রাঢ়ুলীর জমিদারবাড়ির দোতলায় ঘুম ভাঙার পর ফুলু এই সময়ের জন্য অপেক্ষা করে। কিছুক্ষণের মধ্যে অপেক্ষার অবসান হয় তার। শুনতে পায় একদল ছেলেমেয়ের কলকাকলি। বিছানা ত্যাগ করে নিচে নেমে আসে ফুলু। গিয়ে দাঁড়ায় সদর দরজার সামনে। তাদের বাড়ির সামনের পথ দিয়ে একদল ছেলেমেয়ে হই হই করতে করতে স্কুলের পথে হেঁটে চলেছে। কলকাতায় যাওয়ার আগে ওদের সঙ্গেই স্কুলে যেত ফুলু, মাঠে খেলত। সুযোগ পেলে চলে যেত একটু দূরের কপোতাক্ষ নদে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে আমাশয়ে আক্রান্ত দুর্বল ফুলুর পক্ষে পড়াশোনার চাপ নেওয়া সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য এখন যশোরের (এখন খুলনা) পাইকগাছা থানার রাঢ়ুলী গ্রামের বাড়িতে থাকে সে। মা–বাবা, ভাই-বোন সবাই থাকে কলকাতায়। ছেলেমেয়েরা দৃষ্টির আড়াল হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে তারপর ভেতর বাড়িতে ঢোকে। এখন তার কাজ হলো, দোতলায় কোনার ঘরে বাবার লাইব্রেরিতে চলে যাওয়া। এবার বাড়িতে এসে এই লাইব্রেরি হয়ে উঠেছে তার সময় কাটানোর আশ্রয়।
কয়েক দিন আগে সেখানে স্যার উইলিয়াম স্মিথের Principia Latina-এর খোঁজ পেয়েছে সে। কয়েক পাতা পড়েই বইটার অনেকখানি ‘বুঝিতে পারিয়াছে’ বলে মনে হয়েছে ফুলুর। তাই তার অদম্য ইচ্ছা হলো নিজে নিজে ল্যাটিন ভাষা আয়ত্ত করা। প্রচুর অধ্যবসায়ে সেটিই সে অর্জন করেছে। এরপরই সে জানতে পারে ফরাসি, ইতালিয়ান ও স্প্যানিশ—তিনটি ভাষাই এসেছে মূলত লাতিন থেকে। কাজেই লাতিন শিখতে পারলে বাকি তিনটি ভাষাও শেখা যাবে সহজেই। তাই ফুলু নিজে নিজেই লাতিন ভাষা আয়ত্ত করে ফেলল। সেই সঙ্গে পড়ে ফেলল ইংরেজি সাহিত্যের অনেক বই। লেথব্রিজের Selection from modern English Literature, গোল্ডস্মিথের Vicar of Wakefield–সহ উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের জুলিয়াস সিজার, মার্চেন্ট অব ভেনিস ও হ্যামলেট পড়া হয়ে যায়। এ সময়ে ফুলুর বঙ্গদর্শন, সমাচার দর্পণ ইত্যাদি পত্রিকা পড়ার অভ্যাসও তৈরি হয়ে যায়। সে সময় বঙ্গদর্শন পত্রিকার প্রভাবে যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত আর্যদর্শন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে জন স্টুয়ার্ট মিলের আত্মচরিত–এর অনুবাদ ছাপা হতো। এটি দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে কিশোর ফুলুকে। নিজের আত্মজীবনীতে ফুলুর উপলব্ধি, ‘একটি বিষয় আমি বিশেষভাবে লক্ষ করিলাম। জেমস মিল তাঁহার প্রতিভাশালী পুত্রকে কোনো সাধারণ স্কুলে পাঠান নাই এবং নিজেই তাহার বন্ধু ও শিক্ষক হইয়াছিলেন। অল্প বয়সে জন স্টুয়ার্ট মিলের বুদ্ধিবৃত্তির অসাধারণ বিকাশের ইহাই কারণ বলিয়া মনে করা যাইতে পারে। মাত্র দশ বছর বয়সে জন স্টুয়ার্ট মিল লাতিন ও গ্রিক ভাষা, পাটিগণিত এবং ইংল্যান্ড, স্পেন ও রোমের ইতিহাস শিখিয়া ফেলিয়াছেন।’
শেক্সপিয়ার, এমারসন, কার্লাইল, ডিকেন্সের রচনা, নিউটন, গ্যালিলিও, ফ্রাঙ্কলিনের জীবনী, বাংলা সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি ইচ্ছা খুশি বই পড়ার আনন্দ তার একাকী জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। স্যার উইলিয়াম জোনসের প্রশ্নের উত্তরে জোনসের মায়ের উক্তি ‘পড়িলেই সব জানিতে পারিবে’ কথাটি গভীরভাবে রেখাপাত করে কিশোর ফুলুর মনে।
আর এভাবে কিশোর ফুলুর মনোজগৎ আগামী দিনের একজন বিজ্ঞানী, উদ্যোক্তা ও দেশহিতৈষী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় হিসেবে তৈরি হওয়ার পথনির্দেশ করে। বলা যায়, বাংলার বিজ্ঞানজগতের রেনেসাঁর সূচনা সৃষ্টিকারী এই বিজ্ঞানীর নিজেকে গড়ে তোলার মূলমন্ত্র হয়ে যায়, ‘পড়ো পড়ো পড়ো’।
