ে দ্রুত চলে গেলেন হোটেলে। ব্যবসার প্রয়োজনে একবার হোটেলে অতিথি রাখতে হয়েছিল। সেই টাকাটা তখন দেওয়া হয়নি। আজ দিয়ে দিলেন। মুচকি হেসে পরিচিত এক হাজার টাকার নোটটি নিয়ে নিলেন সেই হোটেল মালিক।

হোটেল মালিক কিন্তু এবার আর টাকাটা পকেটে পুরলেন না। কাউন্টারে চাপা দিয়ে অপেক্ষায় থাকলেন। একটু পরেই নিচে নামলেন সেই পর্যটকটি। রুম পছন্দ হয়নি? আরও ভালো রুম চাচ্ছেন। তারপর কাউন্টার থেকে এক হাজার টাকার নোটটি নিয়ে চলে গেলেন পাশের শহরে, নতুন হোটেলের সন্ধানে।

এই গল্পটা থেকে আমরা কী জানলাম? মাত্র এক হাজার টাকার নোট পাঁচজনের দেনা পরিশোধে কাজে লাগল, কেউ আর এখন খেলাপি নন, পাওনাদার নন কেউ, অর্থনীতি সচল হলো এবং শহরের সবাই তাতে খুশি। অর্থনীতি আসলে এটাই। টাকা কীভাবে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় এবং তাতে অনেক মানুষের কী কাজে লাগে, সেটাই জানায় অর্থনীতি বা অর্থশাস্ত্র।

এককথায় বলা যায়, অর্থনীতি হচ্ছে অর্থের ব্যাপার-স্যাপার বা অর্থ নিয়ে যেসব কাজ-কারবার, সেটাই অর্থনীতি। তবে এটুকু বললে অর্থনীতি সহজ না জটিল, সেটি ঠিক বোঝা যায় না। আর তা বুঝতে হলে অর্থনীতি নিয়ে ভারী ভারী বই পড়া প্রয়োজন। বিপদ কিন্তু সেখানেই বেশি। অর্থনীতি নিয়ে যত বড় বড় বা ভারী ভারী বই পড়ি না কেন—অর্থনীতির সংজ্ঞায় শুরুতেই লেখা থাকে যে অর্থশাস্ত্র কাকে বলা যাবে, সেটা নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা কখনো একমত হতে পারেননি। আসলে কোনো বিষয়েই অর্থনীতিবিদেরা কখনোই একমত হতে পারেননি, তাই অর্থশাস্ত্রের সংজ্ঞা নিয়েও তাঁরা একমত নন। আমরা কিন্তু সবাই জানি, একই বিষয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দেওয়ার জন্য দুই অর্থনীতিবিদকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার উদাহরণ আছে। 

বলা যায়, বিষয় হিসেবে অর্থনীতি বা অর্থশাস্ত্র নিয়ে আলোচনার বহু আগেই অর্থনীতির সৃষ্টি হয়েছিল। সেই প্রাচীন মিসরীয় বা গ্রিকদের সময়েই কিন্তু বিনিময়, মুদ্রা, দাম, বাণিজ্য, লাভ বা ঋণের সুদ—এই বিষয়গুলো জানা ছিল। কিন্তু তখন অর্থনীতি শব্দগুলোর সঙ্গে কারও পরিচয় ছিল না। যেমন ধরা যাক, আদিম মানুষেরা বেঁচে থাকতে শিকারের জন্য কুড়াল বা ধনুক তৈরি করেছিল। তবে এটি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা অর্থনীতি নয়। প্রথমদিকে হয়তো শিকার করা হরিণের মাংস সবাই ভাগাভাগি করে খেল। তারপর কিছুদিন পর দেখা গেল, সবাই ভালো শিকার পারে না। কেউ কেউ হয়তো হাতিয়ার ভালো তৈরি করতে পারে, কিন্তু শিকার পারে না। আবার যে শিকার পারে, সে হাতিয়ার বানাতে পারে না। ফলে দেখা গেল, একদল হাতিয়ার বানাচ্ছে, আরেক দল শিকার করছে। পরে শিকারি হাতিয়ার বানানোর বিনিময়ে হরিণের অর্ধেকটা দিয়ে দিল। এই হচ্ছে অর্থনীতির শুরু। বলা যায়, যেদিন থেকে মানুষ উৎপাদন শুরু করেছিল, সেদিন থেকেই অর্থনীতি শুরু। 

একটি দেশ কীভাবে তার অর্থ ও সম্পদ (যেমন, শ্রমশক্তি ও ভূমি) ব্যবহার করে পণ্য বা সেবার উৎপাদন এবং কেনাবেচার বিষয়টি ব্যবস্থাপনা করে, সেটাই আসলে অর্থনীতি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এসব পণ্য বা সেবার দাম কীভাবে নির্ধারণ হবে? এটি চাহিদা আর জোগানের ভিত্তিতে ঠিক হয়। অর্থাৎ একটি পণ্য বা সেবা কত মানুষ কিনতে চায়, সেটাই চাহিদা। এর সঙ্গে অবশ্যই কেনার সামর্থে্যর বিষয়টি রয়েছে।  

শুরুর গল্পটায় আবার ফিরে যাই। যদি প্রশ্ন করি: একটি এক হাজার টাকার নোট যেভাবে সবার কাজে লাগল, তাতে কি সবাই ভালো থাকল, সবাই খুশি হলো? উত্তর হচ্ছে, একজন কিন্তু খুশি হলেন না। সেই যে পর্যটক, তিনি মনের মতো একটা রুম পেলেন না। ফলে শহর ছেড়ে চলে যেতে হলো। এখন তাহলে কী করতে হবে?

হোটেল রুম আরও ভালো করতে হবে। এ জন্য বিনিয়োগ লাগবে। টাকা দেওয়ার জন্য তো বসেই আছে ব্যাংক। ব্যাংকের ঋণ নিয়ে রুমটা যদি ভালো করা যায়, তাহলে সেই পর্যটক এবার দুই হাজার টাকা দিয়ে থাকবেন। আরও অনেক পর্যটক আসবেন। এতে আরও বেশি করে মাংস কিনতে হবে। ব্যবসা বাড়বে দোকানি ও কসাইয়ের। এতে ব্যাংক লাভসহ ঋণের টাকা ফেরত পাবে। আবার ব্যবসা বাড়লে সরকারও বেশি করে কর পাবে। তাতে রাস্তাঘাট হবে। রাস্তাঘাট বেশি হলে আরও বেশি পর্যটক আসবে। প্রতিটি মানুষ টিকে থাকা বা আরও ভালোভাবে থাকার জন্য দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলো এভাবেই করেন। অর্থনীতি তো এটাই।

তাই তো প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আলফ্রেড মার্শাল বলেছিলেন, অর্থনীতি মানবজাতির দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কার্যকলাপের আলোচনা করে।

দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কার্যকলাপের এই আলোচনা সামনের দিনগুলোতেও চলবে। 

অলংকরণ: স্বপন চারুশি