নভেরায় আশার আলো

নভেরার মাধ্যমে আশার আলো ছড়িয়ে পড়ছে মেয়েদের মধ্যে।

‘আচ্ছা, তোমাকে কে সাইকেল চালানো শিখিয়েছে?’ নারায়ণগঞ্জ শহরের কোনো মেয়েকে যদি এমন প্রশ্ন করা হয়, তবে অধিকাংশেরই উত্তর হবে, ‘নভেরা’। না, নভেরা কারও নাম নয়। নারায়ণগঞ্জ শহরের মেয়েদের সাইক্লিং গ্রুপ ‘নভেরা’। এর আক্ষরিক অর্থ নতুন জন্ম। এই শহরে মেয়েদের সাইক্লিংকে একরকম নতুন জন্ম দিয়েছে নভেরা।

নভেরার শুরু

বেশ কঠিন একটা সময় পার করছিলেন নারায়ণগঞ্জের মেয়ে ফারজানা হোসেন। ঘরবন্দী হয়েই কাটত তাঁর সারা দিন। বিভিন্ন হতাশা আঁকড়ে ধরত তাঁকে। কেন যেন এই সুন্দর পৃথিবীটা হয়ে উঠেছিল অসহনীয়। ২০১৪ সালে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, কঠিন দিনগুলো পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়া দরকার। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে অন্যান্য কাজের পাশাপাশি বন্ধুদের কাছ থেকে সাইকেল চালানো শেখা শুরু করেন। সাইক্লিং শেখার পরপরই নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রধান সড়কগুলো দিয়ে সাইকেল চালাতেন তিনি। কোচিংয়ে ক্লাস নিতে যেতেন সাইকেল চালিয়ে। প্রতিদিন দেখতেন, ছেলেরা দল বেঁধে সাইকেল চালাচ্ছে। সেই থেকে তাঁর মনে হয়, মেয়েরাও সবাই মিলে সাইক্লিং করতে পারে। তার আগে মেয়েদের সাইকেল চালানো শেখাতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই ২০১৭ সালের মার্চ মাসে নভেরার যাত্রা শুরু।

সাইক্লিং দিয়ে হতাশা কাটিয়ে জীবনে ফিরেছিলেন ফারজানা হোসেন। নভেরার মাধ্যমে তিনি আশার আলো ছড়িয়ে দিতে শুরু করলেন মেয়েদের মধ্যে। দু-তিনজন মিলে শুরু করলেন মেয়েদের সাইকেল শেখানো। দ্বিধা, সংকোচ ও ভয় কাটিয়ে অল্প অল্প করে মেয়েরা আসতে শুরু করল সাইকেল চালানো শিখতে। সে ‘অল্প’ সংখ্যাটা এখন অনেকটাই বড়। প্রতি মাসে অন্তত ২০ জন মেয়েকে বিনা মূল্যে সাইকেল চালানো শেখায় নভেরা। মার্চে চার বছর বয়স হবে নভেরার। এই চার বছরে আরও অনেক কিছু করতে শুরু করেছে এই সাইক্লিং গ্রুপ।

নভেরার কার্যক্রম

প্রতি মাসে তিন দিনের একটি কর্মশালার আয়োজন করে নভেরা। রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে আগ্রহী নারীরা সাইকেল শেখার এ কর্মশালায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পান। টানা তিন দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই নিয়মিত কর্মশালা।

প্রতি শুক্রবার নভেরার নিয়মিত কয়েকজন সাইক্লিস্ট মিলে রাইডে বের হন। সাইকেল চালিয়ে ঘুরে আসেন শহরের আশপাশ থেকে। মাঝেমধ্যে সবাই মিলে চলে যান দূরে কোথাও। মাসের শেষ শুক্রবার হয় গেট টুগেদার রাইড। নভেরার সব সাইক্লিস্ট যাঁর যাঁর সাইকেল নিয়ে হাজির হন এই রাইডে। নিয়মিত রাইডগুলোতে থাকে সচেতনতামূলক বার্তা। বড় বড় রাইডে বিভিন্ন বার্তা দিয়ে পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা তৈরি করার চেষ্টা করছে নভেরা।