জন্ম ও বাল্যকাল
১৮৬১ সাল বাঙালির জন্য একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বছর। সেই বছরে ৭ মে (২৫ বৈশাখ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে যে শিশুর জন্ম হয়, কালক্রমে সে হয়ে ওঠে বিশ্বকবি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর এর মাত্র তিন মাসের মধ্যে কলকাতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে যশোরের পাইকগাছায় কপোতাক্ষ নদের পারে প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জন্ম, আগস্টের ২ তারিখে। রবীন্দ্রনাথের হাতে যেমন বাংলার সাহিত্য অঙ্গনের নবযুগের সূচনা, তেমনি প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ও হয়ে উঠেছেন বাংলার বিজ্ঞান ও শিল্প উদ্যোগের পথিকৃৎ প্রধান পুরুষ। বলা যায়, তাঁদের দুজনের হাতেই বাংলার রেনেসাঁর সূচনা।
রাঢ়ুলীর যে জমিদারবাড়িতে প্রফুল্ল চন্দ্রের জন্ম, সেটির পত্তন করেছিলেন তাঁর প্রপিতামহ মানিকলাল রায়। তিনি প্রথমে কৃষ্ণনগর ও পরে যশোরের কালেক্টরের দেওয়ান হন। ‘দেওয়ান’ শব্দটি নানা অর্থে ব্যবহৃত হয়। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন নিমক চৌকীর দেওয়ান। আর মানিকলাল রায়ের ক্ষেত্রে এটি ছিল ইংরেজদের রাজস্ব আদায়ের যে দপ্তর, সেখানকার দেশীয় সর্বোচ্চ পদ। মানিকলাল রায় যে প্রভূত ধন–সম্পত্তি অর্জন করেন, তদীয় পুত্র যশোরের সেরেস্তাদার আনন্দলাল রায় সেটিকে আরও বৃদ্ধি করেন। আনন্দলাল তাঁর পুত্র হরিশচন্দ্র রায়কে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় প্রেরণ করেন। তাঁহার সঙ্গী হন রাঢ়ুলী গ্রামের উত্তর কপোতাক্ষ নদের পারের সাগরদাঁড়ি গ্রামের দেওয়ান রাজনারায়ণ দত্ত ও তাঁর প্রথম পত্নী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান মধুসূদন দত্ত। ১৮৪৩ সালে মধুসূদন দত্ত খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত’ নাম গ্রহণ করেন। এ ঘটনা তাঁর সতীর্থদের পরিবারগুলোয় প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। আনন্দলাল রায় দ্রুত তাঁর পুত্রকে রাঢ়ুলীতে নিয়ে আসেন এবং ভুবনমোহিনী দেবীর সঙ্গে বিবাহে আবদ্ধ করেন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে হরিশচন্দ্রকে সম্পত্তি দেখাশোনার ভার দেন। হরিশচন্দ্র মেধাবী এবং পার্সি, সংস্কৃত ও আরবি ভাষা জানতেন। তিনি দ্রুত নিজ বাড়িতে একটি লাইব্রেরি গড়ে তোলেন। বালক প্রফুল্ল তাঁর কাছেই প্রথম ইয়াংয়ের Night Thoughts, ফ্রান্সিস বেকনের Novum Organum ইত্যাদি বইয়ের নাম শোনেন। তত্ত্ববোধিনী, সমাচার দর্পণ, হিন্দু পত্রিকা, অমৃতবাজার পত্রিকা ইত্যাদির গ্রাহক ছিলেন। ডাকযোগে এগুলো কলকাতা থেকে রাঢ়ুলীতে পৌঁছাত। বিয়ের পর যখনই হরিশচন্দ্র কলকাতা যেতেন, তখনই তিনি তাঁর স্ত্রী ভুবনমোহিনী দেবীর জন্য পড়াশোনার ব্যবস্থা করতেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্বয়ং ভুবনমোহিনী দেবীকে বাংলা পাঠ শিক্ষা করতে সহায়তা করতেন। মায়ের হাতেই প্রফুল্ল চন্দ্রের শিক্ষায় হাতেখড়ি হয়। তারপর তিনি তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠা করা গ্রামের স্কুলে অন্য ভাইদের সঙ্গে ভর্তি হন। বাড়িতে যেহেতু পড়াশোনা এবং বইপত্রের বিশাল সম্ভার ছিল, তাই শুরু থেকেই প্রফুল্লদের পড়াশোনায় অনুরাগ গড়ে ওঠে। ১৮৭০ সালে হরিশচন্দ্র সন্তানদের পড়ালেখার ভালো বন্দোবস্ত