জুলিয়াস সিজার অপহরণ

রোমকে সাম্রাজ্যবাদের দিকে এগিয়ে নিয়েছিলেন গায়াস জুলিয়াস সিজার। ইতিহাসে তিনি জুলিয়াস সিজার নামেই বিখ্যাত। তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ, সেনানায়ক, রাষ্ট্রপ্রধান, ও লেখক। এই সিজারের ভাগ্যেই ঘটেছিল মজার এক ঘটনা।

৭৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। খবর এল রোমে মারা গেছেন লুসিয়াস করনিলিয়াস সুলা। রোমের এই শাসক ছিলেন সিজারের পারিবারিক শত্রু। তাঁর হাত থেকে বাঁচতে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে রোম ছেড়েছিলেন তিনি। কিন্তু সুলা না থাকায় রোমে ফিরতে আর বাধা রইল না সিজারের। রোমে এসে শুরু করলেন ওকালতি। উচ্চকণ্ঠস্বর আর বাগ্মিতার কারণে অল্প সময়েই সবার নজর কাড়েন সিজার। এভাবে কেটে গেল তিন বছর। সময়টা ৭৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। সিজারের বয়স ২৫ বছর। গ্রিসের রোডস দ্বীপে যাওয়ার জন্য এজিয়ান সাগর পাড়ি দিচ্ছিলেন তিনি। সাগরের দুপাশে গ্রিস আর তুরস্ক। রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। সুন্দর বাতাসও বইছে। নাবিকদের উত্তেজিত কথা শুনে ঘর ছেড়ে বের হলেন সিজার। ডেকে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল একটা জাহাজ। বেশি দূরে না ওটা। পরে বোঝা গেল, ওটা সিসিলিসিয়ান জলদুস্যদের জাহাজ! এদের ভয়ে ভূমধ্যসাগরে জাহাজগুলো বেশ সাবধানে থাকে। এখনকার তুরস্কে ছিল সিলিসিয়ানদের দেশ। এ দেশের বেশির ভাগ লোকই জলদুস্য। এদের তেমন ঘাঁটায় না রোমানরা। কারণ লুট করা অন্য সম্পদের সঙ্গে আক্রান্ত জাহাজের লোকদের দাস হিসেবে বিক্রি করে জলদুস্যরা। চাষাবাদের জন্য এ দাসদের কেনে রোমানরা।

এরা আবার কী চায় এ জাহাজে? এটা যে রোমানদের জাহাজ স্পষ্ট উল্লেখ আছে জাহাজের পতাকায়। তাহলে? ভাবতে ভাবতে জলদুস্যদের জাহাজটা চলে এল সিজারের জাহাজের কাছে। কিছু বোঝার আগেই আক্রমণও করল জলদস্যুরা। সিজার ভড়কালেন না। ভয়ের থেকে কৌতূহলই বেশি তাঁর। ব্যাটারা চায়টা কী? নিজের লোকদের বললেন বাধা না দিতে। নির্দেশ দিয়ে সমুদ্রের আরামদায়ক হাওয়া উপভোগ করতে লাগলেন সিজার। কিছুক্ষণ পর শোরগোল তুলে সিজারের সামনে হাজির হলো দস্যুপ্রধান। হোঁত্কা চেহারা। মুখে গাল থেকে চিবুক পর্যন্ত কাটা দাগ। বোঝাই যাচ্ছে কোনো এক লড়াইয়ের স্মৃতিচিহ্ন। দাঁতের অবস্থাও ভালো না। সামনে এসে বলে বসল, ‘কী আছে বের করো!’ লোকটাকে দেখে সিজার বুঝলেন ব্যাটা অল্পতে অধৈর্য্য হয়ে পড়ে। দেখই না কী ঘন ঘন ডান পাটা জাহাজের পাটাতনে ঠুকছে! একে নিয়ে খেলতে বেশ মজাই হবে, ‘আমাকে দেখে কি তোমার ব্যবসায়ী মনে হচ্ছে?’ এ প্রশ্নে একটু হকচকিত মনে হলো জলদুস্যপ্রধানের। চেহারা ফুটল দ্বিধা।

