পড়ি কিন্তু মনে থাকে না। এ সমস্যা অনেকেরই। কিন্তু কেন? কারণ, মনোযোগ দিয়ে পড়ি না। মনোযোগ আসলে কী? চাইলেই কি মনোযোগ দিয়ে পড়া সম্ভব? মনোযোগ বাড়ানোর কি কোনো উপায় আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর আর পড়াশোনায় ভালো করার গবেষণায় প্রমাণিত নানা উপায় নিয়ে লিখেছে সাবহানাজ রশীদ।
গণিত ছিল টুনটুনির সারা জীবনের শত্রু। পরদিন গণিত পরীক্ষা ভাবলেই পাড়ার লোকজনকে জানিয়ে তার ১০২ ডিগ্রি জ্বর আসত। জীবনের স্বাদ হয়ে যেত তিতা করলার মতো। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় টুনটুনির এই বেহাল অবস্থা দেখে তার মা ঠিক করলেন, তাকে বাকি জীবনের জন্য ‘অঙ্কুরুষ’ (অঙ্কের বীরপুরুষ) বানিয়ে ফেলবেন। পারিবারিক উদ্যোগে মা-মেয়ের গণিত উত্সব শুরু হলো। সেখানে সুডোকু খেলতে গিয়ে নম্বরদের ওপর ক্রাশ খেল টুনটুনি, ম্যাচের কাঠি দিয়ে জ্যামিতি শিখল, পিংপং বলকে কীভাবে এবং কোন গতিতে ছুড়লে বাউন্স করে ফিরে আসে সেটিও জানতে পারল। সবচেয়ে অবাক হলো যখন বুঝতে পারল ইংরেজির সব অক্ষর সমীকরণ, বিন্দু ও বৃত্ত দিয়ে তৈরি করা যায়। এভাবে দুই সপ্তাহের ভেতর আম্মু টুনটুনির অঙ্কের ভীতি দূর করে দিলেন। টুনটুনি বাংলা সিনেমার মতো পরীক্ষায় ১০০-তে ১০০ না পেলেও বেশ সম্মানজনক নম্বর পেয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল। সে এখন অঙ্কের জাহাজ।
শব্দের গাছ ও গল্প
পড়াশোনায় ভালো করার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে বিষয়গুলোকে ‘পড়াশোনা’ না ভাবা। অর্থাৎ যা পড়ছি, তা গল্পের মতো পড়ে ফেলা। বাংলা বা ইংরেজিতে কঠিন শব্দ মনে রাখার খুব মজার ও কার্যকর পদ্ধতি হলো ‘শব্দের গাছ’ বানানো। যেকোনো সরল শব্দকে গাছের কাণ্ড ধরে সেই সম্পর্কিত বা কাছাকাছি অর্থের সব শব্দ দিয়ে ডালপালা বানিয়ে ফেলা যায়। গাছের পাতায় সেই শব্দের ব্যবহার নিয়ে ছোট্ট নোট টুকে রাখলে আর শিকড়ে মূল শব্দটির উৎপত্তি লিখে ফেললে ব্যাকরণ পানির মতো সরল হয়ে যায়। সকাল-বিকেল দুবার করে চোখ বোলালে যেকোনো শব্দ ছবির মতো করে মনে রাখা সম্ভব। একইভাবে রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানও অনেকটা গল্পের মতো। লোহিত রক্তকণিকা তৈরির প্রক্রিয়া, সালফিউরিক অ্যাসিডের গাঠনিক সংকেত অথবা মাধ্যাকর্ষণের মান—পুরোটাই রূপকথার গল্পের মতো আকর্ষণীয়, মুখস্থ করার কিছু নেই। প্রতিটার পেছনেই একটা করে দারুণ ও দুর্ধর্ষ গল্প আছে, সেটা যদি জেনে যাও তবে দেখবে মনে রাখা এমন কঠিন কিছু নয়। কারণ, মানুষের মস্তিষ্ক গল্পের কাঙাল, গল্পের বুননে যেকোনো তথ্যই সে সহজে মনে রাখতে পারে। আর যদি গল্প না থাকে তবে নিজেই বানিয়ে নিতে পারো। যেমন