আকাশের সাত ঋষি

সেবার বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছিলাম কেওক্রাডং পাহাড়ে। রাতে চূড়ায় বসে এক বন্ধু বলল, আমাদের তারা চেনা। আমি একটা একটা করে মণ্ডল চেনাচ্ছি, তারার নাম বলে যাচ্ছি। হুট করে এক বন্ধু জিজ্ঞেস করল, সপ্তর্ষিমণ্ডল কোথায়? আমি বললাম, এখনো দিগন্তের পাহাড় ছাড়িয়ে পুরোটা ওঠেনি, মাঝরাতের কিছু পর পুরোটা দেখা যাবে।

তারপর ঘুমাতে যাওয়ার আগে সবাই বলল, তাদের যেন সপ্তর্ষিমণ্ডল উঠলেই ডেকে দিই। আমি হাসলাম। কয়েক ঘণ্টা ট্র্যাক করে চূড়ায় পৌঁছেছি বিকেলে, এরপর ডিসেম্বরের তীব্র শীতে কেউ কি আর ভোরে সপ্তর্ষি দেখতে লেপের নিচ থেকে বের হবে?

অদ্ভুত কাণ্ড। আলো ফোটার একটু আগে আমার ঘুম ভাঙল। আমি ঘড়ির দিকে তাকাতেই মনে পড়ে গেল সপ্তর্ষির কথা। সবাইকে ডাকতে লাগলাম এবং অবাক হয়ে দেখলাম, সবাই সত্যি সত্যি বেরিয়ে আসছে কটেজ থেকে, সপ্তর্ষি দেখার জন্য।

বাংলাদেশে সপ্তর্ষিমণ্ডলের প্রতি রয়েছে অন্য রকম আগ্রহ। আসলে পুরো পৃথিবীতেই এটি প্রচণ্ড জনপ্রিয়। আকাশের বুকে বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেখে মানুষের মনে গভীর কৌতূহলের জন্ম হয়।

কাউকে যদি আকাশের একটি তারার নাম বলতে বলা হয়, অধিকাংশ মানুষই বলে ধ্রুবতারার কথা। কারণ, এ তারা দিয়েই দিক চেনা যায়। এ তারা সব সময়ই ঠিক একটি জায়গায় থাকে। আজ সন্ধ্যায় যদি তুমি তারাটিকে খুঁজে বের করতে পারো, সারা বছর রাতের যেকোনো সময় তুমি সেখানেই ধ্রুবতারাকে খুঁজে পাবে। এমনকি দিনের বেলায় যদি তারা দেখা যেত, তবে দিনের বেলাতেও তুমি সেখানেই দেখতে পেতে। সত্যি বলতে, সূর্যগ্রহণের সময় এমনটাই দেখা যায়। ঠিক উত্তর দিকে।

এই ধ্রুবতারা কীভাবে খুঁজে বের করবে? এ জন্যই প্রয়োজন সপ্তর্ষিমণ্ডলকে চেনা। তার আগে জানা চাই, মণ্ডল (Constellation) কী? সহজ ভাষায় বললে, আকাশের একেকটি দিকের একটি অঞ্চল বা কিছু তারা নিয়ে কল্পনা করা একটা আকৃতি। যেমন সিংহ, কুকুর, কাঁকড়াবিছা, প্রশ্নবোধক চিহ্ন, ত্রিভুজ, বক—এমন নানা আকৃতি। এ রকম একটি আকৃতি হলো প্রশ্নবোধক।

উত্তর আকাশে দেখা যায় এই সাত তারা দিয়ে তৈরি প্রশ্নবোধক চিহ্নটাকে। ইংরেজিতে এই মণ্ডলকে বলে Big Dipper আর গ্রিকে Ursa Major। এই সাত তারা আসলে বিশাল এক ভালুকের পেছনের অংশ। অনেক দেশে পুরো ভালুককেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে লোকে ভালুকটাকে চেনে না। চেনে শুধু ভালুকের লেজে থাকা প্রশ্নবোধক চিহ্নটাকে। এই ভালুকও কিন্তু বনের ভালুক নয়। এ হলো গ্রিক পুরাণের সেই ক্যালিস্টো, যাকে জিউসের স্ত্রী হেরা ভালুক বানিয়ে ফেলেছিল। তারপর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আকাশে, সেই থেকে আছে Ursa Major হয়ে।

