জন্মদিনের কড়চা
তোমাকে কি চিনি আমি? নাহ্! নাম জানি! নাহ্! বয়স জানি! নাহ্! কিন্তু রীতিমতো জ্যোতিষীর মতো বলে দিতে পারি যে আজ যদি তোমার জন্মদিন হয়, তাহলে গত জন্মদিনে তুমি কেক কাটো আর না-ই কাটো, গত জন্মদিনের দিন থেকে আজ পর্যন্ত দুনিয়াতে বেড়ে গেছে ৭৭ লাখ মানুষ। আবার ছোট-বড় মিলিয়ে ঘটে গেছে প্রায় ৫০ হাজার ভূমিকম্প। তোমার চুল বেড়েছে ১২ সেন্টিমিটার, নখ বেড়েছে ৪ সেন্টিমিটার। দুনিয়া ঘুরতে ঘুরতে পাড়ি দিয়েছ ৫৮ কোটি মাইলেরও বেশি পথ। তোমার হৃদকম্পন ঘটেছে কমবেশি ৪ কোটি ২০ লাখ বার! তাহলেই বোঝো, জন্মদিন কোনো যা তা ব্যাপার নয়—এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত শত ঘটনা আর স্মৃতি! আর কি আশ্চর্য জানো, আজ যদি তোমার জন্মদিন হয়, তাহলে তুমি শুধু নয়—দুনিয়ার নানান কোণে সব মিলিয়ে প্রায় দেড় কোটি মানুষও জন্মদিন পালন করছে ঠিক আজকেই!
ঘটা করে জন্মদিন পালনের সূচনাটা যে ঠিক কবে সেটা সঠিক জানা নেই কারও। তবে ধারণা করা হয়, প্রাচীন মিসরেই আজ থেকে কমসে কম পাঁচ হাজার বছর আগে জন্মদিনকে বিশেষ একটি দিন হিসেবে বিবেচনা করার চল আরম্ভ হয়। প্রাচীন মিসরের কোনো ফারাও যেদিন শাসনভার গ্রহণ করতেন, ধরা হতো ওই দিন তিনি দেবত্ব লাভ করলেন। অর্থাৎ ওই দিনে তিনি মানুষ থেকে দেবতা হলেন! এই বিশেষ বিশ্বাস থেকেই ওই দিনটিকে দেবতার জন্মদিন হিসেবে বিবেচনা করত মিসরীয়রা। তবে এ তো গেল রাজা-রাজড়াদের ব্যাপার। সাধারণ মানুষের জন্মদিন পালন শুরু হয় রোমে। যাদের বয়স ৫০ হতো—তাদের জন্য তৈরি হতো বিশেষ এক কেক। এতে থাকত ময়দা, জলপাই তেল, মধু আর পনির। তবে হ্যাঁ, কেকের ওপর মোমবাতি বসিয়ে জন্মদিন পালনের রেওয়াজ আরম্ভ হয় প্রাচীন গ্রিসে। তবে শুধু পুরুষদেরই জন্মদিন পালন করা হতো, পালন করা হতো না মেয়েদের জন্মদিন।
আঠারো শতক থেকেই কেক কেটে জন্মদিন পালনের চল ছড়িয়ে পড়ে দুনিয়াজোড়াই। তবে কেক দিয়ে জন্মদিনের পালনের বিষয়টিকে ভালোমতো আরম্ভ করে জার্মানরা। মূলত শিশুদের জন্মদিন পালন হতো কেক কেটে। শিশুর বয়স যত ততগুলো মোম কেকে বসাত জার্মানরা। সঙ্গে যোগ করত বাড়তি একটি মোমবাতি। ওই বাড়তি মোমবাতির উদ্দেশ্য ছিল পরবর্তী জন্মদিন পর্যন্ত অর্থাৎ আরও এক বছর যেন ওই শিশুটি বেঁচে-বর্তে থাকে তার জন্য শুভ কামনা করা। তবে উনিশ শতকের আগ পর্যন্ত কেক কেনার সাধ্য ছিল খুব কম মানুষেরই—অতি ধনী ছাড়া কেক কেনা ছিল অসম্ভব। শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে বেকারি শিল্পের বিস্তার ঘটে—কেকের দাম কমে চলে সাধারণের নাগালের মধ্যে। বলা উচিৎ, ভালো কেকের দাম নাগালের মধ্যে আসা আরম্ভ হয়। তবে হ্যাঁ, ভালো কেকের দামও এখনো অনেক বেশি—ইচ্ছে হলেই চাখবার সুযোগ সীমিত! বার্থডে কেক এই শব্দজোড়া অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে প্রথম অন্তর্ভুক্ত হয় ১৭৮৫ সালে। আর ডিকশনারিতে বার্থডে কার্ড শব্দটি ঢোকে ১৯০২ সালে। অর্থাৎ কেকের ধারণা দূরের হলেও, বার্থডে কার্ডের ধারণাটা অনেক নতুন। নতুন হলে কী হবে, এমনকি এই ইন্টারনেটে শুভেচ্ছা জানানোর যুগেও জন্মদিনের কার্ডের ব্যবসা কিন্তু এখনো জমজমাট।