ধরো ইংরেজিতে একটা কঠিন বানানের শব্দ হলো লেফটেন্যান্ট (Lieutenant)। মুখস্থ করার চেষ্টা করলে মনে নাও থাকতে পারে। কিন্তু শব্দটি যদি তুমি ভাঙো তবে পাবে ‘লাই ইউ টেন অ্যান্ট’ মানে মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়া। আমি এই গল্পটা মনে রাখি এভাবে, একজন লেফটেন্যান্ট একদিন একটি মিথ্যা হাতে করে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন দশটা পিঁপড়া তাকে আক্রমণ করল।
অথবা ধরো সাইকোলজি (Psychology) শব্দটি। এটাকে ভাঙো, দেখো পাবে ‘পিসি চলো যাই’ অর্থাৎ সাইকোলজি এসে পিসিকে চলে যেতে বলেছে। তবে ইদানীং প্রায়ই আমি সময় পেলে ভাবতে বসি মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের বিমান যদি মাঝ আকাশে ভেঙে দুই টুকরো হয়ে যায়, তাহলে কোন গতিতে আকাশ থেকে পড়লে আমার হাত-পা ভাঙবে কিন্তু তার পরও বেঁচে যাব। একটি পড়ন্ত লিফট মাটিতে পড়ার আগ মুহূর্তে যদি আমি লাফ দিই ওপরে, তবে কি বেঁচে যাব? বা বায়ুবিদ্যার (অ্যারোডাইনামিকস) কোন সূত্রমতো বিমান আকাশে ওড়ে, রাইট ব্রাদারস কি এক সুন্দর সকালে বিমান আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন, নাকি একই সময় আরও অনেক মানুষ একই চেষ্টা করছিল। বড়দের জিজ্ঞেস করে এসব গল্প জেনে নিতে পারো। আর বড়রা যদি ঝাড়ি দিয়ে তাড়িয়ে দেয় তাহলে ইন্টারনেটে (বিশেষ করে ইউটিউবে) দারুণ ভিডিও পাওয়া যায়, যা দিয়ে যেকোনো বিষয় খুব সহজে বুঝে ফেলা সম্ভব। গুগল মামাকে খালি লেখো কী জানতে চাও, নিমেষেই সব তথ্য গল্পের মতো করে পেয়ে যাবে। খান একাডেমি (khanacademy.org), হাউ স্টাফ ওয়ার্কস (howstuffworks.com) ও এমআইটি ওপেন কোর্সের (ocw.mit.edu) মতো অনেক ওয়েবসাইটে প্রথম শ্রেণি থেকে এইচএসসি পর্যন্ত সব বিষয়ের ভিডিও ও বর্ণনা রয়েছে। এমনকি খান একাডেমির বাংলা সংস্করণে (bn.khanacademy.org) তুমি জানতে পারবে সবকিছু বাংলাতেই। আর বিভিন্ন বিষয়ে গল্পের মতো করে লেখা বই তো আছেই। যেমন ওয়াটসন ও ক্রিক আবিষ্কৃত ডিএনএ স্ট্রাকচার যদি কেউ বুঝতে না পারো, অ্যাডেনিন-থায়মিন-গুয়ানিন- সাইটোসিন যদি প্যাঁচানো সিঁড়ির মতোই প্যাঁচ খেয়ে যায় মাথায়, তবে বাজি ধরে বলতে পারি তুমি যদি জেমস ডি ওয়াটসনের ডাবল হেলিক্স বইটা পড়ো (বাংলা একাডেমি থেকে বাংলা অনুবাদও বেরিয়েছে) তবে জীবনেও আর এই বিষয়টা ভুলবে না। বইটা পুরোটাই অ্যাডভেঞ্চার ঢঙে লেখা, একবার পড়া শুরু করলে ওঠারও উপায় নেই। এ রকম আরও কত কত বই যে আছে শুধু তোমার পড়ার আর গল্পগুলো জানার অপেক্ষায়! পড়ে পড়ে জেনে ফেলো, গল্প শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দাও সবাইকে।
মন দিয়ে পড়ালেখা করে যেই জন...
