টাকার রাজ্যে রাজ্যের টাকা
ব্যাট কেনার টাকা চাইতেই মা ঝাড়ি দিয়ে বলল, ‘আমার কি টাকার গাছ আছে? কদিন পর পর টাকা চাইবি আর আমি গাছ থেকে পেড়ে দেব? যা ভাগ!’ মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এমন সময় বন্ধু পাভেলের ফোন—
দোস্ত, চল ঘুরে আসি।
না। টাকা নাই।
আরে, টাকা লাগবে না। যেখানে যাব, সেখানে ঘরভর্তি টাকা। এমনকি টাকার গাছও আছে। বের হ।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। পাভেল মজা করছে। চেহারায় কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন কি হয়েছে? তা না হলে সর্বস্তরের মানুষ আমার সঙ্গে মজা নেবে কেন? তবু বের হলাম। পাভেল আমাকে নিয়ে মিরপুর ২ নম্বরের দিকে রওনা দিল। অবাক হলাম না। ও দুই নম্বর মানুষ, দুই নম্বরের দিকে যাবে, এতে অবাক হওয়ার কী আছে? বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমির সামনে রিকশা থামতেই দেখি বড় করে লেখা ‘টাকা জাদুঘর’। টাকার আবার জাদুঘর হয় নাকি? তা ছাড়া আমার কাছে তো টাকাই নাই। পাভেল অভয় দিল, টাকা জাদুঘরে ঢুকতে কোনো টাকা লাগে না।

ঢুকতেই চোখে পড়ল বিশাল টাকার গাছ! গাছের ডালপালায় টাকাও ঝুলে আছে। কিন্তু ঝাঁকি দিলে যেমন গাছ থেকে আম পড়ে, টাকার গাছ থেকে টাকা পড়বে না। কারণ, এটা একটা ভাস্কর্য, আর গাছের ডালে সব টাকার রেপ্লিকা। আমি আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। গাছের টাকাগুলো সত্যি হলে কী এমন ক্ষতি হতো?
জাদুঘরটা বেশ সাজানো-গোছানো। চারদিকে গাছপালা। দ্বিতীয় তলায় দুটো গ্যালারিতে সাজানো হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত টাকা জাদুঘর। গ্যালারি ১-এ ঢুকতেই দেখি রুপার মুদ্রা সাজানো আছে। যিশু খ্িরষ্টের জন্মের প্রায় ৬০০ বছর আগের মুদ্রা! তার মানে, যিশু খ্রিষ্টের জন্মের ৬০০ বছর আগেও বাংলায় রুপার মুদ্রা ছিল! সবই ছাপাঙ্কিত মুদ্রা। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, মুদ্রাগুলোর ওপরে ছাপ দিয়ে আঁকা আছে নানা রকম ছবি। কিন্তু সেই আমলে রুপার মুদ্রায় কীভাবে ছবি আঁকা হয়েছিল, তা এক রহস্য!

এভাবেই পর্যায়ক্রমে সাজানো আছে গুপ্তযুগ, হরিকেল, ইন্দো পার্থিয়ান, ইন্দো গ্রিক, কুষাণ, সুলতানি, মুঘল আমলের মুদ্রা। মুদ্রাগুলো দেখলেই বোঝা যায় ইতিহাসের পট পরিবর্তন। যেমন, খ্িরষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মানুষ সূর্যের উপাসনা করত। সে সময়কার মুদ্রাগুলোতে ছিল সূর্যের ছবি। আবার সুলতানি আমল থেকে এ অঞ্চলে শুরু হয় মুসলিম শাষণ। সে সময় মুদ্রার গায়ে ছিল আরবি লেখা। আর বাংলা লেখা-সংবলিত মুদ্রা চালু হয় সম্রাট শাহ আলমের আমলে। সেই মুদ্রাটিও আছে টাকার জাদুঘরে।
শুধু মুদ্রাই নয়, জাদুঘরে আছে পুরোনো কাগজের নোটও। কাগজের নোট প্রথম চালু করেছিল ব্রিটিশরা। সেই আমলের কাগজের নোট, মুদ্রা—সবই আছে জাদুঘরে। আছে পাকিস্তান আমলের নোট, কয়েনও। এক পাশে গিয়ে দেখি বন্ড। জেমস বন্ড নয়, পাকিস্তান আমলের প্রাইজবন্ড। তার পাশেই আছে যুগোস্লাভিয়া, চেকোস্লোভাকিয়ার মতো লুপ্ত দেশগুলোর টাকা। আছে রাশিয়ার তৈরি বিশ্বের সবচেয়ে বড় নোট। তাই বলে ছোটদের অবহেলা করা হয়নি। জার্মানির তৈরি বিশ্বের সবচেয়ে ছোট নোটটিও আছে এখানে। অনেকেই বলে, চীনারা নাকি লম্বা হয় না। কিন্তু জাদুঘরে আছে চীনের লম্বা লম্বা কয়েকটি নোটও। আর বাংলাদেশের শুরু থেকে এ পর্যন্ত আসা সব নোট তো আছেই, আছে ২৫ টাকা, ৬০ টাকার স্মারক নোট, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্গবন্ধু, বীরশ্রেষ্ঠদের ছবি-সংবলিত স্মারক কয়েনসহ অনেক স্মারক মুদ্রা। গ্যালারি ১-এ মূলত প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বাংলার টাকার বিবর্তন তুলে ধরা হয়েছে।

