মারা গেছেন দারিদ্র্যে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকা

প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকা
উরুগুইয়ের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকা মারা গেছেন। একসময় তিনি ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা। যিনি অস্ত্র ত্যাগ করে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন উরুগুয়ের।অনাড়ম্বর জীবনযাপনের জন্য তিনি 'বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট' উপাধি পান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। কিশোর আলোর জুলাই ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর সাধারণ জীবনযাপনের গল্প। পাঠকের জন্য আবারও সেই লেখা দেওয়া হলো।

বিশ্বকাপের দুই ফেবারিট দল ব্রাজিল আর আর্জেটিনার মাঝখানে স্যান্ডউইচের মতো লটকে আছে ছোট্ট এক দেশ। নাম উরুগুয়ে। যারা ফুটবলের পাঁড় ভক্ত, তাদের অবশ্য দেশটি সম্পর্কে নতুন করে পরিচয় দেওয়ার কিছু নেই। বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম আসরে চ্যাম্পিয়ন দেশ হিসেবে সব্বাই উরুগুয়ের নাম জানে। যারা জানো না, তারা এখনই গুগলমামাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো।

দেশটির রাজধানী মন্টেভিডিও থেকে কয়েক মাইল দূরের এক গ্রামে আছে ছোট্ট এক খামার। শহর ছেড়ে কাদামাটির পথ পেরোলেই সেই গ্রাম, যেখানে বাস করেন ৭৭ বছরের বুড়ো হোসে মুহিকা। অবশ্য খামারটা তাঁর নয়, স্ত্রীর। গ্রামটিতে এখনো বিদ্যুত্ পৌঁছায়নি। আবার জেনারেটর কেনারও সামর্থ্য নেই তাঁদের। তাই কুয়ো থেকে পানি তুলে খান মুহিকা দম্পতি। খামারে স্ত্রীর সঙ্গে জমিতে ফুলের চাষ করে আয় করেন মুহিকা। অনেকে হয়তো ভাবছ, বিশ্বকাপের কথা বলতে গিয়ে বুড়ো মুহিকার গীত গাইছি কেন। আসলে এই বুড়োই হচ্ছেন উরুগুয়ের বর্তমান প্রেসিডেন্ট। রূপকথার মতো এই গল্প শুনে অবিশ্বাসে চোখ ছানাবড়া করে নিশ্চয়ই ভাবছ, এ তো অসম্ভব! কিন্তু অসম্ভবকেই সম্ভব করেছেন হোসে মুহিকা। তাঁকেই বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে গরিব প্রেসিডেন্ট।

রাজনীতিবিদদের প্রচলিত চিত্র হচ্ছে তাঁরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই দূরে থাকেন। নিজেদের জনগণের প্রতিনিধি দাবি করলেও সাধারণের চেয়ে তাঁদের জীবনযাপন আলাদা। অনেকে জনগণের উন্নয়নের ভূরি ভূরি প্রতিশ্রুতি দিয়ে শেষ পর্যন্ত জনগণের সম্পদই লুটেপুটে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠেন। দুর্নীতি, ভোগবিলাসে মত্ত হন কেউ কেউ। এ নিয়ে আমজনতার অসন্তোষের অন্ত নেই। আর দেশের প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট তো অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের ভয়ে কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনীতে ঢাকা এক দুর্গম চিড়িয়াখানায় বন্দী। আমজনতা সেখানে বহুদূরের দর্শক! কিন্তু এসবের পুরোপুরি বিপরীত চরিত্র হোসে মুহিকা।

প্রেসিডেন্টের জন্য রাজধানী মন্টেভিডিওতে এক আলিশান রাজপ্রাসাদ বরাদ্দ। কিন্তু যুগের হিসেবে তাঁকে বোকাই বলতে হবে! কারণ, আগেই বলেছি মনোরম রাজপ্রাসাদ ছেড়ে তিনি থাকেন স্ত্রীর জাঁকজমকহীন বাড়িতে। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বাড়তি কোনো সুবিধা নেননি তিনি। নিরাপত্তার চাদরে মুখ ঢেকে জনগণের কাছ থেকে দূরে সরেও যাননি। খামারবাড়িতে পাহারাদার বলতে দুজন পুলিশ আর ম্যানুয়েলা নামের তিন ঠ্যাংওয়ালা এক কুকুর। ব্যস! খোদ প্রেসিডেন্টের অবস্থা দেখে অনেকে তাঁকে পাগল বলতেও দ্বিধা করেন না। অনেক ভক্ত মুহিকার অবস্থা দেখে কষ্টও পান। কিন্তু বুড়োর ভাষ্য, ‘লোকে আমাকে গরিব প্রেসিডেন্ট বলে। কিন্তু আমি নিজেকে গরিব মনে করি না। যারা শুধু ব্যয়বহুল জীবনযাপনের জন্য সব সময় চেষ্টা করে, আর যারা বেশি বেশি চায়, তারাই আসলে দরিদ্র।’