এদিকে আবার একটা দলের মূল সমস্যা কিছুই নাকি তাদের মনে থাকে না। পরীক্ষার আগে আগে দিন-রাত পড়েও পরীক্ষায় লাড্ডাগুড্ডা পায়। পাবেই তো। কারণ, মানুষের মস্তিষ্ক এভাবে মনে রাখতে পারার জন্য তৈরি হয়নি। মা-বাবা যে প্রায়ই বলেন, মনোযোগ দিয়ে পড়ো, এর কারণও আছে। মন যদি অন্য কোথাও থাকে আর তুমি তোতা পাখির মতো বুলি আওড়ে পড়তেই থাকো, তবে মনে থাকবে কীভাবে? মনোযোগ জিনিসটা পুরোটাই একটা রাসায়নিক বিক্রিয়ার অংশ।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু ও বয়ঃসন্ধিকালের মনোবিশারদ ফারজানা ইসলামের মতে, মনোযোগ বাড়ানো পুরোটাই চর্চার বিষয়। বৈজ্ঞানিকভাবে ‘মনোযোগ’ মানে মস্তিষ্কের একধরনের রসক্ষরণ। যে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছে, তার মস্তিষ্কের গ্রন্থি (গ্ল্যান্ড) থেকে অ্যাড্রেনালিন ক্ষরণ হয়। যখন এই রসক্ষরণ নির্ধারিত মাত্রায় হয়, সেটিকেই মনোযোগ বলা হয়। এর চেয়ে বেশি ক্ষরণ হলে আমরা স্ট্রেস অথবা উত্তেজনা অনুভব করি। অ্যাড্রেনালিনকে এই নির্ধারিত মাত্রায় ক্ষরণ করার জন্য নিয়মিত কোনো একটা বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার অভ্যাস করতে হবে। পাঠ্যবই যদি প্রতিদিন একবার করে একই সময়ে বসে পড়া যায়, তবে মস্তিষ্ক নিজ থেকে একটা পদ্ধতি দাঁড় করিয়ে ফেলবে। তখন দেখা যাবে প্রতিদিনই ওই নির্দিষ্ট সময়ে পড়াশোনা বিষয়ে মনোযোগ বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের সবার অভ্যাস পরীক্ষার আগের রাতে প্রথমবারের মতো বই খোলা। কিন্তু মাথার চুল না ছিঁড়ে যদি পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে চাও, তবে নিয়মিত পড়াশোনা করার কোনো বিকল্প নেই। এর পাশাপাশি যারা নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করে বা পর্যাপ্ত পরিমাণে সময়মতো খায়, তারা অন্যদের তুলনায় বেশি মনোযোগী হয়। কারণ ওই একই অ্যাড্রেনালিনের ক্ষরণ নির্ধারিত মাত্রায় হওয়া আরও সহজ হয়ে যায়।
মনোযোগ বাড়ানোর অনেক মজার পদ্ধতি আছে। গান শুনতে শুনতে পড়লে, ভালো একটা সিনেমা দেখে পড়তে বসলে অথবা ছবি এঁকে বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করলে পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হওয়া যায়। স্কুলে পড়ার সময় আমি সকালে উঠে ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম বা সাইক্লিং করতাম। এতে সকালবেলা থেকে মস্তিষ্ক বেশ সক্রিয় হয়ে উঠত, সারা দিন স্কুলে আর ঘুম পেত না। খালি পেটে কখনোই পড়তে বসা উচিত নয়, তাহলে মাথায় কিছু ঢুকবে না। আবার পেট উঁচু করে ভাত খেয়ে পড়া বিপজ্জনক, চোখের পাতা ভারী হয়ে আসবে। অল্প অল্প করে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে খেলে পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হওয়া যায়।
অনেকেরই অভ্যাস রাত জেগে পড়া। প্রথম প্রথম এটি কার্যকর মনে হলেও দীর্ঘ সময় এই অভ্যাস থাকলে মস্তিষ্কের ওপর চাপ পড়ে আর রসক্ষরণের মাত্রায় ভারসাম্যহীনতা চলে আসে। শরীর অনেকটা ঘড়ির মতো চলে। সেখানে সময়মতো খাওয়াদাওয়া, ঘুম আর ব্যায়াম করা খুব জরুরি। এতে মস্তিষ্কের অক্সিজেন মাত্রাও ঠিক থাকে। তাই দিন থাকতে থাকতে পড়াশোনা শুরু করে বেশি রাত না জাগা ভালো।
ব্যায়াম করলে মনোযোগ বাড়ে!
