বীর বাহু বীরবল

বীরবল নিজে বীরও ছিলেন না, রাজাও ছিলেন না। কিন্তু মোগল সম্রাট আকবর তাঁকে ভালোবেসে বীরবল নাম ও রাজা উপাধি দিয়েছিলেন।

বীরবল সম্পর্কে আমরা যেমন জানি, তিনি আদৌ ততটা রসিক ধরনের লোক ছিলেন কি না, সেটা নিয়ে একটু দ্বিমত আছে। তবে বীরবলের জন্ম-মৃত্যু ও উপস্থিতি নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।

ঐতিহাসিকেরা বলছেন, ১৫২৮ সালে উত্তর প্রদেশের কল্পি নামে এক স্থানে জন্ম সম্রাট আকবরের এই মন্ত্রীর। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, যমুনার তীরে টিকাভানপুর নামে এক গ্রামে জন্ম তাঁর। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, বীরবলের প্রকৃত নাম ছিল মহেশ দাস; আবার অনেকে বলেন আসল নাম ছিল ব্রহ্ম দাস।

নাম শুরুতে যা-ই থাক, বীরবল প্রথম জীবনে সংগীতঙ্গ মানুষ ছিলেন। বাবার কাছ থেকে ধর্মীয় সংগীত ও ব্রজ কবিতা বলে একধরনের ধর্মীয় কবিতায় বিশেষ দক্ষতা পেয়েছিলেন। পাশাপাশি তিনি নিজের চেষ্টায় হিন্দি, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় দারুণ দক্ষতা অর্জন করেন। আর এসব গুণের কারণেই প্রথমে বীরবল চন্দ্রের রাজপুতের দরবারে সভাকবির চাকরি পান। ধারণা করা হয়, ১৫৫৬ থেকে ১৫৬২ সালের মধ্যে কোনো একসময় সম্রাট আকবরের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর।

আকবরও শুরুতে তাঁকে সভাকবি হিসেবে এনেছিলেন। কিন্তু কিছুকালের মধ্যে বীরবলের রসিকতা, বহুভাষা জ্ঞান ও কূটনৈতিক দক্ষতা দেখে তাঁকে নবরত্নের একজন, মানে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দেন। আকবর তাঁর স্বভাব অনুযায়ী এই রত্নদের ওপর বিরাট ভরসা করতেন। ফলে যুদ্ধবিদ্যায় কোনো রকম দক্ষতা না থাকার পরও বীরবলকে প্রধান করে আফগানিস্তানে বিদ্রোহ দমনে বিশাল এক সৈন্য বাহিনী পাঠিয়েছিলেন সম্রাট। আর সেখানেই যুদ্ধে মারা যান বীরবল।

এই মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সম্রাট আকবর দুই দিন পর্যন্ত কোনো খাবার গ্রহণ করেননি। তিনি এক প্রিয়জন হারিয়েছিলেন। আর আমরা হারিয়েছি, আরও কিছু মজার গল্প তৈরি হওয়ার সুযোগ।

বীরবলের দশটি গল্প

একদিন আগ্রার পাশের জঙ্গলে শিকার করতে বেরিয়ে দলছুট হয়ে যান আকবর। হারিয়ে ফেলেন পথ। এমন সময় পথের মাঝে দেখা হলো কিশোর মহেশ দাসের সঙ্গে। সম্রাট তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কোন পথটি আগ্রার দিকে গেছে?’ প্রশ্নের জবাবে মহেশ বলল, ‘পথ তো কোথাও যায় না। মানুষই পথ মাড়িয়ে যায়।’ এরপর ওই কিশোরটি সঠিক পথের হদিস দিয়ে দেয়। বুদ্ধিমত্তা আর রসবোধের পরিচয় পেয়ে সম্রাট নিজের আঙুল থেকে একটি বাদশাহী আংটি খুলে উপহার দেন মহেশকে। এই মহেশই কিন্তু পরে বীরবল হলেন।

