যখন আরেকটু ছোট ছিলাম, মানে তোমাদের চেয়ে আরেকটু বড় (মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়কার কথা বলছি), জীবাণুতত্ত্ব নিয়ে পড়ানোর সময় খুব প্রিয় একজন অধ্যাপক বলেছিলেন ক্ষুদ্রকায় জীবাণুদের বড় কিছু করার শক্তিমত্তার কথা। আজকের পৃথিবী কেমন এই ছোট ছোট জীবের (অণুজীব) হাতে পরাস্ত হচ্ছে দেখো। রোগের প্রকোপ তো সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে তোমাদের অজানা নয়। তবে কেমন করে জীবাণুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হতে হবে আমাদের, তা তোমাদের জানা আছে তো?
স্বাস্থ্যসচেতনতার সাধারণ নিয়ম, যেগুলো মেনে চলতে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয় না, সেগুলোই কিন্তু বাঁচাতে পারে আমাদের। অভ্যাসে দাঁড় করিয়ে ফেলতে হবে এই সাধারণ নিয়মগুলোকেই। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সত্যিকার অর্থে আতঙ্কে দিন কাটানোর মতো কিছু হয়নি। অথচ দেশের অধিকাংশ মানুষই ভুগছে আতঙ্কে। সুস্থ থাকতে হলে একে মোকাবিলা করার সঠিক প্রস্তুতি নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা-জমায়েতের সুযোগ কম। বন্ধুদের সঙ্গেই তো আমরা বিপদ-আপদে আলোচনা করি। এখন সবার সঙ্গে সরাসরি আলাপেও এসেছে নিষেধাজ্ঞা। এই নিয়ে তোমাদের বুঝি মনও খারাপ হচ্ছে? এদিকে কত ‘প্ল্যান’ যে ভেস্তে গেল! ভিড় এড়িয়ে চলতে বলা হচ্ছে। তবে কেন এত নিয়মকানুন, জানো? জানলে কিন্তু তোমরাও আরও ভালোমতো বুঝতে পারবে এর গুরুত্ব। মন খারাপ না করে, ভয় না পেয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে পারবে পুরো পরিস্থিতি।
অণুজীবের সঙ্গে পরিচয়
করোনাভাইরাস। একটা অণুজীব, না জীব, না জড়। কিছু কিছু ভাইরাসের এমন বৈশিষ্ট্য থাকে, যাতে তারা নিজেদের প্রয়োজনে কোনো একসময় নিজেদের ধরনধারণ বদলে ফেলতে পারে। করোনাভাইরাস এমনই এক ভাইরাস। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে এমনই এক বিশেষ ধরনের করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এই বিশেষ জীবাণুটি দ্বারা যে রোগ হচ্ছে, তাকে বলা হচ্ছে করোনাভাইরাস ডিজিজ ১৯ বা সংক্ষেপে কোভিড-১৯। জীবাণুটি ছড়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে। মূলত তাঁর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। তাই বলে আবার ভেবে বসো না যেন, বাতাসই এই রোগের বাহক। মনে করো, আক্রান্ত এক ব্যক্তি এমনভাবে হাঁচি দিলেন, যাতে তাঁর মুখ থেকে ভাইরাস এল একটা টেবিলের ওপর। এরপর তুমি ওই টেবিলটা কোনো কারণে স্পর্শ করলে। তাহলে কী হবে? ভাইরাস তোমার হাতে চলে আসবে। এখন এই হাত না ধুয়ে যদি তুমি তোমার চোখ-নাক-মুখ স্পর্শ করো, তাহলে তোমার হাত থেকে ভাইরাস ঢুকে যাবে তোমার শরীরে। ভাইরাসের তো পোয়াবারো। তোমার দেহে দিব্যি ঢুকে পড়ল। এরপর তোমার শরীরে এই জীবাণুর কারণে যখন রোগের লক্ষণ দেখা দেবে (যেমন- জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট) তখন না হয় তুমি গেলে একজন চিকিৎসকের কাছে। তবে লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগে থেকেই কিন্তু তোমার আশপাশের মানুষদের মাঝে তোমার মাধ্যমে এই রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ তো গেল একটা উদাহরণ। এভাবে যে কারও মাধ্যমেই কিন্তু রোগটা ছড়াতে পারে। আর ওই যে টেবিলের কথাটা বললাম, এ রকম যেকোনো জিনিসের মাধ্যমেই কিন্তু ভাইরাসটা ছড়াতে পারে। জানা গেছে, কিছু কিছু জিনিসের ওপর ভাইরাসটি ৯ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। তবে দারুণ ব্যাপার হলো, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে সাবান খুবই কার্যকর।
গড়ব প্রতিরোধ
করোনাভাইরাসের কারণে হওয়া রোগ যতটা কঠিন, একে প্রতিরোধের উপায় কিন্তু ততটাই সহজ। ওই যে বললাম, অভ্যাস করে নিতে হবে। ব্যস, আর কোনো ভয় নেই। সবাইকেই মানতে হবে এসব নিয়ম। তাই যাঁরা সঠিক নিয়মকানুন জানেন না, যাঁদের কাছে এই জ্ঞান এখনো পৌঁছেনি, তাঁদের সবাইকে সবটা জানানোও তোমাদের দায়িত্ব। হয়তো তোমার বাবা-মাকে বাড়িতে কাজকর্মে একজন সাহায্য করেন, তুমি তাঁকে জানাবে এই রোগ সম্পর্কে, রোগ প্রতিরোধের নিয়মকানুন সম্পর্কে। এতে তিনিও নিরাপদ থাকবেন, আবার তাঁর কারণে তোমরাও আক্রান্ত হবে না। হয়তো তাঁর পরিবারেও আছে তোমার বয়সী এক শিশু বা কিশোর, তারও যে ঠিক সেই বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে, তা-ও ভুলে গেলে চলবে না কিন্তু। একে বলে সামাজিক দায়িত্ব। তোমার বয়সে তুমি এমন একটা বিশাল দায়িত্ব পালন করতে পারছ, এই ভাবনাটাই মন ভরে দেবে। তাই না?
ঘরে সুরক্ষা, ঘরের সুরক্ষা
এই সময়টায় ঘরে থাকাই নিরাপদ। ভাবছো তো, বাবা যে তবে অফিসে গেলেন? আসলে একেবারে বাইরে না গিয়ে যদি দিন যাপন করা সম্ভব হয়, তাহলে তা-ই করতে হবে এই সময়। নিতান্ত তা সম্ভব না হলে কেবল তবেই বাইরে যাওয়া উচিত। যে বাইরে যাচ্ছে, তাকে কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে -
l ভিড় যেখানে, সেসব জায়গা এড়িয়ে চলাই উচিত।
l সিঁড়ির রেলিং, ঘরের বাইরের কোনো দেয়াল, দরজা, লিফটের ভেতরের অংশ প্রভৃতি পারতপক্ষে স্পর্শ না করাই ভালো।
l ঘরের বাইরে থাকাকালীন মুঠোফোন, ইয়ারফোন, ল্যাপটপ কম্পিউটার প্রভৃতি এমন কোথাও রাখা ঠিক নয়, যেখানে অনেক মানুষ হাত রাখে।
বাইরে থেকে ফিরে জুতা খুলে রাখো বাইরেই। ঘরে ঢুকে সাবান দিয়ে হাত তো ধুতেই হবে, সম্ভব হলে বাইরের পোশাক ছেড়ে ফেলে সাবান দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে এবং সাবান দিয়ে গোসল করে ফেলতে হবে। অলসতা না করে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে জীবাণুমুক্ত করার কাজটা সেরে ফেলা উচিত। জানোই তো, স্বাস্থ্যকে বলা হয় সম্পদ। স্বাস্থ্য যে সময়ের চেয়েও দামি। বাড়িতে পোষা প্রাণী থাকলে তাকে বাইরে যেতে দিও না, কেমন? ও তো আর তোমার মতো করে হাত ধুতে শিখে নিতে পারবে না। আর বাড়িতে যেসব জায়গা প্রায়শই স্পর্শ করা হয়, সেগুলোও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে (জীবাণুনাশক দ্রবণ কাজে লাগানো যায়)।