অনেকে আবার মনে করে সারা দিন একটানা পড়াশোনা করলে সবকিছু একবারে বোঝা সম্ভব। ২০১৩ সালে প্রকাশিত সেল জার্নাল-এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল দীর্ঘদিন ধরে মস্তিষ্কে নতুন অণু তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করে আসছে। স্মরণশক্তি ও নতুন কিছু শেখার ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস সক্রিয়ভাবে কাজ করে।
গবেষণায় জানা গেছে, নিয়মিত খেলাধুলা অথবা দৌড়াদৌড়ি করলে শরীরে এফএনডিসি-৫ নামক বিশেষ একধরনের প্রোটিন উৎপাদন হয়। সেই প্রোটিনের প্রভাবে বিডিএনএফ নামক আরেকটি প্রোটিন মস্তিষ্কের ভেতর তৈরি হয়, যা নতুন অণু তৈরি করতে সাহায্য করে। সাধারণত এ ক্ষেত্রে হিপ্পোক্যাম্পাসে বেশি করে নতুন অণু তৈরি হয়, যা নতুন তথ্য ধারণ করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এরপর যখন বাবা-মা সারা দিনে বইয়ের ভেতর ডুবে থাকতে বলবেন, তাঁদের এই চমকপ্রদ গবেষণার কথা মনে করিয়ে দিতে ভুলো না কিন্তু।
বিশ্বের প্রথম মনোযোগ বাড়ানোর ‘গেম’
মনোযোগ বাড়ানোর জন্য আকর্ষণীয় ‘ব্রেইন গেমস’ও আছে। ১৯১৮ সালে থেরোন কিউ ডেমন্ট নামক এক ভদ্রলোক দ্য পাওয়ার অব কনসেনট্রেশন নামে একটি বই লিখেছিলেন। সেখানে তিনি বেশ কিছু ব্রেইন গেমসের কথা বলেছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ‘দ্য সিটিং গ্লাস এক্সপেরিমেন্ট’। প্রথমে একটা চেয়ারে আরাম করে কিন্তু পিঠ সোজা রেখে বসতে হবে। কোনো ধরনের আওয়াজ এবং নড়াচড়া না করে ১৫ মিনিট বসার পর ডান হাত কাঁধ বরাবর সামনের দিকে এগিয়ে দিতে হবে। এক মিনিট ডান হাতের পাঁচটি আঙুলের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ডান হাত নামিয়ে বাঁ হাত দিয়ে একইভাবে এক মিনিট আঙুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। এভাবে আস্তে আস্তে সময় বাড়ানো যেতে পারে। পরীক্ষার শেষ ধাপে যেকোনো এক হাত সোজা করে নাক বরাবর এক গ্লাস পানি ধরে থাকতে হবে। যদি কোনো আকস্মিক নড়াচড়া হয়, তখন পানি কেঁপে উঠবে। এভাবে একবার ডান হাত, একবার বাঁ হাত দিয়ে পাঁচ মিনিট পানির গ্লাস ধরে থাকতে হবে, যেন পানি না কেঁপে ওঠে। ডেমন্টের ভাষ্য অনুযায়ী, এই ‘ব্রেইন গেম’-এর মাধ্যমে শরীরের আকস্মিক নড়াচড়া নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব। এতে করে মস্তিষ্কের ওপরও নিয়ন্ত্রণ চলে আসে এবং দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রাখা যায়।
ইন্টারনেটে ভার্চুয়াল ব্রেন গেমস
ওয়েবের এই আমলে নানা ধরনের ‘ব্রেইন গেম’ পাওয়া যায় ক্লিক করলে। লুমোসিটি (lumosity.com), শেপার্ড সফটওয়্যার (www.sheppardsoftware.com/braingames) অথবা ন্যাটজিও (braingames.nationalgeogrpahic.com)-এ ঢুঁ মারলে নানা ধরনের তথ্য ও টিপস দেখা যাবে, যা দিয়ে মনোযোগ বাড়ানোর চর্চা করা যেতে পারে। কিন্তু ইন্টারনেটে যে রকম কাজের জিনিস পাওয়া যায়, ঠিক তেমন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করলে ‘ইনফরমেশন ওভারলোড’ হয়ে যায়। তখন মস্তিষ্কের যতটুকু ধারণশক্তি আছে, তার চেয়ে বেশি তথ্য একবারে ঢোকানোর চেষ্টা করলে সবকিছু তালগোল পেকে যায়।