নিয়মিত রাইডের পাশাপাশি জাতীয় দিবসসহ অন্যান্য বিশেষ দিবসে সাইকেল র‌্যালি আয়োজন করে নভেরা। এ বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শাড়ি পরে নারায়ণগঞ্জ শহরজুড়ে সাইকেল চালিয়েছেন নভেরার মেয়েরা।

কেউ কেউ আবার সাইকেল শেখার পর আর সাইকেল চালানোর সুযোগ পায় না। তবে মেয়েদের সাইকেল শেখার যে বাধা, সেটা তাঁরা ভেঙেছেন। তাঁরাও একদিন মা হবেন, তাঁদের মেয়েরা খুব সহজেই সাইকেল শিখবে, সাইকেল চালাবে। এই বীজ বুনে দেওয়াটা ভালো লাগে, এটাই নভেরাকে এগিয়ে নেয়।
ফারজানা হোসেন, নভেরার প্রতিষ্ঠাতা

নভেরার মানুষেরা

নিয়মিত কর্মশালা পরিচালনার জন্য নভেরার আছে প্রায় ২০ নারী সদস্যের একটি প্রশিক্ষক দল। তাঁদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেই নভেরা থেকে সাইকেল চালানো শিখেছেন। এখন অন্যদের সাইকেল চালানো শেখাচ্ছেন তাঁরা। নভেরার আছে ১৮ সদস্যের একদল স্বেচ্ছাসেবক। সব রাইডের আয়োজন, ফেসবুক গ্রুপ পরিচালনা ও কর্মশালার বিভিন্ন দিক সামলানো তাঁদের দায়িত্ব। ১ হাজার ২০০ সদস্যের একটি ফেসবুক গ্রুপ আছে নভেরার। নারীদের সাইক্লিং ও নভেরার কার্যক্রম নিয়ে সবকিছু হয় এই গ্রুপে। একদম সামনে থেকে নভেরা কারা সামলায়—এই প্রশ্নের জবাবে নভেরার সংগঠক আফরিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা সবাই মিলেই সবকিছু সামলাই। স্বেচ্ছাসেবক দল, প্রশিক্ষক দল, রাইডার—আমরা সবাই মিলেই নভেরা।’

ফারজানা হোসেন।

আরও কথা

নভেরার সবচেয়ে পছন্দের কাজ অন্যের স্বপ্নপূরণ। সাইকেল চালানো শেখা অনেক মেয়ের ছোটবেলার স্বপ্ন। তবে বিভিন্ন কারণে বেশির ভাগ মেয়েরই ছোটবেলায় সাইকেল চালানো শেখা হয়ে ওঠে না। বড় হয়ে সে স্বপ্ন পূরণ করতে চান অনেকেই। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে সাহায্য করে নভেরা। নভেরা চায়, নারায়ণগঞ্জ শহরের মেয়েরা একদিন সাইক্লিংকে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অংশ করে নেবে।

অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও সংগঠনকে এগিয়ে নিচ্ছেন নভেরার প্রতিষ্ঠাতা ফারজানা হোসেন। কিন্তু কীভাবে? তাঁর উত্তর স্পষ্ট, ‘অনেক মেয়ের সাইক্লিং শেখানোর পর হাজার প্রতিকূলতাও তাদের থামাতে পারে না। যে করেই হোক, তারা নিয়মিত রাইডে যায়, সাইক্লিং করে। এসব আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়, সামনে এগিয়ে নেয়। কেউ কেউ আবার সাইকেল শেখার পর আর সাইকেল চালানোর সুযোগ পায় না। তবে মেয়েদের সাইকেল শেখার যে বাধা, সেটা তাঁরা ভেঙেছেন। তাঁরাও একদিন মা হবেন, তাঁদের মেয়েরা খুব সহজেই সাইকেল শিখবে, সাইকেল চালাবে। এই বীজ বুনে দেওয়াটা ভালো লাগে, এটাই নভেরাকে এগিয়ে নেয়।’

নভেরার মতো এমন আরও সংগঠনের এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে সারা দেশের মেয়েরা।