করার জন্য কলকাতায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সে বছর তিনি স্থায়ীভাবে পরিবার নিয়ে কলকাতার ১৩২ নম্বর আর্মহার্স্ট স্ট্রিটে ভাড়া বাড়িতে চলে আসেন। প্রফুল্ল চন্দ্র ভর্তি হন কলকাতার হেয়ার স্কুলে। সেখানে কৃতিধন্য শিক্ষকদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পান তিনি। কিন্তু ১৮৭৪ সালে প্রফুল্ল চন্দ্র যখন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী, তখন তাঁর গুরুতর রক্ত আমাশয় হয়। ফলে তাঁর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় ইচ্ছেমতো পড়ার সুযোগ পান। তারপর স্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায় প্রফুল্ল চন্দ্রকে রাঢ়ুলী গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যার কথা আমরা শুরুতে জেনেছি। পরবর্তী সময়ে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় মনে করতেন, এই অসুস্থতা তাঁর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ ছিল।
কলকাতায় শিক্ষাজীবন
১৮৭৬ সালে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কলকাতায় ফিরে অ্যালবার্ট স্কুলে আবারও পড়াশোনা শুরু করেন। সেখান থেকে এন্ট্রান্স পাস করে ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে। ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়েও তিনি পেলেন সমান আগ্রহ। এ সময় তিনি পার্শ্ববর্তী প্রেসিডেন্সি কলেজেও ‘বাইরের ছাত্র’ হিসেবে অধ্যাপকদের বক্তৃতা শুনতে যেতেন। সেখানেই তিনি প্রথম রসায়নে নিজের আগ্রহ টের পান। প্রেসিডেন্সি কলেজে সেখানকার রসায়নের অধ্যাপক (পরে স্যার) আলেকজান্ডার পেডলার ল্যাবরেটরি ছাড়া শ্রেণিকক্ষেও বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখাতেন। কিন্তু এতে প্রফুল্ল চন্দ্রের মনের আশা পূরণ হতো না। কাজেই এক সহপাঠীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি তাঁর বাড়িতে একটি ‘ল্যাবরেটরি’ স্থাপন করে সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা করতেন। একদিন অক্সিহাইড্রোজেন ব্লো-পাইপ নিয়ে কাজ করার সময় দুর্ঘটনা হলেও তাঁরা কেউ সেই দুর্ঘটনায় পড়েননি। এভাবে রসায়নের প্রতি তাঁর আগ্রহ বাড়তেই থাকে। কাজেই এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএসসি ক্লাসে ভর্তি হন। রাঢ়ুলীতে থাকার সময় ল্যাটিন ও ফরাসি ভাষা তাঁর আয়ত্ত হয়। কলেজপাঠ্য হিসেবে সংস্কৃত ভাষাও তিনি শিখে ফেলেন। এর মধ্যে তিনি জানতে পারেন, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গিলক্রাইস্ট বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে বিলেতে বৃত্তি নিয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়া যায়। এই বৃত্তি পেতে হলে ল্যাটিন, গ্রিক অথবা সংস্কৃত, ফরাসি অথবা জার্মান ভাষা জানা আবশ্যক ছিল। যেহেতু এই কয়টি ভাষা তিনি জানেন, তাই তিনি এই পরীক্ষায় অংশ নেবেন বলে মনস্থির করেন এবং গোপনে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কারণ, তিনি জানতেন সফল না হলে ‘সহপাঠীরা তাকে এই জন্য উপহাস করিবে’। কিন্তু সে বছর মুম্বাই নগরীর জনৈক পার্সি ও প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিলেতে শিক্ষালাভের সুযোগ পেলেন। মা–বাবার সম্মতি নিয়ে প্রফুল্ল চন্দ্র পি কে রায়ের কনিষ্ঠ সহোদর দ্বারকানাথ রায়ের সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়া নামের জাহাজে করে ৩৩ দিন পর ১৮৮২ সালের জানুয়ারি মাসে বিলেতে হাজির হলেন। জাহাজঘাট থেকে লন্ডনে পৌঁছালে সেখানে অবস্থানরত জগদীশচন্দ্র বসু (পরে আচার্য ও স্যার) ও সত্যরঞ্জন দাশ তাঁদের অভ্যর্থনা জানান ও থাকার ব্যবস্থা করেন। সেখান থেকে প্রফুল্ল চন্দ্র চলে গেলেন তাঁর জন্য নির্ধারিত এডিনবার্গ কলেজে।
