ব্ল্যাকহোলের প্রথম ছবি

সুইজারল্যান্ডের বার্নের এক পেটেন্ট অফিসের ছোট্ট এক কর্মচারী। অবসরে অফিসে, বাড়িতে, বাতিল কাগজে কিংবা চিঠির খামের উল্টো পিঠে কী সব আঁকিবুঁকি করেন, অঙ্ক কষেন। এই অঙ্কগুলো, এসব আঁকিবুঁকির মধ্যেই মহাবিশ্বের মহা মহা রহস্যের ব্যাখ্যা লুকিয়ে ছিল।

আইনস্টাইনের আবির্ভাবের আগে মহাবিশ্ব সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না। বিজ্ঞানীরা জানতেন না, এই মহাবিশ্বে কয়েক শ বিলিয়ন গ্যালাক্সির বাস। আর প্রতিটা গ্যালাক্সিতেই রয়েছে সূর্যের মতো বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র। গ্রহ-উপ্রগ্রহ, গ্রহাণুর কথা না–ই বা বললাম। এই যে এত এত গ্যালাক্সি, তার মধ্যে বিচিত্র সব বস্তুর বাস, এসব বস্তুর ভবিষ্যদ্বাণী লুকিয়ে ছিল আইনস্টাইনের ওই বাতিল কাগজে, খামের উল্টো পিঠে করা আঁকিবুঁকির মধ্যেই। এ কারণেই তাঁর স্ত্রী এক বিশাল মানমন্দিরে বিশাল এক টেলিস্কোপ দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এটা কী কাজে লাগে? কে যেন জবাবে বলেছিলেন, এটা দিয়ে বিজ্ঞানীরা মহাকাশের দূর দূর অঞ্চলের গ্রহ-নক্ষত্রের হদিস বের করেন। এলসা আবার অবাক হয়েছিলেন, ‘কই আমার স্বামীর তো এসব লাগে না। তিনি খামের উল্টো পিঠে অঙ্ক কষে এসব জিনিসের খবর আগেই জানিয়েছিলেন।’

এই হলো আইনস্টাইনের চরিত্র। প্রকৃতির সবচেয়ে বড় রহস্যগুলো তিনি ভেদ করেছিলেন। এ জন্য তাঁর যেমন টেলিস্কোপের দরকার হয়নি, দরকার হয়নি কোনো ছোট-বড় যন্ত্রপাতিরও। স্রেফ কাল্পনিক পরীক্ষা করে, অঙ্ক কষে পদার্থবিদ্যা, মহাবিশ্বের জটিল সব তত্ত্বের জন্ম দিয়েছেন, দিয়েছেন সেসবের ব্যাখ্যাও। কিন্তু শুধু গণিতে তো আর বিজ্ঞানের মন ভরে না। তার চাই প্রত্যক্ষ প্রমাণ।

আইনস্টাইন খাতা-কলমে মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন করেছিলেন, অন্য বিজ্ঞানীরা একের পর এক পর্যবেক্ষণে নেমে দিয়েছিলেন সেসবের বাস্তব প্রমাণ। টেবিলে বসে করা আইনস্টাইনের সেসব ভবিষ্যদ্বাণীর প্রায় প্রতিটা বাস্তবে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল এক দশকের মধ্যেই। কিন্তু আইনস্টাইনের তত্ত্বের ব্যাপকতা আরও গভীর। তাঁর জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভি নিছকই একটা তত্ত্ব নয়। তার ভেতর থেকে শাখা-প্রশাখার মতো বেরিয়ে এসেছিল আরও অনেক তত্ত্ব। নতুন এসব শাখাতত্ত্ব থেকেই মহাকর্ষ তরঙ্গ, ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর, শ্বেতবামন, লোহিত দানব, সুপারনোভা, মহাবিশ্বের প্রসারণ ইত্যাদি মহাজাগতিক ধারণাগুলোর জন্ম হয়েছিল এবং ভবিষ্যতে এগুলোর সব বাস্তবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ধোঁয়াশা এখনো যেটা রয়ে গেছে, সেটা কৃষ্ণগহ্বর।

গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তু কৃষ্ণগহ্বরের কথা বলেছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল শোয়ার্জশিল্ড। তাঁর মতে, সূর্যের চেয়ে অনেক অনেক ভারী নক্ষত্রের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে ঘটে এক বিস্ময়কর ঘটনা। নক্ষত্রটির ভেতরে পদার্থগুলোর মধ্যে তৈরি হয় অতিমাত্রায় মহাকর্ষীয় আকর্ষণ। ফলে পদার্থগুলো পরস্পরের আরও কাছে আসে, বাড়তে থাকে তাদের মধ্যে মহাকর্ষীয় বল। এভাবে একসময় পদার্থগুলো এত কাছে চলে আসে, তাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব খুব কমে যায়। গোটা নক্ষত্রটি পরিণত হয় ছোট্ট গোলকে। তারপর ধীরে ধীরে সেটা পরিণত হয় একটা আয়তনহীন বিন্দুতে! তখন সে মহাশক্তিশালী এক মহাকর্ষ দানব!