বাদশা আকবর সভাসদদের কাছে জানতে চাইলেন, ‘পৃথিবীতে সুন্দর ফুল কী?’ সভাসদদের কারও উত্তর পছন্দ হলো না সম্রাটের। সবার বলা শেষ হয়ে গেলে মহেশ সাহস করে বলে উঠল, ‘কাপাস ফুল জাহাঁপনা।’ উত্তর শুনে সভাসদরা তো হেসে কুটি কুটি। সম্রাট সবাইকে থামতে বলে জানতে চাইলেন, ‘কাপাস ফুল কেন সুন্দর?’ মহেশ বলল, ‘এই ফুলের গুটি থেকে যে তন্তু পাওয়া যায়, তা থেকে সূক্ষ্ম মসৃণ কাপড় তৈরি হয়। মসলিন আর মেয়েদের অতি প্রিয় ওড়না এই তন্তু থেকেই তৈরি হয়। সাদা ময়ূয়ের ছড়ানো পেখমের মতো ওই কাপাস ফুলই মানুষকে আনন্দ দেয় অনেক বেশি।’ উত্তর শুনে বিস্মিত আকবর যুবকের পরিচয় জানাতে চাইলেন। যুবক তখন সম্রাটের দেওয়া আংটিটি দেখিয়ে এখানে আসার কারণটি জানল। আকবর খুশি হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি আমার কাছেই থাকবে। তুমি হবে আমার অন্যতম সভাসদ। আর আজ থেকে তোমার নতুন নাম দিলাম বীরবল।

কৈশোরে মৌলভির কাছে বীরবল ফারসি শিখতে গিয়েছিলেন। একদিন পড়া বলতে না পারায় মৌলভি রেগে গিয়ে বললেন, ‘জানো, তোমার বয়সে বাদশা হুমায়ুন প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা লেখাপড়া করতেন, আর তুমি?’

বীরবল সবিনয়ে বলল, ‘জি। আপনার মতো বয়সে হুমায়ুন বাদশা হয়ে ভারত শাসন করেছিলেন, আর আপনি আমাদের মতো ছাত্রদের ভাঙা মাদ্রাসায় বসে পড়াচ্ছেন।’

একদিন আকবর স্বহস্তে সভার মেঝেতে একটা লাইন আঁকলেন। হুকুম দিলেন, ‘এটাকে ছোট করো, তবে একটুও মোছা চলবে না।’ সবাই হতভম্ব হয়ে রইলেন। বীরবলের পালা এল যখন, তক্ষুনি সে এই লাইনটার পাশ দিয়ে একটা লম্বা লাইন আঁকল। ওটা ছুঁলো না। দরবারে সবাই বললেন, ‘ঠিক হয়েছে। প্রথম লাইনটা তো আরও ছোট।’

একদিন আকবর আর বীরবল গেল শিকারে। সম্রাট একটি গাছ দেখিয়ে বলছেন, ‘এটা এমন বেঁকাতেড়া কেন হে!’

বীরবল বলল, ‘এটা জঙ্গলের সব গাছেরই জামাই তো! তাই ব্যাঁকাত্যাড়া। কুকুরের লেজ আর জামাই, সর্বদাই ব্যাঁকা হয়।’ ‘অ্যাঁ? আমার জামাইও সে রকম?’ ‘নিশ্চয়ই, সম্রাট!’ ‘বটে! তবে তাকে ক্রুশবিদ্ধ করো।’

কিছুদিন বাদে বীরবল তিনটি ক্রুশ করাল। সোনার, রুপার আর লোহার। দেখে আকবর বললেন, ‘তিনটি ক্রুশ করালে কেন?’

‘সম্রাট! একটি আপনার জন্য, একটি আমার, আরেকটি জাহাঁপনার জামাইয়ের জন্য।’

‘আমরা কেন বধ হতে যাব?’

‘আহা! আমরা প্রত্যেকেই তো কারও না কারও জামাই!’ আকবর হাসতে হাসতে বললেন, ‘তাহলে আমার জামাইকে ক্রুশে চড়িও না।’

সম্রাট আকবর ও বীরবল হেঁটে বেড়াচ্ছিল। প্রাসাদের কোণে কিছু কাক চোখে পড়ল সম্রাটের। বীরবলকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলো তো দিল্লিতে কাকের সংখ্যা কত?’

‘নয় হাজার ৯৯৯।’

আকবর বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, ‘তুমি এমন নিখুঁত সংখ্যা জানলেন কীভাবে?’