বিলেতের শিক্ষাজীবন
বিলেতে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও প্রাণিবিদ্যা নিয়ে শীতকালীন সেশনে ক্লাস শুরু করেন। অচিরেই বুঝতে পারেন, রসায়নেই তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য এবং আগ্রহ। তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক ক্লাসে তিনি যখন খুবই মনোযোগী ছিলেন, তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা শুনতে পান। ১৮৮৫ সালে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করে ‘সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বে ও পরে ভারতের অবস্থা’ শীর্ষক সর্বোৎকৃষ্ট রচনার জন্য পুরস্কার দেওয়া হবে। বিএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি সত্ত্বেও প্রফুল্ল চন্দ্র এই কাজে মনোনিবেশ করলেন। এ রচনা লেখার জন্য বিভিন্ন লাইব্রেরি থেকে মোটা মোটা ইতিহাসের বই সংগ্রহ করেন। এ সময় ইতিহাসের প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণ তৈরি হয়। তিনি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হতে পারেননি। কিন্তু প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও অন্য একজনের রচনাকে আদর্শের কাছাকাছি (Proxime accessment) হিসেবে গণ্য করা হয়। সে সময় ‘ফটোকপি’ করার ব্যবস্থা ছিল না। কাজেই আয়োজকদের কাছে আবেদন করে প্রফুল্ল চন্দ্র তাঁর রচনাটি সংগ্রহ করে সেটি পুস্তিকাকারে প্রকাশ করেন। এই রচনার জন্য গবেষণা এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো একটি বিষয়ে নিজের ধারণা প্রকাশের ব্যাপারে তাঁর দক্ষতাও বৃদ্ধি পায়।
রসায়নশাস্ত্রে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করার পর নিজেকে ডিএসসি বা ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রির জন্য তৈরি করেন তিনি। ১৮৮৭ সালে লাভ করেন ডিএসসি ডিগ্রি। পড়াশোনার কৃতিত্বের জন্য তিনি পান হোপ প্রাইজ, যা দিয়ে তিনি আরও এক বছর এডিনবার্গে গবেষণা করার সুযোগ পেলেন। এ ছাড়া গিলক্রাইস্ট কর্তৃপক্ষও মেয়াদ শেষে ৫০ পাউন্ড পুরস্কার প্রদান করে তাঁকে। তিনি কলেজের কেমিক্যাল সোসাইটির প্রথম সহসভাপতি হলেন। হোপ প্রাইজের অর্থে তিনি আরও কিছুদিন গবেষণা করে ১৮৮৮ সালের শীত সেমিস্টার শেষে দেশে ফেরার জন্য মনস্থির করেন। দেশে ফেরার আগে তিনি এক মুসলমান বন্ধুর সঙ্গে পদব্রজে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। এ ছাড়া ইংল্যান্ড থেকে সরাসরি জাহাজে ফেরার পরিবর্তে তিনি ট্রেনে করে ইউরোপের বিভিন্ন শহর ঘুরে ১৮৮৮ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে কলকাতায় ফিরে আসেন।
কর্মজীবন ও গবেষণা
ইংল্যান্ড থেকে ফেরার কিছুকাল আগে ভারতবর্ষে চাকরির জন্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (ইতিমধ্যে তিনি পি সি রায় নামে পরিচিতি পেতে শুরু করেছেন) বিভিন্ন কর্তাব্যক্তির সঙ্গে দেখা করে বেশ কিছু প্রশংসা ও পরিচিতিপত্র সংগ্রহ করেন। কিন্তু দেশে ফিরে তেমন কোনো লাভ হলো না তাতে। ১৮৮৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত পি সি রায়ের কোনো চাকরি হলো না। এ সময় তিনি জৈব রসায়ন নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উদ্ভিদবিজ্ঞানে কাজ করে সময় কাটাতেন এবং প্রায়ই জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রীর