এই সাত তারার আলাদা নাম আছে। ভারতীয় উপমহাদেশের জ্যোতির্বিদেরা সাতজন ঋষির নামে নাম রেখেছিলেন এই সাত তারার। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে সপ্তর্ষিমণ্ডল। প্রশ্নবোধকের শুরু থেকে (ছবিতে ডান দিক থেকে) প্রথম তারাটির নাম ক্রুতু, এর পরেরটি পুলহ। এরপর পুলস্ত্য, অত্রি, অঙ্গিরা, বশিষ্ঠ, মরিচি। ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যায় পুরো ভালুককে বলা হয়েছে একটা ময়ূর। এর নাম সংস্কৃত ভাষায় চিত্রশিখণ্ডী।

বাংলা সাহিত্য, গানে বারবার ঘুরেফিরে সপ্তর্ষি আর ধ্রুবতারার কথা এসেছে। মান্না দের কণ্ঠে তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছ—

আকাশপানে চেয়ে চেয়ে
সারা রাত জেগে জেগে
দেখেছি অনেক তারার ভিড়
অরুন্ধতী, স্বাতী
সপ্তঋষির খেলা
সব দেখেছি। শুধু
চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি

সাতটি তারার ষষ্ঠ তারাটির নাম রাখা হয়েছে ঋষি বশিষ্ঠের নামে। দ্বিতীয় ছবিতে বশিষ্ঠের পাশে যে ছোট্ট একটা তারা দেখা যাচ্ছে, তার নাম অরুন্ধতী। অরুন্ধতী ছিলেন ঋষি বশিষ্ঠের স্ত্রী। সনাতন ধর্মাবলম্বী নববিবাহিত জুটিকে আগে তারা দুটো দেখানো হতো, তাঁদের একসঙ্গে জীবন কাটানোর কামনা করে। কিন্তু অরুন্ধতী বেশ অনুজ্জ্বল। তাই একে খুঁজে পেতে তোমাকে যেতে হবে বায়ুদূষণ, আলোকদূষণ নেই এমন কোনো অঞ্চলে। যেখানে অন্ধকার ঘন হয়ে আসে।

এই সপ্তর্ষি থেকে কেমন করে আমরা ধ্রুবতারা খুঁজব? খুব সহজ। পুলহ থেকে ক্রুতুর দিকে যদি একটা সরলরেখা টানা হয়, সেটি সোজা সামনে বাড়লেই পাওয়া যাবে একটি নিঃসঙ্গ তারা। সেটিই হলো ধ্রুবতারা। এর আশপাশে অতটা উজ্জ্বল কোনো তারা নেই। অপর দিকে এই তারা বছরজুড়ে এখানেই থাকে।

ভালুকের পেটের পুলহ থেকে ক্রুতু হয়ে কিছুদূর সামনে বাড়লেই দেখা মিলবে ধ্রুবতারার।

আমি বারবার বলছি, ধ্রুবতারা সারা বছর এক জায়গাতেই দেখা যায়। তাহলে অন্যান্য তারার ক্ষেত্রে কী ঘটে? তোমরা নিশ্চয়ই জানো, সূর্য একটা তারা। এটি পূর্ব দিক থেকে উঠে প্রতিদিন পশ্চিমে অস্ত যাচ্ছে। আসলে পৃথিবী ঘুরছে, তাই মনে হচ্ছে সূর্যই যেন ঘুরছে আর পৃথিবী স্থির। আকাশের সব তারার ক্ষেত্রেও ঠিক এই ব্যাপার ঘটে। পূর্ব দিক থেকে উঠে এগুলো পশ্চিমে অস্ত যায়। আসলে পৃথিবীটা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে বলে এমন মনে হয়। কিন্তু উত্তর তো আর বদল হচ্ছে না। তাই উত্তরে ধ্রুবতারা সব সময় ঠিক উত্তরেই থেকে যাচ্ছে। আর এর কিছু দূরে থাকা সপ্তর্ষিকে মনে হবে যেন ধ্রুবতারাকে ঘিরে ঘুরছে। উত্তর-পূর্ব থেকে উদয় হয়ে সপ্তর্ষি অস্ত যাবে উত্তর-পশ্চিমে। ওঠার সময় যেমন সপ্তর্ষির একটি করে তারা আস্তে আস্তে উদয় হবে, তেমনি অস্ত যাবে একটি করে।