ফেসবুকের কারণে কম মনে রাখতে পারি
সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ফেসবুক অথবা টুইটারের মতো যোগাযোগের মাধ্যম বেশি ব্যবহার করলে মস্তিষ্কের স্মরণশক্তির ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। তখন আমাদের মস্তিষ্ক ফেসবুকের নিউজফিডের মতো কাজ করা শুরু করে। রিফ্রেশ দিলে পাঁচ মিনিট আগের ফিড যেমন আর দেখা যায় না, ঠিক সেভাবে মস্তিষ্কও আর ১৫-২০ মিনিট আগের তথ্য মনে করতে পারে না। স্মরণশক্তি, নতুন কিছু শেখা আর কথা বলার জন্য যেই অণুগুলো কাজ করে, সেটির ২০ থেকে ৩০ শতাংশ নিউজফিডের ‘স্ট্যাটাস’ বুঝতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে দেখা যায়, আমাদের খুব দ্রুত কোনো কিছু শেখার বা মনে রাখার ক্ষমতা আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
আরও কিছু গবেষণালব্ধ তথ্য
ফেসবুকের কারণে অনেক দারুণ কিছু যেমন হয়েছে, ঠিক তেমন অতিরিক্ত ফেসবুকিং করায় আমাদের মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতাও কমে গেছে। ২০০০ সালে আমরা একনাগাড়ে ১২ সেকেন্ড যেকোনো একটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারতাম, যা ২০১২ সালে কমে মাত্র আট সেকেন্ড হয়ে গেছে। অনুমান করা হয়, আমাদের মনোযোগ এই ১২ বছরের ভেতর প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে।
জার্মানির বার্লিনের ফ্রেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দার মেশি বিশ্বের প্রথম মস্তিষ্ক স্ক্যানের সঙ্গে আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করেন। ২০১৩ সালে প্রকাশিত এই গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের দৈনন্দিন ভালো লাগার অনুভূতি অনেকটাই ফেসবুকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কতগুলো লাইক, শেয়ার বাইতিবাচক কমেন্টস পাচ্ছি, তার পুরোটাই আমাদের মস্তিষ্কের একটি অংশ (নিউক্লিয়াস অ্যাকাম্বেন্স) দেখলে বোঝা যায়। ইতিবাচক কোনো কিছু হলে এই অংশটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। গবেষণায় আরও জানা গেছে, যারা সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারী, তাদের মস্তিষ্কের এই অংশটি বাকিদের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় এবং যেকোনো ভার্চুয়াল প্রশংসা পেলে তা খুব দ্রুত সেটি গ্রহণ করতে পারে। ফলে আমাদের নন-ভার্চুয়াল জীবনের অর্জনগুলোর চেয়ে ভার্চুয়ালি যেই প্রশংসা পাই, তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এতে করে আমাদের ‘রিয়েল লাইফ’ অর্জনের প্রতি মনোযোগ কমতে থাকে, পরীক্ষায় ১০০-তে ১০০ পেয়ে ফেসবুকের বন্ধুদের ‘বাহ্! বাহ্!’ না পেলে আমরা মনে করি, এটা তেমন কোনো অর্জন নয়।
পড়াশোনায় ভালো করার উপায়
সবশেষে চলো জেনে নিই পড়াশোনায় ভালো করার কার্যকরী কিছু টিপস—
কোনো কিছু পড়ার সময় তা বুঝে পড়তে হবে। প্রয়োজন হলে ছবি এঁকে পড়া ভালো।
প্রতিটি বিষয় পড়ার পর পাঁচ মিনিট বিরতি দিয়ে পুরোটা নিজের মতো করে সংক্ষেপে লিখে রাখো অথবা ছবি এঁকে রাখো।