বীরবল উত্তর দিল, ‘বিশ্বাস না হয় গুনে দেখুন। যদি বেশি দেখেন তাহলে জানবেন অন্য শহর থেকে বেড়াতে এসেছে। আর যদি কম পান তাহলে জানবেন অন্য শহরে বেড়াতে গেছে।’

রাজা বীরবলকে সঙ্গে নিয়ে বাজারে গেলেন। হঠাৎ রাজা দেখতে পেলেন এক কৃষক বেগুন বিক্রি করছে। ‘কী চমৎকার দেখতে, এটা কি আমার রাজ্যে জন্মে? এই ফলটির নাম কী বীরবল?’ রাজা জানতে চাইলেন।

বীরবল জানাল, ‘এর নাম রাজামশাই বেগুন। সত্যিই এটা দেখতে চমৎকার। দারুণ খেতে, অতি সুস্বাদু খাবার, একবার খেলে সারা জীবন মনে থাকবে।’

প্রাসাদে ফিরে রাজা বেগুন দিয়ে খেতে বসেছেন। কিন্তু খেতে পারছেন না। বীরবলকে বললেন, ‘এসব কী? এসব কী এনেছ? আমি তো খেতে পারছি না।’

রাজামাশাই, ‘বেগুন আবার মানুষ খায় নাকি। এর নামই হলো বে গুন, যার কোনো গুণ নেই। এটা আপনার কোনোক্রমেই খাওয়া সম্ভব নয়। এসব রাজপ্রাসাদের খাবার তো নয়ই। খুবই জঘন্য। বাজারে এটা কেউ কিনে না। এসব ঘোড়ার খাবার রাজামশাই।’

রাজা তো অবাক। প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু তুমিই তো বাজারে বলেছ, এটা সুন্দর, খেতে চমৎকার।’

‘জি রাজামশাই, আমি তো আপনার চাকরি করি, বেগুনের নয়।’

বীরবলের ভাইপোও কাকার উপযুক্ত বটে। কেউ কম নয়।

সম্রাটের আনুকূল্যে বীরবল পাকাবাড়ি তুলেছিল। পাকাবাড়ি শেষ হওয়ার পর, বীরবল একদিন তার নতুন তৈরি পাকাবাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে পাশের কুঁড়েঘরবাসী ভাইপোকে বলল, ‘ওরে শামু, বাড়ির ভেতর বসে কী করছিস রে?’

ভাইপো শামু বাড়িতেই ছিল, সে কাকার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করল না। সে জানত, নতুন বাড়ি দেখাতেই কাকা তাকে ডাকছে।

এক বছর পর বীরবলের ভাইপো একটা পাকাবাড়ি তৈরি করে, সেই নতুন বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে ডাকতে লাগল, ‘ও কাকা, কাকা, গত বছর তুমি আমায় ডেকেছিলে কেন?’

বীরবল বসে বসে ভাবল, ভাইপো লায়েক হয়েছে। কাকার মনের কথা ঠিক ধরতে পেরে, ঠিক সময়েই জবাব দিয়েছে বটে!

সম্রাট আকবর একদিন বীরবলকে আদেশ করলেন, ‘আমার রাজ্যে যত বেকুব আছে, তাদের একটা তালিকা প্রস্তুত করো।’

‘যথা আজ্ঞা মহারাজা’ বলে বীরবল তালিকা শুরু করে সবার ওপরে সম্রাটের নাম লিখল।

‘আমার নাম সবার ওপরে কেন?’ রেগে গিয়ে সম্রাট জিজ্ঞাসা করলেন।

উত্তরে বীরবল বলল, ‘যে বেকুব খুঁজতে যায়, সে হলো সবচেয়ে বড় বেকুব।’

১০

একটি আলুর গুদামে কোনো কারণবশত আগুন লেগেছিল। আলুর গুদামের মালিক মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল। গুদামের অনেক টাকার আলু ছিল যে।

বীরবল সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল, অন্য সবাই যখন আগুন নেভাতে ব্যস্ত, বীরবল তখন পাশের একটি মুদি দোকান থেকে খানিকটা নুন চেয়ে পোড়া এবং আধা সেদ্ধ আলুগুলো মনের আনন্দে নুন দিয়ে খেতে লাগল। আলু খেতে খেতে তার পেট ভরে গেল। গুদামের মালিককে এক কোণে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে বীরবল বলল, ‘মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন কেন দাদা? এটা কি মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকার সময়?’

গুদামের মালিক আফসোস করে বলল, ‘যার যায়, সে-ই বোঝে ভালো। এই আলুর গুদামটা যে আমার।’

বীরবল লোকটার আরও কাছে গিয়ে বলল, ‘তাই নাকি দাদা? তবে তো আপনি ঠিক খবর দিতে পারবেন।’

‘কী খবর?’

‘আবার কবে আলুর গুদাম পুড়বে দাদা?’