
একসময়ে বাঙালিকে বলা হতো গানের রাজা। শুধু কি গানেরই রাজা! স্বভাবকবি বাঙালি ছড়ারও মুকুটবিহীন বাদশা। তার এই রাজ্যপাট অনেক দিনের পুরোনো। অতীতে বাঙালি শিশুর অঙ্ক কষা, হিসাব শেখানো সবই হতো মুখে মুখে ছন্দে বা পয়ারে। এদের বলা হত আর্যা। এই আর্যাগুলোকেই বলা হয় ছড়ার আদি রূপ।
বাঙালির প্রাচীন জীবনের ভাঙা-গড়া, ওঠানামা নিয়ে তৈরি ছড়ার সংখ্যা অসংখ্য। এদের মধ্যে সবচেয়ে মিষ্টি হলো ছেলে ভোলানো ঘুম পাড়ানি ছড়া। বলে রাখা ভালো, ছেলে ভোলানো ছড়াকারদের পরিচয় বা নাম জানা যায় না। তাঁরা নারী কী পুরুষ, তা-ও বোঝার উপায় নেই। তবে কেউ কেউ বলেন যেহেতু ছেলেপুলে মানুষ করার প্রাথমিক দায়িত্ব নারীরই; অতএব এই ছেলে ভোলানো ছড়াগুলো সম্ভবত তাঁদেরই হাত থেকেই বেরিয়েছে। তবে মানতেই হবে অশান্ত শিশুকে শান্ত করার জন্যই এই ছড়াগুলোর জন্ম, ইতিহাস বা ইতিহাসের গল্প বলার জন্য নয়।
তবে এর বিচিত্র ধ্বনি আর আবোলতাবোল বুলির মাথামুণ্ডু খঁুজে পাওয়া মুশকিল। তারপরও চানাচুরে যেমন ভাজা চিনাবাদাম মেশানো থাকে, তেমনি কোনো কোনো ছড়ায় সত্য ঘটনার দু-একটি ভাঙা টুকরোও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। টুকরোগুলো পুরো ঘটনা বলে না, শুধু ইঙ্গিত দিয়ে যায়। এমনি একটি ছড়া হলো—
‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে?’
ছড়াটিতে একটি সত্য ঘটনার ইঙ্গিত রয়েছে। একসময় বাংলার নবাব ছিলেন আলীবর্দী খাঁ। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার নানা ছিলেন তিনি। তাঁর শাসনামালে বাংলায় শুরু হয়েছিল লুটেরা বর্গীদের চোরাগোপ্তা আক্রমণ। সে সময় ভারতের মারাঠা যোদ্ধাদের ফারসিতে বলা হতো বারগিস। এ শব্দটি বাংলায় আসতে আসতে রূপ পরিবর্তন করে লোকেমুখে হয়ে দাঁড়ায় বর্গী। প্রায় নয় বছর ধরে এই মারাঠা দস্যু বা বর্গীরা পশ্চিমবঙ্গ ও মুর্শিদাবাদে হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে সবার ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল। তাদের অকথ্য অত্যাচারে পুরো বাংলায় অশান্তি শুরু হয়েছিল। তাদের কথাই উঠে এসেছে এই ছেলে ভোলানো ছড়াটিতে। এ ছাড়া এখানে ‘বুলবুলিতে ধান খেয়েছে’ কথাটা বলা হয়েছে। সম্ভবত ধান চাষের ক্ষতি অথবা বর্গীদের লুটতরাজ প্রসঙ্গে এটি উল্লেখ করা হয়েছে। এমন অরাজক অবস্থায় কৃষকদের পক্ষে খাজনা দেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। সে কথাই বলা হয়েছে ছড়াটিতে। যাই হোক, অবশেষে নবাব আলীবর্দীর অক্লান্ত চেষ্টায় একসময় বর্গীর হামলার অবসান হয়েছিল। কিন্তু সেই ইতিহাসের ছিটেফোঁটা এখনো খুঁজে পাওয়া যাবে এই ছেলে ভোলানো ছড়াটিতে। তেমনি নিচের ছড়াতেও আছে বাংলার আরেক ঘটনার ইঙ্গিত।
ইকড়ি মিকড়ি চামচিকড়ি,
চাম কাটে মজুমদার
ধেয়ে এল দামোদর
দামোদরের হাড়িকুড়ি,
গোয়ালে বসে চাল কাড়ি।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই চামকাটা মজুমদার কে? ইনি হলেন কৃষ্ণনগরের (পশ্চিমবঙ্গ) রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদার। মধ্যযুগে দিল্লির সম্রাট ছিলেন মোগল সম্রাট আকবর। সেখান থেকেই তিনি ভারতের অধিকাংশ অঞ্চল শাসন করতেন। সে সময় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল শাসন করতেন বারোজন শাসক। তাঁরাই ইতিহাসে বারো ভূঁইয়া নামে পরিচিত। এঁদের নেতা ছিলেন শাসক ঈশা খাঁ, সোনারগাঁ ছিল তাঁর রাজধানী। তাঁর নেতৃত্বেই এই বারো ভূঁইয়ারা একসময় একজোট হয়ে দিল্লির শাসন মানতে অস্বীকার করেন। স্বাধীন রাজার মতো রাজত্ব করতে থাকেন তাঁরা।