সারা বছরই কি বাংলাদেশ থেকে সপ্তর্ষিকে দেখা যায়? আসলে তেমনটা নয়। ফেব্রুয়ারি থেকে সপ্তর্ষি দেখার ভালো সময় শুরু বলা যেতে পারে। সন্ধ্যার কিছু পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত আসলে তারা দেখার সময় হয় মানুষের। পরের পাঁচ–ছয় মাস রাতের নানা সময়ে আকাশে সপ্তর্ষির দেখা মিলবে। এই অক্টোবরে এসে ঠিক সন্ধ্যায় যদি অন্ধকার আকাশ পেয়ে যাও, তবে উত্তর-পশ্চিম আকাশে খুঁজতে পারো। সন্ধ্যার পরপরই ডুবে যাবে এটি। তবে যদি ভোরে খোঁজো, উত্তর-পূর্ব আকাশে খুঁজতে হবে। ভোরের আগেই এটি আবার উদয় হবে পূর্ব দিক থেকে। আর মাস দুয়েক অপেক্ষা করলে মধ্যরাতেই খুঁজে পাবে সপ্তর্ষিমণ্ডলকে।

সপ্তর্ষিকে খোঁজার ভালো উপায় হলো সময় বুঝে উত্তর আকাশে চেয়ে থাকা। বিশাল এক এলাকা নিয়ে যদি কিছুক্ষণ চেয়ে থাকো, হুট করে আবিষ্কার করবে, তুমি একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেখতে পাচ্ছ। এ ছাড়া একটা অ্যান্ড্রয়েড বা আইওএস অ্যাপ ব্যবহার করে তুমি খুঁজতে পারো আকাশের যেকোনো তারা। সবচেয়ে ইউজার ফ্রেন্ডলি অ্যাপ বলা যায় Sky Map-কে। Google Sky Map লিখে প্লে স্টোরে খুঁজলেই পাওয়া যাবে অ্যাপটি। এটিকে লোকেশন পারমিশন দিয়ে তোমার মুঠোফোন আকাশের যেদিকটায় তাক করবে, সেদিকের তারাগুলোর ম্যাপ দেখাবে। এভাবে উত্তরে একটু খুঁজলেই পেয়ে যাবে তোমার কাঙ্ক্ষিত Ursa Major।

সপ্তর্ষি নিয়ে আলাপ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার অন্য একটা জিনিস মনে পড়ল। সেটা হলো কৃত্তিকার কথা। তোমরা অনেকেই নিশ্চয়ই সেভেন সিস্টারসের কথা শুনেছ। এই নামগুলো আসলে সপ্তর্ষির নয়। সাতটি তারা খুব কাছে থেকে আকাশে একটি ঝোপের মতো তৈরি করে। তাকেই বলে সেভেন সিস্টারস। তবে বাংলায় এই সেভেন সিস্টারস ‘সাত ভাই’ বা কৃত্তিকা নামে পরিচিত। সপ্তঋষি নিয়ে আজ যে আলাপ হলো, একদিন নিশ্চয়ই কিশোর আলোর ১০০ বিলিয়ন বছর পূর্ণ হবে৷ সেদিন শোনা হবে আকাশের ১০০ বিলিয়ন তারা নিয়ে গল্প৷ সেই শুভকামনা রইল কিশোর আলোর সঙ্গে যারা ছিলে এই সাত বছরে এবং যারা যুক্ত হবে সামনের ১০০ বিলিয়ন বছরে, তাদের সবার প্রতি।