সভাসদ বেষ্টিত সম্রাট জুলিয়াস সিজার

এরপর আবার জেঁকে বসল বিস্ময় যখন তার এক শাগরেদ এসে জানাল পুরো জাহাজ তন্ন তন্ন করেও কোথাও কোনো পণ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। ‘ঠিক আছে। লুট করার মতো জিনিস নেই তো কী হয়েছে? আপনাকেই জিম্মি করা হবে। মুক্তিপণ দিতে হবে ৬২০ কেজি রূপা!’, বলেই অট্টহাসি দিল সে। কিন্তু তাতে তেমন ভাবান্তর হলো না সিজারের, ঠোঁট উল্টে বললেন, ‘মাত্র ৬২০ কেজি? আমাকে তুমি কী মনে করো? আমার বিনিময়ে এত অল্প মুক্তিপণ?’ বিস্ময় ভর করল দুস্য সরদারের চোখমুখে। শেষে বলেই ফেলল, ‘মানে?’ সিজার বললেন, ‘মানে হচ্ছে এত অল্প মুক্তিপণ আমার নামের সঙ্গে যায় না। বরং মুক্তিপণ হিসেবে তুমি ১ হাজার ৫৫০ কেজি রুপা চাও!’ সিজারের কঠিন চেহারায় কৌতুকের চিহ্ন খুেঁজ পেল না সরদার, ‘ঠিক আছে। আপনি দিতে পারলে তো আমাদের সমস্যা নাই। ১ হাজার ৫৫০ কেজি রূপাই সই!’ ‘তবে এক শর্তে। আমার সঙ্গী-সাথিদের ছেড়ে দিতে হবে। আমার সঙ্গে থাকবে দুই ভৃত্য আর এক বন্ধু।’ সিজারের প্রস্তাবে সরদার এক কথাতেই রাজি।

নিজের লোকদের বুঝিয়ে দিলেন রোমের বিভিন্ন শহর থেকে তাঁর কথা বলে মুক্তিপণ জোগাড়ের জন্য। ৩৮ দিন লেগেছিল সিজারের সেই মুক্তিপণ আসতে। পুরো সময়টা জলদুস্যদের সঙ্গে থেকেছেন সিজার। তবে বন্দী হিসেবে নয়। নিজের ব্যক্তিত্বের জন্যই হোক আর এত বিশাল মুক্তিপণের লোভেই হোক জলদস্যুরা বেশ সমঝেই চলেছিল তাঁকে। সিজার বলে দিয়েছিলেন ঘুমানোর সময় তাঁকে বিরক্ত করা যাবে না। ওই সময় কোনো কথা বলতে চাইলে তাঁর থেকে দূরে গিয়ে কথা বলতে হবে। জলদস্যুদের সঙ্গে অনুশীলন বা খেলাধুলা করতেন সিজার। কখনো কবিতা আর বক্তৃতা লিখে পড়ে শোনাতেন জলদস্যুদের। তারা এসব বুঝত না। ফলে প্রায়ই খেপে যেতেন সিজার। মুখের ওপর তাদের ‘অশিক্ষিত’ বলে বসতেন। এ জন্য তাদের ফাঁসি দেওয়ার হুমকিও দিতেন সিজার। জলদস্যুরা এসব হেসেই উড়িয়ে দিত।

একসময় মুক্তিপণ এল। মুক্তি পেলেন সিজার। এরপর সিজার কিছু জাহাজ আর সেনা নিয়ে সেই জলদস্যুদের ধরতে ছুটলেন। দস্যুরা প্রাচীন গ্রিক দ্বীপ শহর মিলেতাসে সময় কাটাচ্ছিল। সেখানে তাদের আক্রমণ করেন সিজার। উদ্ধার করলেন মুক্তিপণের রুপা। জলদস্যুদের হত্যা করলেন ক্রুশবিদ্ধ করে। শেষমেশ সিজারের হুমকিই সত্য হলো।