গ্যালারি ২-এ যাওয়ার পথে দেখি বড় এক লোহার সিন্দুক। ব্রিটিশ আমলের এই সিন্দুকটির ওজন আট মণ! ব্রিটিশ আমলের চোর-ডাকাতদের জন্য মায়াই হলো আমার। পাশেই আছে কিছু কাঠের সিন্দুক। সেগুলোর ওজনও কম নয়।
দ্বিতীয় গ্যালারিটি সাজানো হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টাকা আর মুদ্রা দিয়ে। এখানেই আমরা দেখলাম আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার সোনার ডলার, থাইল্যান্ডের সোনার নোট। দেখে মনে হলো, কদিন ধরে আমাদের বিমানবন্দরগুলোতে যে পরিমাণ সোনা উদ্ধার হচ্ছে, সেগুলো দিয়ে নোট বানানো যেতে পারে।
বিশ্বের যতগুলো দেশে টাকা আছে, ততগুলো দেশের টাকাই আছে এই গ্যালারিতে। সেনাশাসকের ছবি-সংবলিত টাকা যেমন আছে, তেমনি আছে বিপ্লবী চে গুয়েভারার ছবি-সংবলিত টাকাও। চারদিকে শুধু টাকা আর টাকা। কিন্তু হাত দিয়ে ধরার উপায় নেই। কাছে থেকেও টাকাগুলো কত দূরে! পরিস্থিতি বুঝেই বোধহয় জাদুঘরের স্পিকারে বাজছিল পুরোনো দিনের সেই গান—তুমি আজ কত দূরে...!

২০১৩ সালের এপ্রিলে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করা এই টাকার জাদুঘরে সংরক্ষিত মুদ্রা ও টাকার সংখ্যা প্রায় চার হাজার। জাদুঘরে আছে ডিজিটাল কিয়স্ক। হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখার পাশাপাশি চাইলে ডিজিটাল কিয়স্কে ক্লিক করেও দেখা যাবে সবগুলো টাকা, মুদ্রার ছবি আর তথ্য। দ্বিতীয় গ্যালারিতে আছে ফটো কিয়স্ক। এখানে এক লাখ টাকার স্যুভেনির নোটে নিজের ছবি বসিয়ে প্রিন্ট করা যায়। এক লাখ টাকার এই নোটের দাম মাত্র ৫০ টাকা! আরও আছে একটা গোছানো গিফট শপ, যেখানে বাংলাদেশের স্মারক টাকা, মুদ্রাগুলো কেনা যাবে। আমরা ২৫ টাকার স্মারক নোটটা কিনে ফেললাম। কেনা যাবে মুদ্রাবিষয়ক বইও। জাদুঘরের দুটি গ্যালারিতেই আছে এলসিডি স্ক্রিন আর প্রজেক্টর। জাদুঘর কতৃর্পক্ষের সঙ্গে কথা বলে স্কুল থেকে দলবেঁধে শিক্ষার্থীরা এলে প্রজেক্টরে দেখানো হবে টাকা এবং স্কুল ব্যাংকিং-বিষয়ক ডকুমেন্টারি। টাকার সমৃদ্ধ ইতিহাস আর বিবর্তন সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানাতেই টাকা জাদুঘরের এমন উদ্যোগ।
টাকার রাজ্যে অনেকক্ষণ ঘুরে আমরা বাড়ির পথ ধরলাম। দুজনের হাতেই এক লাখ টাকার নোট। ভাবতেই নিজেদের লাখপতি মনে হচ্ছে। আগে লাখপতি হলেই মানুষ বাড়িতে লাখের বাতি জ্বালাত। আমরাও বাতি জ্বালাব কি না, ভাবছি। তোমরাও টাকা জাদুঘরে গিয়ে লাখপতি হয়ে যাও। তবে বৃহস্পতিবার যেও না, ওই দিন জাদুঘর বন্ধ। এমনিতে শনি থেকে বুধবার জাদুঘর খোলা থাকে বেলা ১১টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। শুধু শুক্রবার খোলা থাকে বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। হারিয়ে যাও টাকার রাজ্যে।
কৃতজ্ঞতা: মো. মহসিন মিয়া, ভারপ্রাপ্ত কিউরেটর এবং খন্দকার আনোয়ার শাহাদাত, উপপরিচালক, টাকা জাদুঘর।