আতিথ্য গ্রহণ করতেন। অবশেষে প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নের একটি অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি হলো এবং সেটির বিপরীতে মাসিক ২৫০ টাকা বেতনে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সহকারী অধ্যাপক হিসেবে সে পদে যোগদান করেন। কাজে যোগদানের পর তিনি রসায়ন বিভাগের একতলা ভবনে কাজ শুরু করেন। এই ভবন আগে হেয়ার স্কুলের অংশ ছিল। ১৮৭০ সালে যশোর থেকে কলকাতায় এসে বালক ফুলু এই স্কুলের যে বেঞ্চে বসতেন, কী আশ্চর্য! ঠিক একই জায়গায় সহকারী অধ্যাপকের বসার স্থান নির্ধারিত হয়। পড়ানো শুরু করার পরপরই তিনি নিরীক্ষামূলক রসায়নে জোর দেন। রসায়ন পড়ানোর ব্যাপারটিকে তিনি পরীক্ষণের মাধ্যমে আনন্দপূর্ণ ও কৌতূহলময় করে তোলেন। প্রথম তিন মাস তিনি সহকারীর কাজ থেকেও শ্রেণিকক্ষে ও পরীক্ষাগারে পরীক্ষণ কাজ রীতিমতো মহড়া দিয়ে তৈরি হতেন। এ ছাড়া শ্রেণিকক্ষে নিজের লেকচারও ‘কাগজে লিখিয়া লইতেন’। হোপ প্রাইজের সময় তিনি বিলেতে অধ্যাপকদের সহায়তা করে এসেছেন। কাজেই অধ্যাপনায় তাঁর তেমন সমস্যা হলো না। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের পর পূজার ছুটির সময় আলেকজান্ডার পেডলার তিন মাসের জন্য বিলেতে গেলে রসায়ন বিভাগের দায়িত্ব পি সি রায়ের ওপর বর্তায়। ফলে কোনো কোনো সময় তিনি পরপর তিনটি ক্লাস নিতেন। কিন্তু কখনোই তিনি হয়রান বা হতাশ হননি। বরং এতে তাঁর কাজের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেল।
এরপরই তিনি অধ্যাপনার পাশাপাশি অবসর সময়ে গবেষণায় মনোযোগ দেন। তাঁর প্রথম দিককার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে ঘি ও শর্ষের তেলে ভেজাল নির্ণয় করা (সে সময়ও বাঙালি খাবারে ভেজাল দিত!)। তিন বছর একাদিক্রমে গবেষণা করে তিনি তাঁর ফলাফল জার্নাল অব দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল-এ প্রকাশ করেন। এরপর থেকে নিয়মিত গবেষণায় মন দেন প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।
রসায়নের ক্লাসে অনেক কিছু হাতে–কলমে করে দেখাতেন তিনি। ছাত্রদের সামনে এক টুকরা হাড় হাতে নিয়ে বুনসেন বার্নারে পুড়িয়ে মুখে পুরে দিয়ে ছাত্রদের শেখালেন, এটা ক্যালসিয়াম ফসফেট। এ ছাড়া আর কিছুই নয়। সেটা কোন প্রাণীর হাড়, তা-ও আর চেনার উপায় রইল না।
১৮৯৫ সালে তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট (HgNO2) আবিষ্কার করেন, যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। এটি তাঁর অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা তাঁকে ‘মাস্টার অব নাইট্রাইটস’ আখ্যায় ভূষিত করেন। এ ছাড়া পারদসংক্রান্ত ১১টি মিশ্র ধাতু আবিষ্কার করে তিনি রসায়নজগতে বিস্ময় সৃষ্টি করেন। গবাদিপশুর হাড় পুড়িয়ে তাতে সালফিউরিক অ্যাসিড যোগ করে তিনি সুপার ফসফেট অব লাইম তৈরি করেন।
প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ১৮৮৯ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষক ছিলেন।
এরপর ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিজ্ঞান কলেজের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। বিজ্ঞান কলেজের দোতলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের একটি কক্ষে তিনি থাকতেন। আসবাব বলতে ছিল একটি খাটিয়া, দুটি চেয়ার, ছোট একটি খাবার টেবিল, একটি পড়ার টেবিল ও জামাকাপড় রাখার একটি সস্তা আলনা। পরনে থাকত কম দামের মোটা–খাটো ধুতি, চাদর, গেঞ্জি অথবা গায়ে একটি কোট। একরাশ দাড়ি–গোঁফ মুখে লোকটির চুলে বোধ করি চিরুনি পড়েনি। সকালে মাত্র এক পয়সার নাশতা। অন্যান্য খাবারদাবারও খুব সাদামাটা। খাদির জামাকাপড় পরতেন। নিজেই কেচে পরিষ্কার করতেন সেগুলো। অথচ তখন তাঁর মাসিক আয় হাজার টাকার ওপর।