হাত নিয়ে আরও কথা
- কখন হাত ধোবে, তা জানো তো? খাওয়ার আগে কিংবা খাবার প্রস্তুত করা ও পরিবেশনের আগে তো বটেই। হাত ধুতে হবে, যদি তুমি হাঁচি বা কাশি চাপতে হাত ব্যবহার করে ফেলো। হাত ধুয়ে নাও বাড়ির পোষা প্রাণীটাকে স্পর্শ করার আগে ও পরে। ওর খাবার আর বর্জ্য সংক্রান্ত কাজ করার আগে আর পরেও। এতে ও নিরাপদ থাকবে, আর তুমিও।
- অন্তত ২০ সেকেন্ড সময় দিতে হবে প্রতিবার হাত ধুতে। করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে হাত ধোয়ার জন্য ক্ষারীয় সাবান বেছে নেওয়া ভালো। তবে সাবান না পেলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে সাবান ব্যবহারের নিয়ম অনুসারেই।
- হাত পরিষ্কার করে চট করে মুঠোফোন, টেলিভিশনের রিমোট কন্ট্রোলার বা এ ধরনের অন্য কিছু স্পর্শ করা যাবে না কিন্তু। এ ধরনের বস্তু হলো জীবাণুর আবাস। তাই এগুলো ধরলে আবার হাত ধুতে হবে-মনে রেখো। জীবাণুমাখা হাত চোখে-নাকে-মুখে দেওয়া যাবে না, তা তো তোমরা এরই মধ্যে জেনে গিয়েছো।
আরও যা জানতে হবে, মানতে হবে
l হাঁচি-কাশির সময় টিস্যু দিয়ে নাক-মুখ ঢাকতে হবে। চট করে এগুলো না পেলে কনুই বা বাহুকে কাজে লাগাও।
l কারও সঙ্গে দেখা হলে হাত মেলানো যাবে না, তাকে জড়িয়ে ধরা যাবে না।
l হাঁচি-কাশি বা জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে অন্তত ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে।
l নিজের জ্বর, হাঁচি-কাশি হলে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
l প্রাণিজ পণ্য ভালোভাবে রান্না না করে খাওয়া যাবে না।
করোনা নিয়ে জানার পর
মোটামুটি জানা তো হলো। এবার জ্ঞানটাকে কাজে লাগানোর পালা। মনে থাকবে তো সব? আর একটা কথা বলে রাখি। এই রোগে কেউ আক্রান্ত হলে সেটাকে তোমরা যেন খারাপ চোখে দেখো না। সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর যখন তাঁর থেকে আর রোগ ছড়ানোর ভয়ও থাকবে না, তিনি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন।
এই কটা দিন হুট করে তো ছুটি পেয়েই গেলে। সময়টা বাসাতেই কাটাও। আর একদম নিজের মতো করে আনন্দে থাকো। বাড়িতে বসে ভালো লাগার কাজগুলো চর্চা করো। বই পড়ো, আবৃত্তি শোনো, ছবি আঁকো, গল্প লেখো-যা মন চায়। শুধু সুঅভ্যাসগুলো মাথায় রেখো। ভাইরাস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানাবিধ ভুল তথ্য ভেসে বেড়াচ্ছে। এসবে বিভ্রান্ত হয়ো না। ও, ভালো কথা। ‘কিশোর আলো’টাও কিন্তু বাইরে থেকে এল। এটা পড়া শেষে নিয়মমতো হাত ধুয়ে নিচ্ছো তো?
লেখক : রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার, স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেড, ঢাকা।