কাঞ্চনজঙ্ঘার পশ্চিম দিক দিয়ে হেঁটে আর গাধা-ঘোড়ার টানা গাড়িতে শুরু হয় তাঁদের তিব্বতযাত্রা। পর্বতের কয়েক হাজার ফুট উঁচু রাস্তা পেরিয়ে প্রায় ছয় মাসের যাত্রা শেষে তাঁরা পৌঁছান থাশিলহুনপু শহরে। পর্বতের বরফ, জমাটবাঁধা হ্রদ, কনকনে বাতাস পেরিয়ে চট্টগ্রামের ছেলে পৌঁছান তিব্বতে। এর আগে ১১শ শতাব্দীতে আরেক বাঙালি অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান মুন্সিগঞ্জ থেকে তিব্বতে গিয়েছিলেন। তিব্বতে ছয় মাস থেকে তিব্বতীয় আর সংস্কৃত ভাষার অন্য পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেন শরৎচন্দ্র। ১৮৮০ সালেই আবার দার্জিলিং ফেরেন শরৎ আর উগেন। দার্জিলিংয়ে ফিরে কয়েক মাস আগের নিয়মে ফেরার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু তিব্বত যেন তাঁকে ডাকছিল মনে মনে। একদিকে কাজ, একদিকে গবেষণা আর অন্যদিকে তিব্বতের ডাক—কোনটা শুনবেন? দ্বিধা কাটিয়ে তিব্বত থেকে ফেরার এক বছরের মধ্যে ১৮৮১ সালের নভেম্বরে আবারও ঘর ছাড়েন তিনি। আবারও তিব্বতে যেতে লামা উগেনকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে উঠে পড়েন। এবারের অভিযানেও আগের পথ ধরে আবারও কাঞ্চনচূড়ার পশ্চিম দিক দিয়ে ভারতবর্ষ থেকে চীনা ভূখণ্ড তিব্বতে পা রাখেন শরৎচন্দ্র। এবারের যাত্রায় ইয়ারলাং উপত্যকায় অভিযান চালান শরৎ আর উগেন। ইয়ারলাং সাংপু নদীর পারেই ইয়ারলাং উপত্যকা। ১৮৮৩ সালে আবারও ভারতে ফিরে আসেন তাঁরা। কিন্তু
অভিযান যার রক্তে সে কি ঘরে ফিরে বসে থাকে? দুবার তিব্বত অভিযান শেষ করে বাড়ি ফেরেন তিনি। সবাই ভেবেছিল, এবার ক্ষান্ত দেবেন শরৎ। কিন্তু সবার ভুল ভেঙে দিয়ে ১৮৮৪ সালে ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসক কোলম্যান প্যাট্রিক লুইস ম্যাকাউলের সঙ্গে চীন অভিযানে গোয়েন্দাগিরির খাতায় নাম লেখান তিনি। রুশ, চীনা আর তিব্বতের তথ্য সংগ্রহ করা ছিল তাঁর কাজ। চীনের পিকিং (বর্তমানে বেইজিং) শহরেও কিছুদিন ছিলেন তিনি। লামাদের পোশাক পরার কারণে তখন তাঁকে সবাই কা-চে লামা নামেই ডাকত। চীনা, তিব্বত, সংস্কৃত, হিন্দি ও ইংরেজিতে পারদর্শী হওয়ায় প্রায় সব ব্যবসায়িক আর বাণিজ্যিক কাজে ডাক পড়ত শরৎচন্দ্রের। চীনে ব্রিটিশদের হয়ে কয় মাস কাজ শেষে ভারতবর্ষে ফেরেন শরৎচন্দ্র। এরপর বই লেখা ও তিব্বত-সংস্কৃত ভাষার অনুবাদ শুরু করেন তিনি। ১৯০২ সালে তাঁর আলোচিত বই জার্নি টু লাসা অ্যান্ড সেন্ট্রাল তিব্বত প্রকাশিত হয়। তাঁর জীবনাবসান হয় ১৯১৭ সালে।
শরৎচন্দ্র এমন সময় কাঞ্চনজঙ্ঘার তিব্বত গিয়েছিলেন, যখন চীনে ব্রিটিশ বা ভারতবর্ষের মানুষদের প্রবেশ উন্মুক্ত ছিল না। অভিযাত্রী শরৎচন্দ্রের চেয়ে সংস্কৃত-তিব্বতীয় ভাষার গবেষক হিসেবে শরৎচন্দ্র পশ্চিমের দুনিয়ায় পরিচিত। শরৎচন্দ্রের অভিযানের নানা গল্প তাঁর লেখা বইটিতে পাওয়া যায়। বাঙালির চোখে কাঞ্চন-তিব্বত অভিযানের স্বাদ শরৎচন্দ্রই প্রথম প্রকাশ করেন। ইতিহাসের বইয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা চূড়া জয়ের যত ঘটনা লেখা আছে, সেখানে শরৎচন্দ্র দাস আর লামা উগেন আলোচিত নাম। বাঙালির ঘরকুনো অপবাদকে অনেকটুকুই মুছে ফেলার জন্যও শরতন্দ্র আলোচিত। তাঁর বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা পড়লে মনে হবে, এই তো একটু পরেই নিচের বরফ হ্রদের পাশ দিয়ে এগিয়ে যাব সামনের পর্বতে। দুপুরের সূর্য মাথায় ওঠার আগে পেরোতে না পারলে গরমে সিদ্ধ হয়ে দুর্বল হয়ে যাব। বরফের আস্তর পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি...।