বিজ্ঞান কলেজে গবেষণার পাশাপাশি তিনি বিজ্ঞানীদের সংগঠিত করতে কাজ করেন। ১৯২৪ সালে ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা হলে তিনি সেটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালে ৭৫ বছর বয়সে তিনি পালিত প্রফেসর হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিপূর্ণ অবসর গ্রহণ করলেও তাঁকে ইমেরিটাস অধ্যাপক (Emiritius Professor) হিসেবে রসায়নের গবেষণাকর্মের সঙ্গে যুক্ত রাখা হয়।
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, নীলরতন ধর, পুলিন বিহারী সরকার, রসিকলাল দত্ত, মেঘনাদ সাহা, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, বিজ্ঞানী কুদরাত–এ–খুদা, হেমেন্দ্র কুমার সেন, বিমান বিহারী দে, প্রিয়দা ভঞ্জন রায়, জ্ঞানেন্দ্র নাথ রায়, জ্ঞানেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্র লাল দে, প্রফুল্ল কুমার বসু, বীরেশ চন্দ্র গুহ, অসীমা চ্যাটার্জি প্রমুখ।
উদ্যোগ ও উদ্যোক্তা বিজ্ঞানী
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ানোর সময় তিনি কয়েকটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করেন। এর মধ্যে একটি হলো রসায়নের শিক্ষার্থীদের রসায়নের পাশাপাশি আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন। তিনি আবিষ্কার করলেন, অধিকাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন, কারণ তাঁদের একটি ‘চাকরি’ দরকার। সেটি না হলে যেন জজিয়তি করা যায়, সেটাও চিন্তা করেন তাঁরা। এ সময় তিনি আরও লক্ষ করেন, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে মাঠে-ময়দানে কাজ কিংবা ব্যবসা করার আগ্রহ মোটেই নেই। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘কলেজ শিক্ষিত বাঙ্গালি যুবকেরা শেক্সপিয়ারের বই হইতে মুখস্থ বলিতে পারিত এবং মিল ও স্পেনসারও খুব দক্ষতার সঙ্গে আওড়াইতে পারিত, কিন্তু জীবনযুদ্ধে তাহারা পরাস্ত হইল।’ কারণ কর্মকুশলী, পরিশ্রমী অবাঙালিরা বিশেষ করে রাজপুতনার মরুভূমি থেকে আগত মাড়োয়ারিরা শুধু কলকাতা নয়, সমগ্র বাঙ্গাল মুলুকে নিজেদের আসন ক্রমাগত স্থায়ী করে নিচ্ছেন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ এবং শিক্ষিত যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের জন্য তিনি নিজেই শিল্প প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলেন। কারণ, কেরানি বানানোর শিক্ষাতে তাঁরও প্রবল আপত্তি। ‘একটি সমগ্র জাতি মাত্র কেরানি বা মসিজীবী হইয়া টিকিতে পারে না; বাঙালি এত দিন সেই ভ্রান্তির বশবর্তী হইয়া আসিয়াছে এবং তাহারই ফলে আজ সে সকল প্রকার জীবনোপায় ও কর্মক্ষেত্র হইতে বিতাড়িত। বৈদেশিকগণের তো কথাই নাই। ভারতের অন্যান্য প্রদেশসহ লোকের সহিতও জীবনসংগ্রামে আমরা প্রত্যহ হটিয়া যাইতেছি। বাঙালি যে নিজ বাসভূমে পরবাসী হইয়া দাঁড়াইয়াছে, ইহা আর কবির খেদোক্তি নহে, রূঢ় নিদারুণ সত্য।’
এডিনবার্গে থাকাকালীন সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল সোসাইটির সদস্যরূপে বিভিন্ন রাসায়নিক কারখানা পরিদর্শন করে রাসায়নিক কারখানা তৈরির প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তিনি। সেই জ্ঞান নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন মানুষকে উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা করতে, যাতে তাঁরা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