এই বাড়িতেই থাকেন উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকা

২০১০ সালে রাষ্ট্রীয় নির্দেশে দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, মুহিকার সম্পদ বলতে লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা এক পুরোনো ফক্সভাগেন, যার বাজারমূল্য এক হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার। তবে চলতি বছর সম্পদবিবরণীতে স্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া কিছু জমি, একটা ট্রাক্টর আর একটা বাড়ি যোগ করেছেন মুহিকা। তাতে তাঁর সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১৫ হাজার ডলার। কিন্তু তার পরও সম্পদে দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট আর সাবেক প্রেসিডেন্টের চেয়ে পিছিয়ে আছেন কয়েক গুণ। প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুহিকা বেশ ভালোই বেতন পান। কিন্তু তিনি এমন বোকা কী আর বলব, নিজের বেতনের ৯০ শতাংশই দান করেন জনসেবায়, যার পরিমাণ ১২ হাজার ডলার। বাকি টাকায় তাঁর কোনোমতে চলে পুরো মাস। মুহিকার কথা হচ্ছে, ‘পুরোটাই আসলে স্বাধীনতার ব্যাপার। বেশি সম্পদ না থাকলে সেগুলো টিকিয়ে রাখতে তোমাকে গাধার মতো দিনরাত খাটতেও হবে না। তাতে নিজের জন্য অনেক বেশি সময় পাবে তুমি।’

১৯৬০ সালের দিকে লাতিন আমেরিকাজুড়ে ফিদেল কাস্ত্রো আর চে গুয়েভারার নেতৃত্বে যখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হচ্ছিল, ঠিক সে সময় বামপন্থী এক গেরিলা দলে যোগ দেন মুহিকা। এ অপরাধে তত্কালীন সেনাশাসকের দমনপীড়নের শিকার হন তিনি। সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে ছয়বার গুলি খেয়েছেন মুহিকা। জেলের ঘানিও টেনেছেন ১৪ বছর। সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন এ সময়েই জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণা পাল্টে দিয়েছে বলে জানান তিনি। তবে প্রেসিডেন্ট মুহিকার বিরুদ্ধে কথা বলার লোকেরও অভাব নেই উরুগুয়েতে। তবে এসব থোড়াই কেয়ার করেন তিনি।

উরুগুয়ের আইনানুযায়ী চলতি বছরের নির্বাচনে আর দাঁড়াতে পারবেন না মুহিকা। অবশ্য আরেকবার ক্ষমতার স্বাদ নেওয়ার ইচ্ছেও নেই তাঁর। প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে রাজনীতি থেকেই অবসরের কথা ভাবছেন বোকা বুড়ো মুহিকা। তারপরই নিয়মিত পেনশন পাবেন তিনি। তবে আরাম-আয়েশ আর ভোগবিলাসে অভ্যস্ত অন্য সব সাবেক প্রেসিডেন্টের মতো তাঁকে অবসর জীবনে নতুন বাস্তবতা মেনে নিতে কষ্ট করতে হবে না, এটাই মুহিকার সান্ত্বনা। কারণ, সাধারণ আর সুখী জীবনের মূল সূত্র খুব ভালোভাবেই জানেন তিনি। স্ত্রীর খামারবাড়ির বাগানে পুরোনো আর প্রায় ভাঙাচোরা চেয়ারে বসে মুহিকা বলেন, ‘জীবনের বেশির ভাগ সময় এভাবেই কাটিয়েছি। আমার যা আছে, তাই নিয়েই বাকি জীবন ভালোভাবে থাকতে পারব।’

(বিবিসি ম্যাগাজিন অবলম্বনে)