আয়তনশূন্য বিন্দুতে পরিণত হলেও সেই বিন্দুর মহাকর্ষক্ষেত্র ছড়িয়ে থাকে বহুদূর পর্যন্ত, গোলক আকারে। এই বিন্দু থেকে মহাকর্ষক্ষেত্রের শেষ সীমা পর্যন্ত এই অঞ্চলকে বলে কৃষ্ণগহ্বর। যেখানে কৃষ্ণগহ্বরের আকর্ষণসীমা শেষ, সেই প্রান্তরেখাকে বলে ঘটনাদিগন্ত। ঘটনাদিগন্তের ভেতর কৃষ্ণ মহাকর্ষক্ষেত্র এতই শক্তিশালী, এর ভেতর থেকে আলোও বেরিয়ে আসতে পারে না।

আমরা পত্রিকার পাতায়, অনলাইনে ব্ল্যাকহোলের দারুণ সব ছবি দেখি, আসলে কিন্তু এর স্পষ্ট কোনো ছবি ছিল না আগে। যেসব ছবি আমরা দেখি, সেগুলো শিল্পীর কল্পনায় আঁকা ছবি। অনেক দিন ধরেই বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণগহ্বরের একটি সত্যিকারের ছবি তোলার চেষ্টা করছেন। এত দিনে সেই চেষ্টা সফল হলো। ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল ব্ল্যাকহোলের প্রথম ছবি প্রকাশ করে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপে কর্মরত বিজ্ঞানীরা। পৃথিবী থেকে ৫ কোটি ৫০ লাখ আলোকবর্ষ দূরে মেসিয়ার৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্রের এক সুপারম্যাসিভ কৃষ্ণগহ্বর এটি। তার মানে কৃষ্ণগহ্বরটির যে ছবি তোলা হয়েছে, সেটা তার সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগের অবস্থা! কৃষ্ণগহ্বরটির নাম এম৮৭, যার ভর সূর্যের ভরের সাড়ে ৬০০ কোটি গুণ!

প্রথম ছবি বিজ্ঞানচিন্তার ফেসবুক পেজে প্রকাশিত হওয়ার পর একটা প্রশ্ন অনেকের কাছ থেকে এসেছে। সেটা হলো, কৃষ্ণগহ্বর থেকে আলোও প্রতিফলিত হয় না। তাহলে এটা দেখাই–বা গেল কী করে? আর ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ সেটার ছবিই–বা তুলল কীভাবে?

রুশ বিজ্ঞানী ইয়কভ জেলদোভিচের ‘কৃষ্ণগহ্বরের গ্যাস চুরি’র তত্ত্ব ইভেন্ট হরাইজনকে সাহায্য করেছে এম৮৭-এর ছবি তুলতে।

মহাকাশে যুগল তারা আছে। এদের থেকে বেতার সংকেত আসে পালস বা ঝলক আকারে। তাই যুগল তারাদের বলে পালসার। পালসারে থাকা যুগল তারা একটাকে কেন্দ্র করে শুধু অন্যটাই ঘোরে না, উভয়ে উভয়কে কেন্দ্র করে ঘোরে। এসব যুগল তারার দুটিই উজ্জ্বল নক্ষত্র হতে পারে। আবার দুটিই কৃষ্ণগহ্বরও হতে পারে। আবার হতে পারে একটি উজ্জ্বল তারা এবং অন্যটি কৃষ্ণগহ্বর। উজ্জ্বল তারাটির ঘূর্ণনের খবর পাওয়া যায় কক্ষপথের হিসাব থেকেই। সেই হিসাব থেকেই বের করা যায় সঙ্গী তারাটির ভর। যুগল তারার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল তারাটির সঙ্গে শুধু কৃষ্ণগহ্বর নয়, ঘুরতে পারে নিউট্রন নক্ষত্রও। আবার হতে পারে আরেকটি উজ্জ্বল তারাও। তবে উজ্জ্বল তারা ঘুরলেই সেটা তো দেখা যাবে টেলিস্কোপে। কিন্তু সঙ্গী তারাটি যদি কৃষ্ণগহ্বর হয়, তাহলে তাকে আর দেখা যাবে না।