১৮৯৩ সালে পি সি রায় নিজের ল্যাবরেটরিতে ব্রিটিশ কোম্পানি ফার্মাকোপিয়ার একটি ওষুধ তৈরির ব্যবস্থা করেন। এ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে মাত্র ৮০০ টাকা পুঁজি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস। এটি শুরু হয় পি সি রায়ের ৯১ নম্বর আপার সার্কুলার রোডের বাসভবনের পাশে। পরে ১৯০১ সালে কলকাতার মানিকতলায় ৪৫ একর জমিতে স্থানান্তর করা হয়। একই সঙ্গে এটি শেয়ারবাজারেও তালিকাভুক্ত হয়। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে এটিই কোনো বাঙালির প্রতিষ্ঠিত প্রথম কোনো শিল্পকারখানা। এর মধ্যে তাঁর বাড়ি নতুন খুলনা জেলার অন্তর্গত হয়। নিজ জেলা শহরে মানুষের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন এ পি সি কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি এবং এ পি সি টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড (বর্তমানে খুলনা টেক্সটাইল মিলস নামে পরিচিত)। এ ছাড়া ক্যালকাটা পটারি ওয়ার্কস, বেঙ্গল এনামেল ওয়ার্কস ও ন্যাশনাল ট্যানারি ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠায় তিনিই ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা।
১৯০৬ সালে তিনি রাঢ়ুলী এবং এর আশপাশের গ্রামের মানুষ জড়ো করে ৪১টি কৃষি ঋণদান সমবায় সমিতি গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে সমিতিগুলো নিয়ে রাঢ়ুলী সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল অবিভক্ত বাংলার তৃতীয় ব্যাংক।
১৯২৩ সালে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় ধর্মগোলা ও সমবায় ভান্ডার স্থাপনের পরামর্শ দেন। ১৯১৭ সালে বেঙ্গল কেমিক্যাল সমবায় সমিতি, ১৯১৮ সালে বঙ্গবাসী কলেজ কো-অপারেটিভ স্টোর অ্যান্ড ক্যানটিন, ১৯২১ সালে বেঙ্গল কো-অপারেটিভ সোসাইটিসহ অনেক সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন।
রসায়নশাস্ত্রে ভারতের গৌরব
বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে পি সি রায় খুঁজে বের করেন রসায়নশাস্ত্রে প্রাচীন ভারতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ধাতুর সংকর তৈরিতে ভারত যে পিছিয়ে ছিল না, চরক সংহিতা-সুশ্রুত সংহিতায় উল্লেখিত অস্ত্রোপচারের সূক্ষ্মাগ্র যন্ত্র যেমন স্ক্যালপোল বা ল্যানসেট তার প্রমাণ। ইস্পাত আবিষ্কারের প্রথম কৃতিত্বও প্রাচীন ভারতের। প্রাচীন রসায়নে শুধু মিসর, সিরিয়া, চীন বা আরব নয়, প্রাচীন ভারতবর্ষও যে কতটা এগিয়ে ছিল, তা তুলে ধরতেই তিনি লিখলেন দ্য হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি। এ বিষয়ে প্যারিসের বিখ্যাত বিজ্ঞানী মার্সিলিন বের্তেলোর সান্নিধ্য তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। এ কাজের জন্য তিনি সংস্কৃত ভাষার পাশাপাশি পালি ভাষাও শিখেছিলেন।
বিজ্ঞানী বেশে বিপ্লবী
দেশপ্রেম পি সি রায়কে ইউরোপ থেকে দেশে ফিরিয়ে আনে। বাংলা ভাষা ছিল তাঁর অস্তিত্ব। ইংরেজি পঠন-পাঠনে অত্যন্ত ব্যুৎপত্তি থাকার পরও তিনি ক্লাসে বাংলায় বক্তৃতা দিতেন। তিনি স্বদেশি আন্দোলনের প্রথম পর্যায় থেকেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা কেন্দ্র করে যখন বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন গোপনে অস্ত্র ক্রয়ের জন্য তিনি বিপ্লবীদের অর্থসহায়তা দেন। ১৯১৬ সালে কলকাতায় তিনিই প্রথমবারের জন্য মহাত্মা গান্ধীর জনসভার আয়োজন করেছিলেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তরে স্যার পি সি রায়ের নাম লেখা ছিল ‘বিজ্ঞানী বেশে বিপ্লবী’।