যেই বিষয়টি নিয়ে পড়া হচ্ছে, তা ‘রিয়েল লাইফে’ কীভাবে কাজে লাগতে পারে, তা কল্পনা করা। আশপাশের জিনিসপত্র বা ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে মাথায় রাখলে তা চট করে মনে করা অনেক সহজ হয়ে যায়।
একবারে সবকিছু না পড়ে অল্প অল্প করে পুরো বিষয়টা পড়া। একটানা ১২ ঘণ্টা পড়লে অনেক কিছুই ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তাই এক থেকে দুই ঘণ্টা পড়ে ১০ মিনিট বিরতি দিয়ে পড়লে সেটিতে বেশি মনোযোগ থাকে।
একটি বিষয়ের সঙ্গে আরেকটি বিষয়ের সম্পর্ক বুঝে পড়া বা সংকেত তৈরি করা। অর্থাৎ কীভাবে গাছ সূর্যের আলো দিয়ে নিজের খাবার নিজেই তৈরি করতে পারে, তা ‘সবুজ’ শব্দটির সঙ্গে মিলিয়ে মনে রাখা। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ‘সবুজ’ বললেই ‘ক্লোরোফিল’ শব্দটি মাথায় আসবে, যা গাছের খাদ্য উৎপাদনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে।
কোনো একটা শব্দ বুঝতে না পারলে জোর করে মুখস্থ করার চেষ্টা না করে অভিধান খুলে বসে অর্থ দেখো। তখন দেখবে সেটা সহজেই মনে থাকছে।
সার্কুলার রিডিং করো। মানে যে জিনিসটা পড়ছ, সেই জিনিসের সঙ্গে মিল দিয়ে আর যা যা প্রয়োজন দেখে রাখো একবারেই। যেমন ‘আইনস্টাইনের জন্ম কবে এই তথ্য যখন পড়ছ, তখন একই সময়ে বা কাছাকাছি সময়ে আর কোনো বিখ্যাত লোকের জন্ম বা মৃত্যু হয়েছে, বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটেছে কি না সেটা দেখে রাখলে একসঙ্গে অনেক জিনিস মনে থাকবে।
রোজ এক পাতা করে লেখার চেষ্টা করো। সেটা পড়াশোনা সম্পর্কিতই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যেকোনো বিষয়েই লিখতে পারো এবং নিজের পছন্দমতো বই অল্প করে হলেও প্রতিদিন পড়ো। এতে তোমার বাক্য গঠন ভালো হবে, বানান শুদ্ধ হবে।
যেকোনো ভাষায় দক্ষ হতে ব্যাকরণ জানা খুবই জরুরি। ব্যাকরণ জিনিসটাকে খটমট মনে হতে পারে কিন্তু ঠান্ডা মাথায় যদি একবার বুঝে উঠতে পারো, তাহলে আর কখনো আটকাবে না।
পড়ার সময় অন্য চিন্তা একেবারেই নয়। যদি অন্য চিন্তা খুবই ঝামেলা করে, তাহলে বই বন্ধ করে আগে অন্য চিন্তার একটা বিহিত করে তবেই পড়তে বসো। তাহলে শুধু শুধু সময় নষ্ট হবে না।
পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে ভেঙে পড়া চলবে না। জীবনে শত শত পরীক্ষা আসবে। তার কোনো একটা খারাপ করা মানেই তুমি শেষ হয়ে যাওনি। পরেরটার জন্য প্রস্তুতি নাও।
কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবো না। তাহলে দেখবে সে কী করছে, পরীক্ষায় বেশি পেয়ে গেল কি না এসব নিয়েই ভাবতে হচ্ছে বেশি। সময়ও নষ্ট হচ্ছে তোমার। আর মনোযোগও অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। কেউ ভালো করলে তাকে অভিনন্দন জানাও।
না বুঝে কখনো কোনো কিছু পড়বে না। তাহলে পড়াটাই সার হবে। কিচ্ছু মনে থাকবে না।
রুটিন করে পড়ো। এতে মনোযোগ যে বাড়ে, সেটা তো আগেই বলেছি।
তথ্যসূত্র: হাউ স্টাফ ওয়ার্কস, অ্যাকশন ফর হেলদি কিডস, ফোর্বস, স্টাইল ক্রেজ, বেস্ট মাস্টার ইন সাইকেলজি, ইনফোগ্রাফিক জার্নাল ও টাইম ওয়েবসাইট
মডেল: পুষ্পিতা, ফাইয়াজ, তাজ, সানজানা, মৌ, মুগ্ধ, এলিন, নওশীন, কুইন ও অরিন | ছবি: সুমন ইউসুফ ও সাবহানাজ রশীদ