বাংলার অবাধ্য (!) এই বারো ভূঁইয়াদের দমন করতে সেনাপতি মানসিংহকে বাংলায় পাঠিয়েছিলেন মোগল সম্রাট আকবর। কিন্তু মানসিংহকে সহযোগিতা করে বারো ভূঁইয়াদের ধরিয়ে দিতে কেউই আগ্রহী ছিল না। কিন্তু ভবানন্দ মজুমদার একা দেশদ্রোহ করে মানসিংহকে সহযোগিতা করেছিলেন। মানসিংহ এবং মোগল সৈন্যদের অসংখ্য নৌকা জোগাড় করে দিয়ে দামোদর নদ পার করান তিনি। মোগল সৈন্যদের খাবার এবং রসদও জোগাড় করে দেন ভবানন্দ মজুমদার। এরপরই বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম বীর যশোরের প্রতাপাদিত্যকে বন্দী করতে সক্ষম হন সেনাপতি মানসিংহ।

ওপরের ছড়াটির আপাত অর্থহীন কথার মধ্যে যা পাওয়া যায় তা হলো, ভবানন্দের বিশ্বাসঘাতকতা। ছড়াটিতে ঘৃণাবশত ভবানন্দের নাম উল্লেখ না করে তাকে নীচ, চামার বা চামকাটা মজুমদার বলা হয়েছে। এ ছাড়াও ১২৩০ বঙ্গাব্দে দামোদর নদে যে প্রবল বন্যা হয়েছিল তারও ইঙ্গিত রয়েছে ছড়াটিতে।
এবার নিচের ছেলে ভোলানো আরেকটি ছড়ার দিকে তাকানো যাক।
আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।
ঢাল মৃদং ঝাঁঝর বাজে
বাজতে বাজতে চলল ঢুলি, ঢুলি গেল কমলাফুলি
কমলাফুলির টিয়েটা, সূর্যিমামার বিয়েটা।
বাংলাদেশের উত্তরের জেলায় নীলফামারীর একটি উপজেলার নাম ডোমার। এর আগের নাম ছিল ডোমন নগর। আনুমানিক ১০৭৫ সালের দিকে এটি ছিল পাল বংশের রাজা ভীম পালের রাজধানী। এই রাজ্যের সৈন্যদের বলা হতো ডোম সৈন্য। ওপরের ছড়াটি নিছক ছেলে ভোলানো ছড়া মনে হলেও এর মধ্যে ডোমারের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সন্ধান পেয়েছেন ঐতিহাসিকেরা।
কোনো কোনো গবেষক ছড়াটিতে ডোম সৈন্যদের শোভাযাত্রা বা যুদ্ধযাত্রার ছবি খুঁজে পেয়েছেন।

আগডুম অর্থ যে ডোম সৈন্য সবার আগে যায়। আর ঘোড়াডুম হলো ঘোড়ার পিঠে সওয়ার ডোম সৈন্য। সঙ্গে বাজে তিন ধরনের বাদ্য—ঢাক, মৃদং এবং ঝাঝর। বলাই বাহুল্য, এই বাদ্যগুলো বাজানো হয় শোভাযাত্রা বা যুদ্ধযাত্রার সময়। তাই প্রথম দুই ছত্রে মল্লবাজদের ডোম সৈন্যের কথা হয়তো মনে পড়া স্বাভাবিক। মধ্যযুগের ধর্মমঙ্গলেও ডোম সৈন্যদের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
ইতিহাস অনুযায়ী, পাল বংশের আরেক রাজা ছিলেন রামপাল। সিংহাসনের অধিকার নিয়ে ভীমপাল আর রামপালের মধ্যে বেশ বড় ধরনের যুদ্ধ বেধেছিল। গবেষকদের ধারণা, রামপালের বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধযাত্রার ছবিই আঁকা হয়েছে এই ছেলে ভোলানো ছড়াতে। প্রথম ছত্র দুটিতে বেশ একটা বীরত্বের ছোঁয়া লেগে আছে। কিন্তু পরের ছত্রগুলো থেকে অনেকে যেমন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বীর রসের ছবি দেখতে পাননি। তিনি একটি বিয়ের শোভাযাত্রা দেখতে পেয়েছেন। কমলাফুলির টিয়ের সঙ্গে ‘সূর্যি মামার বিয়ে’ হচ্ছে। ঢাক বাজছে, বেশ উৎসবমুখর পরিবেশ। মনে হয় দুটো পৃথক ছবিকে কেটে একসঙ্গে জোড়া দেওয়া হয়েছে ছায়াচ্ছন্ন মোহময় এক পরিবেশ তৈরির উদ্দেশ্যে।
বলে রাখা ভালো, এই যুদ্ধে ভীমপাল পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন। বিজয়ী রামপালও বিখ্যাত রাজা ছিলেন। তাঁর নাম থেকেই দিনাজপুরের রামসাগর নামের উৎপত্তি।
মাহবুব আলম: সাবেক রাষ্ট্রদূত
অলংকরণ: আবু হাসান