আমাদের এই বাংলাদেশে ঘটা করে জন্মদিন পালনের চল খুব পুরোনো নয়। আর আগে জন্মদিন পালন হতো নামীদামি কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদের। পরবর্তী সময়ে বাবা-মায়েরা তাঁদের বাচ্চাদের জন্মদিন পালন আরম্ভ করেন, তা-ও একদম ঘরোয়া কায়দায়। বাচ্চারা শিশু থেকে বালক হয়ে উঠলেই আর জন্মদিন আলাদা করে পালন করা হয়ে উঠত না। পরবর্তী সময়ে দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নতির পাশাপাশি অনেক সংস্কৃতির প্রভাবে মধ্যবিত্তরাও জন্মদিন পালন করা আরম্ভ করে।
কোনো কোনো স্কুলে বাচ্চারা জন্মদিনের পরদিন চকলেট নিয়ে যায়—বিলায় বন্ধুদের মাঝে। যারা টিনএজার তারা বন্ধুরা মিলে জন্মদিনের আয়োজন করতে ভালোবাসে কোনো ফাস্ট ফুডের দোকানে। উপহার হিসেবে চকলেট, টি-শার্ট, ডিভিডি, কফিমগ, ফটোফ্রেম ও বইয়ের চল আছে। আমাদের খুব প্রিয় লেখক প্রয়াত হুমায়ূন আহমদের জন্মদিনে তাঁর সৃষ্ট চরিত্র হিমুর অনুকরণে হলুদ পাঞ্জাবি কিংবা টি-শার্ট পরা তরুণ ভক্তদের বিচিত্র সব আয়োজন রীতিমতো আলোচনার বিষয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮০ বছরের জীবনের প্রথম অর্ধেক তেমন জাঁকজমক করে জন্মদিন পালন করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে বেশ ঢাকঢোল পিটিয়েই তাঁর জন্মদিন আয়োজন করা হলো। সেই আয়োজনকে কেন্দ্র করে রবিঠাকুর অনেক কবিতা লিখেছেন, দিয়েছেন ভাষণ। রবিঠাকুরের জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখের মতোই, আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনও পালিত হয় বেশ ঘটা করে। এ ছাড়া আরও অনেক বিখ্যাত মানুষের জন্মদিন আমরা এখন স্মরণ করি শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়।
একসময় ঘরে তৈরি পায়েস, পোলাও, কেক, মিষ্টি—এসবই ছিল জন্মদিনের খাবার। এখন সেখানে কেক থাকা চাই-ই। আর কিশোর তরুণেরা বাসায় তৈরি খাবারের চেয়ে দোকানের ফ্রায়েড চিকেন, কেক, পিৎজা দিয়েই জন্মদিন উদ্যাপন করতে ভালোবাসে। সময়ের সঙ্গে এভাবে বদলেছে আমাদের জন্মদিন-সংস্কৃতিও।
জাঁকজমক করে জন্মদিন পালনে অনেকেই আগ্রহী। যেমন ব্রুনাইয়ের সুলতানের ১৯৯৬ সালে ৫০তম জন্মদিনে খরচ ২৭ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ২১২ কোটি টাকা! ওই জন্মদিনে মাইকেল জ্যাকসনের কনসার্টও ছিল! যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাবামায় ১৯৮৯ সালে ফোর্ট পেইনের শততম জন্মদিনে কাটা হয় ১ লাখ ২৮ হাজার ২৩৮ পাউন্ডের একটি কেক, যেখানে আমরা সাধারণত জন্মদিনে কাটি ২ থেকে ৪ পাউন্ডের কেক! ওই দিন এটাই ছিল বিশ্ব রেকর্ড। কিন্তু এই ঘটনার বছর দশেক পরেই রেকর্ডটিও ভেঙে যায়। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের লাসভেগাস শহরের শততম জন্মদিনে ২০০৫ সালে কাটা হয় ১ লাখ ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের একটি কেক!