জেলদোভিচ বলেন, তখন আরেকটা সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। সেটা হলো বিশাল ভরের কৃষ্ণগহ্বরটি তার সঙ্গী তারার চারপাশে ঘোরার সময় নিশ্চয়ই হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। কৃষ্ণগহ্বর মহাকাশের মহাখাদক। সঙ্গী তারাটি গা থেকে সে গ্যাসীয় পদার্থ টেনে নেবে নিজের দিকে। উজ্জ্বল তারা থেকে আসা গ্যাসীয় পদার্থগুলো সরাসরি কৃষ্ণগহ্বরে ঢুকে পড়বে না। সেগুলো প্রথমেই কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনাদিগন্তের চারপাশে ঘুরতে থাকবে, তারপর ধীরে ধীরে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে ঢুকে যাবে। একের পর এক উজ্জ্বল তারা থেকে আসা গ্যাসীয় পদার্থগুলো ঘটনাদিগন্তের চারপাশেই বৃত্তাকারে জমা হবে স্তরের পর স্তর। আর শেষে একদম নিচের স্তরটি ভেতরে ঢুকে যাবে। ক্রমাগত চলতে থাকবে এই প্রক্রিয়া। কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনাদিগন্তের চারপাশেই গ্যাসের স্তরগুলো একটা চাকতির মতো দেখাবে। উজ্জ্বল চাকতি। এ ধরনের চাকতিকে বলে অ্যাক্রেশন ডিস্ক। অন্যদিকে সঙ্গী উজ্জ্বল তারাটাকে তখন একটা ফুলে ওঠা বেলুনের মতো দেখাবে।

এম৮৭ কৃষ্ণগহ্বরটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা একটি সুপারম্যাসিভ বা অতিভরের কৃষ্ণগহ্বর। এর আশপাশে অনেক অনেক উজ্জ্বল তারা আছে। আছে অনেক ধুলো ও পাথর। উজ্জ্বল তারা থেকে গ্যাস চুরি করে কিংবা চারপাশে থাকা ধুলো ও পাথরখণ্ড কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে ঢোকার আগে অ্যাক্রেশন ডিস্ক তৈরি করে। উজ্জ্বল এই ডিস্কই ধরা দিয়েছে ইভেন্ট হরাইজনের ক্যামেরায়। মাঝখানে যে কালো বৃত্তটা দেখা যাচ্ছে, এটাই আসল কৃষ্ণগহ্বর।

এম৮৭ কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তুলেছে যে টেলিস্কোপগুলো, ৩০ বছর ধরে সচল সেগুলো। পৃথিবীর চার মহাদেশে আটটি। দানবের মতো আকার একেকটার। সবগুলো রেডিও টেলিস্কোপ। সাধারণ অপটিক্যাল টেলিস্কোপগুলো মহাকাশে ঘাপটি মেরে থাকা বস্তুগুলোকে ঠিকমতো শনাক্ত করতে পারে না। যেসব বস্তু সাধারণ আলোর বাইরে বেতার তরঙ্গ বিকিরণ করে, সেসব বেতার তরঙ্গের ভাষা বোঝার ক্ষমতা নেই অপটিক্যাল টেলিস্কোপের। মহাকাশের অলিগলি থেকে আসা সেসব বেতার তরঙ্গ শনাক্ত করার জন্য উঁচু উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় বসানো হয়েছে রেডিও টেলিস্কোপগুলো। কারণ, ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি বায়ুমণ্ডলের আর্দ্রতা অনেক বেশি থাকে। আর্দ্র বাতাস শুষে নেয় বেশির ভাগ বেতার তরঙ্গ। সামান্য কিছু যা অবশিষ্ট থাকে, তা দিয়ে মহাজাগতিক বস্তুর স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা, মেক্সিকো, চিলি, স্পেন আর অ্যান্টার্কটিকায় বসানো হয়েছে আটটি টেলিস্কোপ। এম৮৭-এর ছবি তোলার জন্য আকাশের একই দিকে একই সঙ্গে তাক করা হয়। আর সেটা করেন যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) গবেষকেরা। আটটি টেলিস্কোপের সমন্বয়ে তৈরি এই প্রকল্পের নাম ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ।

প্রকল্পটি পুরোপুরি সফল। কৃষ্ণগহ্বরের প্রথম ছবি দিয়েছে। দিন যত যাবে, প্রযুক্তিও তত উন্নত হবে। তখন ইভেন্ট হরাইজনের টেলিস্কোপের চেয়ে আরও উন্নত টেলিস্কোপ তৈরি হবে, সেটা নিশ্চিত। কে জানে, অদূর ভবিষ্যতে শিল্পীর কল্পনায় আঁকা ছবির মতো কৃষ্ণগহ্বরের ঝকঝকে ছবিও পাওয়া যাবে।