ভাইকিংদের কথা

৭৯৩ সালের এক সকাল। নর্থামব্রিয়ার উপকূলের সন্ন্যাসীদের আশ্রমটি জেগে উঠেছিল নিত্যদিনের মতো। সন্ন্যাসীদের আশ্রমে নেই কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। সেই যুগে এ রকম জায়গায় কোনো মানুষ চুরি বা ডাকাতি করতে আসতে পারে, তা ছিল কল্পনার বাইরে। কিন্তু দেখা গেল, হিংস্র পশুর মতো একদল মানুষ আচমকা হামলা করল সেই আশ্রমে। ভারী অস্ত্রের আঘাতে সন্ন্যাসীদের নির্মমভাবে হত্যা করে লুট করা হলো। বড় নৌকায় এসে আবার নৌকা ভর্তি করে লুটের জিনিসপত্র নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ফিরল বাড়ির পথে।

নথিপত্র অনুযায়ী এটিকে মনে করা হয় ভাইকিংদের প্রথম হামলা। পাইরেট বা জলদস্যু হিসেবে পরিচিত এই জাতির উৎপত্তি স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে। জায়গাটি অবস্থিত উত্তর ইউরোপে; যা ছিল ডেনমার্ক, সুইডেন ও নরওয়ে নিয়ে গঠিত।

হানাদার, শিকারি, বর্বর ভাইকিংদের মনে করা হতো ভিন্ন জগৎ থেকে আসা মানুষ, যারা অন্য সব যোদ্ধার চেয়ে আলাদা। ভাইকিংদের সাফল্য যে শুধু লুটপাট আর ডাকাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা নয়। যুদ্ধে, বুদ্ধিমতায় বা নির্মাণে পারদর্শী এ জাতি কয়েক শতক ধরে পৃথিবী চষে বেড়িয়েছে।

অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, ভাইকিং শব্দটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান শব্দ ‘ভাইকিংগার’ থেকে এসেছে। যার অর্থ পাইরেট বা জলদস্যু; যারা গ্রীষ্মকালের জন্য অপেক্ষা করত সারা বছর। কারণ, তখনই ডাকাতির জন্য বের হতে পারত। লুট করে নিয়ে এসে বিভিন্ন পণ্যের বদলে তা বিনিময় করত।

ভাইকিংদের ব্যবহৃত হেলমেট।

ভাইকিংদের এখন পর্যন্ত সব কটি ডাকাতি নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছে। ছোট ছোট গ্রাম থেকে শুরু করে চার্চ পর্যন্ত ডাকাতি করতে পিছপা হতো না তারা। পূর্ব দিকে রাশিয়া এবং কাসপিয়ান সাগর। জাহাজ চালিয়ে আটলান্টিক হয়ে উত্তর আমেরিকা পাড়ি দেওয়া দলটি কলম্বাসের পাঁচ শতক আগে পাড়ি জমিয়েছে আমেরিকায়। ভাইকিংরা বর্বর ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যেও শিল্পী, অনুসন্ধানকারী, গবেষকেরও দেখা মিলত।

ভাইকিংদের বসবাসের জায়গাটি সম্পূর্ণ গ্রামীণ এলাকা ছিল বলে ধারণা করা হয়। অধিকাংশ মানুষই কৃষিকাজ বা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। সপ্তম ও অষ্টম শতকে উন্নত মানের জাহাজ তৈরিতে এদের বেশ অবদান ছিল। সূর্যের আলো ব্যবহার করে দিকজ্ঞান করতে পারায় বিশাল সমুদ্র পাড়ি দিতেও এদের বিশেষ কষ্ট হতো না।

৭৯৩ সালের হামলার পরে পরপর স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্সে আক্রমণ করে ভাইকিংরা৷ যদিও হামলার শিকার কেউই তাদের ভাইকিংস বলে পরিচয় দেয়নি। নামটি বিখ্যাত হয় ১১ শতকে।

ভাইকিংদের মধ্যে বিখ্যাত হিসেবে পাওয়া যায় ইভার দ্য বোনলেসের নাম। যিনি ‘গ্রেট হিথেনস আর্মি’-এর দলনেতা ছিলেন। দলটি পূর্ব অ্যাংলিয়াতে ডাকাতি করে ৮৬৫ সালে। ডাবলিনের ভাইকিং কিংডমের জনক হিসেবে তাঁকে মনে করা হয়।

অবশ্য অনেকেই জানেন না ইভারের ডাকনাম কেন ‘দ্য বোনলেস’ হয়েছিল। অনেকেই মনে করেন, ইভারের দেহের ফ্লেক্সিবিলিটি অন্য সদস্যদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। আবার এমনও ধারণা আছে যে তাঁর হয়তো পেশির এমন কোনো রোগ ছিল যে তাঁর দেহ অন্যদের চেয়ে বেশি ফ্লেক্সিবল ছিল। আমরা আসলে কখনোই তা জানতে পারব না। অন্য বিখ্যাত ভাইকিংদের মধ্যে অড দ্য ডিপ-মাইন্ডেড, এরিক ব্লাড অ্যাক্স এবং এইনার বাটারড-ব্রেডের নাম জানা যায়।

সে সময় আইসল্যান্ড ছিল এমন একটি অঞ্চল, যেখানে সভ্যতার আলো ঠিকঠাক পৌঁছায়নি। তোমরা অনেকেই হয়তো মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের থর চরিত্রটিকে পছন্দ কর৷ থরের বাবা ওডিন, দ্য অল ফাদার। পুরোনো গডদের মধ্যে ওডিন ও থরকে পূজা করত ভাইকিংরা। থরের হ্যামারও ভাইকিংদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল।

ভাইকিংদের নামের সঙ্গে জড়িত একটি শব্দ ‘ভ্যালহালা’। বাংলায় বলা যেতে পারে যুদ্ধে নিহত বীরদের ভোজনকক্ষ। ভাইকিংরা মনে করত যুদ্ধে নিহত হলে তাদের ভ্যালহালাতে আমন্ত্রণ জানাবে ওডিন; যা এক সোনা দিয়ে বানানো বিশাল এক কক্ষ। যার দেয়ালে ৫৪০টি দরজা আছে। সেখানে রয়েছে পানীয় ও খাবারের ব্যবস্থা। মৃত্যুর পর এ ধরনের পুরস্কার লাভের আশায় তারা যুদ্ধ করত প্রাণপণে।

ভাইকিংদের বসবাসের জায়গাটি সম্পূর্ণ গ্রামীণ এলাকা ছিল বলে ধারণা করা হয়। অধিকাংশ মানুষই কৃষিকাজ বা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত।

এখন পর্যন্ত ভাইকিং নিয়ে অনেক মিথ প্রচলিত আছে। ভাইকিং নামটি শুনলেই অনেকে মনে করে শিংওয়ালা মাথার বর্ম পরা কোনো যোদ্ধার কথা। কিন্তু বাস্তবে ভাইকিংরা এ ধরনের কোনো বর্ম ব্যবহার করত না।

তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে যুগে মেয়েদের স্বাধীনতার দিক দিয়ে ভাইকিংরা বেশ এগিয়ে ছিল।

তথ্যসূত্র: হিস্টোরি এক্সট্রা