জন্মদিন উৎসবে রীতিমতো আন্তর্জাতিক বাধ্যতামূলক সংগীতই বলা যায় ইংরেজি গান ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ গানটিকে। এই গানের সূচনাটা ১৮৯৩ সালে। আমেরিকার কেন্টাকির কিন্ডারগার্টেনশিক্ষক প্যাটি স্মিথ হিল এবং তাঁর বোন পিয়ানোবাদক ও সুরকার মিলড্রেড জেন হিল—এই দুজন মিলে নিচের গানটি তৈরি করেন—
‘গুড মর্নিং টু ইউ,
গুড মর্নিং টু ইউ,
গুড মর্নিং, ডিয়ার চিলড্রেন,
গুড মর্নিং টু হাল।’
স্কুলের বাচ্চাদের গান হিসেবে এর জন্ম। পরবর্তী সময়ে ঠিক কবে যে এর কথায় একটু অদলবদল ঘটিয়ে জন্মদিন যোগ হয়, তার সঠিক ইতিহাস জানে না কেউ। তবে ১৯২৪ সালে রবার্ট কোলম্যানের প্রকাশিত ‘সংবুক’—এ কথার বদলকৃত রূপটি ছাপার অক্ষরে স্থান পায় প্রথমবার—
‘হ্যাপি বার্থডে টু ইড,
হ্যাপি বার্থডে টু ইউ,
হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার (ধরা যাক, কিশোর আলো),
হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।’
মিস্টার বিনের ওই পর্বটির কথা মনে আছে—যেখানে মিস্টার বিন নিজেই নিজেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা কার্ড পাঠায় এবং সেটা হাতে নিয়ে দারুণ খুশি হয়? ব্যাপারটি হাস্যকর সন্দেহ নেই, কিন্তু একই সঙ্গে ভারি বিষাদেরও। কারণ, মিস্টার বিনের কোনো স্বজন, বন্ধু ছিল না—যারা তার জন্মদিনটি মনে রেখে শুভেচ্ছা জানাবে। এটাও সত্যি দুনিয়ায় এমন মানুষ অনেক—যাদের জন্মদিন পালন করার সাধ্য নেই কিংবা জন্মদিনের দিনটি কাটছে কোনো বিপদের মধ্য দিয়ে, কিংবা মিস্টার বিনের মতোই তাদের জন্মদিনটি মনে রাখার মতোই নেই কেউ। আবার অনেকেই আছে যাদের জন্মটা ঘটে এতটা অবহেলার মধ্য দিয়ে যে তার জন্মদিন যে কবে, সেই তারিখটাও মনে রাখে না কেউ—পরবর্তী সময়ে কোনো একটা কাল্পনিক তারিখকে জন্মদিন হিসেবে ধরে নানান ফরম পূরণ করতে হয়। ওই সব মানুষদের কোনো একজনকেও যদি আমরা হৃদয়ের ভেতর থেকে বলতে পারি, ‘শুভ জন্মদিন’—বিশ্বাস করো, তার চেয়ে আনন্দময় জন্মদিন খুব কমই উদ্যাপন করা হবে এই দুনিয়ায়। বিশ্ব রেকর্ড করা কেক দিয়েও এর চেয়ে বেশি নির্মল আনন্দ পাওয়া সম্ভব নয়!