নিজে খুব সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। বেতন থেকে মাত্র ৪০ টাকা নিজের জন্য রেখে বাকি অর্থে দরিদ্র ও বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন তিনি। ১৯১৯ সালে কলকাতার টাউন হলে রাওলাট বিলের বিরোধিতায় আয়োজিত জনসভায় ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলেন, ‘দেশের জন্য প্রয়োজন হলে বিজ্ঞানীকে টেস্টটিউব ছেড়ে গবেষণাগারের বাইরে আসতে হবে। বিজ্ঞানের গবেষণা অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু স্বরাজের জন্য সংগ্রাম অপেক্ষা করতে পারে না।’
ভারতে ফেরার পর গান্ধীজির সঙ্গে ১৯০১ সালে তাঁর দেখা হয়। বন্ধুবর রাজনীতিবিদ গোপাল কৃষ্ণ গোখলে তাঁদের দুজনকে পরিচয় করিয়ে দেন। এ নিয়ে নিজের আত্মজীবনীতে মহাত্মা গান্ধী লিখেছেন, তিনি (গোখলে) যেসকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে ডেকেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে আমার স্মৃতিতে যিনি জায়গা করে নিয়েছেন, তিনি হলেন ড. (বর্তমানে স্যার) পি. সি. রয়।
যেভাবে তিনি ড. রায়ের পরিচয় দিয়েছিলেন: “ইনি হলেন প্রফেসর রায়, যিনি প্রতিমাসে বেতন পান ৮০০ রুপি। কিন্তু তিনি নিজের জন্য রাখেন কেবল ৪০ রুপি। বাকি অর্থ তিনি ব্যয় করেন জনসাধারণের উদ্দেশ্যে। তিনি বিবাহিত নন এবং বিয়ে করতেও চান না।”
আমি সে সময়ের ড. রায়ের সাথে আজকের ডা. রায়ের তেমন পার্থ্যক্য খুঁজে পাই না। তাঁর পোশাক যতটা সম্ভব সহজ সরল ছিল। পার্থক্য শুধু এই যে এখন তার পোশাকে খাদি আছে, সেই দিনগুলোতে তার পোশাক ছিল ভারতীয় মিল-কাপড়।
(দ্য স্টোরি অব মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ – মহাত্মা গান্ধী)। গান্ধীজির অনাড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি নিজেকে কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন।
১৯২৫ সালে কোকনাদ কংগ্রেসের কনফারেন্সে সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ আলীর অনুপস্থিতিতে কিছু সময় স্যার পি সি রায় সভাপতিত্ব করেন। একই সময় পাইকগাছা উপজেলার কাটিপাড়ায় ‘ভারত সেবাশ্রম’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে নিজ জন্মভূমির এলাকার মানুষকে চরকায় সুতা কাটার মাধ্যমে স্বদেশি আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন। বিজ্ঞান কলেজের বারান্দায় একটা চরকা স্থাপন করে তিনি নিজেও সুতা কাটতেন। ১৯৩০ সালে কংগ্রেসের লবণ আইন অমান্য আন্দোলনের খুলনা জেলার স্থান হিসেবে পি সি রায় নিজ গ্রাম রাঢ়ুলীকে নির্বাচন করেন।
অনাড়ম্বর জীবনের অবসান
ব্রিটিশ সরকার প্রথমে ১৯১২ সালে তাঁকে সিআইই (CIE) এবং ১৯১৯ সালে নাইটহুড প্রদান করেন। পি সি রায় হয়ে যান স্যার পি সি রায়। শিক্ষকতায় তাঁর অবদানের জন্য এরই মধ্যে তিনি সাধারণ্যে আচার্য হিসেবেই পরিচিত হয়ে ওঠেন।
লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতের মহিশুর ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯০২ সালে তিনি কেমিক্যাল সোসাইটির ফেলো (এফসিএস), ১৯৩৫ সালে ভারতীয় জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য (এফএনআই) ও ১৯৪৩ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সের ফেলো (এফআইএসিএস) মনোনীত হন।
১৯৪৪ সালের ১৬ জুন তিনি মারা যান।